আমি একদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছি
গাড়ি চালাতে চালাতে কেউ মাথা ঘুরিয়ে
তাকিয়েছে পাশের অষ্টাদশির দিকে,
কেউবা দেখেছে চোখ টেরিয়ে পশ্চাতে সম্মুখে,
দৃশ্যেরা আমার কাছে সুপার ইম্পোজ করা ছবির
মতো মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে পরস্পরঃ
ভালোবেসে দুজনের হাত ধরে পাশাপাশি
নিরন্তর হাঁটাহাঁটি—সত্যি কি তাই?
এ-পৃথিবীর নিবিড় সত্য ভালোবাসা বলে কিছু নাই।
আমরা কেউ কেউ তদুপরি নিয়মিত ভালোবাসার চত্বরে যাই,
চা খাই, কিছুক্ষণ গল্পের চিকন কোমর ধরে দাঁড়িয়ে থাকি
কেউবা কবিতা ও দুছত্র গান হাওয়ায় লিখে রেখে
মধ্যরাতে রাত্রির কড়া নেড়ে ঘরে ফিরি,
বুকে দীর্ঘশ্বাসের এক চিলতে জমি
ঠান্ডায় অসাড়;
আমরা নানা নামে ডাকি ওই জায়গাকেঃ উল্কামন্দির,
ওইতিহাসিক কাঁচাপাকা আম্রকানন, তড়িৎ নদী মোহনা;
কারো চোখ জানায় ওখানে আছে অসাধারণ
ভাঁজ বহুল উদ্যান বেষ্টিত স্মৃতিপিন্ড, শুভ শস্যাগার,
চিনামাটির কারুকার্য খচিত ভেনাসের কালোমূর্তি।
ওখানে থাকে, আমাদের সবাই দেখেছে, স্বপ্নের কুয়াশা
স্মৃতিময় আঙটি পাললিক ভোর আরণ্যক সন্ধ্যা
রাত্রির আলো আঁধারির আদিম ভিটে মাটির সংস্কৃতি;
ওইখানে
আমি একদিন পেয়েছিলাম সভ্যতা খনন করে
সুউচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত দুর্গে পোড়া মাটির নারীমূর্তি,
ঘূর্ণায়মান বিশের বছরগুলোয় আমরা ছিলাম বাহুডোরে আবদ্ধ,
বুঝেছিলাম সামুদ্রিক স্রোতের শক্তি;
উপভোগ করেছিলাম দুর্বার বেগে ছুটে আসা অপর মহাদেশ থেকে
মৌসুমি আয়ন ও নিয়ত বায়ু মিশ্রিত সামুদ্রিক বাতাস।
আমরা দুর্ভাগ্যবশত লিখেছিলাম সংঘাতের ইতিহাস,
আমাদের আকাশে ছিল হেলেনিক শিল্পকলা,
প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরে ছিলো শেকসপিয়রের বাড়ি,
মুখে মুখে ছিলো নেরুদার অনুস্মৃতি,
চোখের কোণে লুকিয়ে ছিল লাল আলোর টিপ,
দেবি এথেনা আর খয়েরি রঙ শাড়ি,
ছিল জীবনের দুই পাড়ে ফিবছরব্যাপি
যাদুবিদ্যা প্রর্দশনী জীবন সংগ্রাম,
শৈল্পিক ঠোঁটে দোলায়মান সিঙহীর উদ্দামতা,
মন হরণের বড়শি আর হৃদয়ের ফাতনায় টান,
ছিল জলে ভাসা কবিতা পড়ার দিন,
প্রাচীণ মসৃণ হাতিয়ারকে ভালো লাগার মতো
তোমার চিন্তায় অভিভূত আমার কাব্য বয়ন,
পথে প্রান্তরে সর্বখানে যাকে দেখি;— ভ্রম হয় সে তো তুমিই;
তোমার চোখ ও ভুরু, চুলের দৈর্ঘ্য, শব্দময় হাসি,
হাঁটবার ভঙ্গি কেন যে সবাই সে সময় নকল করা করলো শুরু;
তুমিও কী সে রকমই ভাবতে আমার ব্যাপারে।
একবার তোমার খুব হলো জ্বর
তোমার অশরীরী উত্তাপ মিশে গেল
আমার দশদিকের হাওয়ায় হাওয়ায়,
অথচ এমনিতে তুমি ছিলে কী শান্ত ও ঠান্ডা;
আর একদিন আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে খুব কাঁদলাম,
তুমি আমাকে থামিয়েছিলে আইসকৃম খাইয়ে,
সেই আমাদের প্রাথমিক যোগাযোগ।
এরপর আমরা জেনেছি এই পৃথিবীর উপরিভাগে
অনেকগুলো স্বপ্ন ও মায়ার দোলনা আছে,
যাযাবর শক্তি আছে, পাশাপাশি ঘূর্ণায়মান
দুটি সাম্রাজ্যের পরস্পর নির্ভরতা আছে।
তোমার ঘুম ও ক্লান্তির মাঝখানে
দুটি পর্বতের ছায়া আমাকে করে তুলতো বিহ্বল
