দক্ষিণ আফ্রিকার নগন্য শ্বেতবর্ণের স্বৈরতান্ত্রিক শাসক দল কর্তৃক সংখ্যাগুরু এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মূল কৃষ্ণবর্ণ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে অনুসৃত পৃথকাবাসনের এবং নিগ্রহের নীতি বর্ণবৈষম্য বা বর্ণবিদ্বেষ বা জাতিবিদ্বেষ (ইংরেজি: Apartheid) বলে পরিচিত। ইংরেজ ‘আপারথিড’ কথার উদ্ভব দক্ষিণ আফ্রিকায়। এর অর্থ জাতিগত পার্থক্যের ভিত্তিতে অধিবাসীদের পৃথক বাসের ব্যবস্থা করা।
ইউরোপের শ্বেতবর্ণের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক আফ্রিকা মহাদেশ জোর করে দখলের সূচনায় অর্থ্যাৎ সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষশ্যের নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ন্যাশনাল পার্টি নামক রাজনৈতিক দল ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণবর্ণ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে নান প্রকার বৈষম্যমূলক বিধান প্রণয়ন করা হতে থাকে। এই সমস্ত আইন দ্বারা শ্বেতবর্ণের সরকার অশ্বেতকায়দের সব রকম রাজনীতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাদের যাতায়াতের অধিকার, জীবিকার্জনের স্বাধীনতা, ধর্মপালন এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। বাসস্থান নির্বিশেষে মানুষ সমান এবং সমান সুযোগের অধিকার একথা প্রচার করা কিংবা বিশ্বাস করা দক্ষিণ আফ্রিকাতে অপরাধ বলে বিবেচিত।
১৯৫২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার অনুসৃত এই বর্ণবৈষম্যের নীতির উপর আলোচনা করা হয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দাজ্ঞাপক প্রস্তাব গ্রহণ করে সকল রাষ্ট্র যেন দক্ষিণ আফিকাকে আন্তর্জাতিকভাবে বর্জন করে এরূপ আহব্বানও গৃহীত হয়। কিন্তু এরূপ প্রস্তাবের কোনো বাস্তব কার্যকর ভূমিকা না থাকতে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার তার নীতির কোনো পরিবর্তন করে নি। সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও অব্যাহত রেখেছে। বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার জনসাধারণ দীর্ঘকাল যাবৎ বিভিন্ন প্রকারে সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। ১৯৮৫ সালে এ সংগ্রাম সাফল্যের এক ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌছেছে, একথা বলা যায়।
বর্ণবৈষম্য বা বর্ণবিদ্বেষ কেবল দক্ষিণ আফ্রিকাতেই অনুসৃত হচ্ছে না। ধনবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবৈষম্যের আবহাওয়া বিশেষ প্রকট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে নিগ্রো অধিবাসীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ না করলেও তার দক্ষিণাঞ্চলীয় অনেকে অঙ্গরাষ্ট্রে সরকারিভাবে নিগ্রোদের বিরুদ্ধে বাসস্থান, শিক্ষা ও জীবিকায় বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে অবশেষে নব্বই দশকের গোড়ার দিকে শ্বেতবর্ণের শাসনকারী সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার সকল নাগরিকের ভোটদানের এবং শাসন করার অধিকার স্বীকার করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের অবসানের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৬৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।