ভালোবাসা কতো কী মনে রাখে;—
বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাওয়া শহুরে সাইরেন,
রোদ্দুরের গান, বেহুলার কন্ঠস্বর,
খেজুরের রসে ভরা সিঁদুরে সন্ধ্যা,
হিমালয়ের চুড়ায় পরিকল্পনাহীন হেঁটে যাওয়া,
উষ্ণতার পাদদেশে ফুটন্ত জবা ফুল,
প্রশান্ত কুয়াশায় এক ঝাঁক উড়ে চলা
অতিথি পাখির পাখার প্রতিধ্বনি,
আবেগের কিনারায় উছলে ওঠা কথার সাম্রাজ্য,
গতিময়তার শব্দে মিশে থাকা তোমার হস্তলিপি।
একদিন আমরা সাঁতার কেটেছিলাম একটি ভালুকের
পিঠে বসে থেকে, তুমি জাপটে ধরেছিলে জিউসের ভাস্কর্য
এবং বুঝতে চেয়েছিলে দারিয়ুস কেন এথেন্স
আক্রমণ করেছিল; তুমি বলেছিলে
‘লক্ষণসেন খুব ভীতু ছিলো ঠিক তোমার মতো’,
তুমি ক্ষমা করোনি জাফর ও খিলজিকে
তুমি আমাকেও করোনি ক্ষমা।
তবুও আমরা দেখতাম পাখিগুলি কীভাবে ঠোকর মারে
আয়নায় জানালার কাঁচে জানালার কাছে;
তুমি বলেছিলে ‘প্রেমে পড়লেই ওরকম করে তারা
এমনকি মশা ও ইঁদুরেরাও একই আচরণি’;
এরপর দেখেছি কাঠঠোকরার মতো ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে
কারা যেন ক্ষত তৈরি করেছে পাখিদের বুকে
মাছেদের দেহে শস্যের খেতে র্সষের ফুলে;
কতিপয় বেয়াড়া সন্তান শুধু হাতুড়ি কাস্তে হাতে
শীতকালেও মরুভূমিকে সরিয়ে রেখে আসতে চেয়েছে ফুলেল বাগানে।
আমি দুঃস্বপ্নে দেখেছি উল্টো করা পৃথিবী,
উপুড় করা মহাবিশ্ব, চিত হয়ে মরে থাকা
আমার আত্মীয়া যিনি কটিতে মেখলা
কোমরে বিছা ও হৃদয়ে হৃদয় বন্ধনি পরতেন
এবং নটরাজ শিবের মতো নাচতেন;
তুমি তাকে দেখে তুলির রঙে অতিপ্রাকৃত
কল্পনা মিশিয়ে কিছু ছবি একেঁছিলে,
তার মাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছে
লাল রঙের চুনাপাথরে খোদিত পুরুষমূর্তি,
আশপাশের জ্যামিতিক তৃণ ভুমিতে চরছে
গরু মোষ ডাইনোসর হাতি ও তার নাতি,
লম্বাটে সর্পিল নদীতে সাঁতরাচ্ছে হাঁস, কচ্ছপ ও মৎস্যকন্যা,
গাছের রঙ নীল পানির রঙ সবুজ;
ছবির প্রাণীদের জীবনও চলে প্রতিদিন তোমারই মতো
সে ছবির এককোণে এঁকেছিলে তোমার কুটির,
আমি ছিলাম সেখানে অনাহুত আগন্তুক,
প্রবহমান দূরের নদীটিতে আমাজনের ছায়া,
পাশের দেশটির নাম বলিভিয়া
তুমি সেই দেশে নিশিতে
লাল সূর্য দেখিয়েছিলে উঠাতে,
শুনেছিলে গেরিলার বুটের আওয়াজ
গরিলার শুভ সংকেত,
লড়াইয়ের দিনের সংগ্রাম ও প্রেম
উড়ে উড়ে মিশে গেছে কুটিরে প্রান্তরে;
সেই দেশে ট্রেনিংয়ের কালে তুমি আবডালে হেসে
চোখ টিপে জানিয়েছিলে এগোবার প্রণয়ি উর্মি
কেননা
চন্দনের বন আজ চন্দননগর
অর্থবন্দরের পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া
তোমার কন্ঠের আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে
সভ্যতার রঞ্জিত পোড়া সময়পাত্রে।
চিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত অংকিত চিত্রটি লুই জ্যাঁ ফ্রান্সিস লাগরেনের (১৭২৫-১৮০৫) আঁকা চিত্র ‘ঘুমন্ত কিউপিডকে দেখে সাইকির বিস্ময়‘ (Psyche Surprises the Sleeping Cupid)। শিল্পী চিত্রটি আঁকেন ১৭৬৯ সালে। ছবিটি উপরে নিচে কিছুটা ছেঁটে ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।