তালমা নদী (ইংরেজি: Talma River) বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মান্তাদারি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং শিকারপুর গ্রামের জংগল থেকে উৎপত্তি লাভ করে জলপাইগুড়ি থেকে প্রবাহিত হয়ে পঞ্চগড় সদর উপজেলার আমরখানা ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অতঃপর একই জেলার পঞ্চগড় সদর উপজেলার কামাত কাজল দীঘি ইউনিয়ন অবধি প্রবাহিত হয়ে করতোয়া নদীতে পতিত হয়েছে।
বাংলাদেশ অংশে তালমা নদীটির দৈর্ঘ্য ২৮ কিলোমিটার, প্রস্থ ৬০ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটি বাংলাদেশের পঞ্চগড় এবং পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহমান। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পাউবো কর্তৃক তালমা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৫১।[১] বর্তমানে গজলডোবা ব্যারেজের ক্যানেল এবং পাকা সড়ক নির্মাণের কারণে মান্তাদারি গ্রামের উত্তরের জংগলের সাথে নদীটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
তালমা নদীতে সারাবছর পানির প্রবাহ থাকে। বর্ষাকালে পানির প্রবাহ স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক মাত্রায় সঞ্চারিত হয়। নদীটি বন্যাপ্রবণ নয় কিন্তু বর্ষার সময় এর ভাঙনপ্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে পানির মাত্রা আশংকাজনক পর্যায়ে হ্রাস পায়। এ সময় নদীর পাড়ে রীতিমতো চাষাবাদ করা হয়। পলির প্রভাবে এ নদীর তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে অতীতের তুলনায় পানির প্রবহমানতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
অন্যান্য তথ্য: তালমা নদীটি বারোমাসি প্রকৃতির এবং নদীটি জোয়ার ভাটা প্রভাবিত নয়। এই নদীর অববাহিকার পঞ্চগড় জেলার অংশে কোনো প্রকল্প, ব্যারাজ বা রেগুলেটর নেই। কিন্তু জলপাইগুড়ি জেলা অংশে আছে গজলডোবা ক্যানাল প্রকল্প। প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে পৃথবু রাজা ভিতরগড়ের উত্তর প্রান্তে একটি পাথরের বাঁধ (বীর বাঁধ) নির্মাণ করে এর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। বর্তমানে পঞ্চগড় সদর উপজেলার ভিতরগড় সীমান্ত ফাঁড়ির বিপরীতে তালমা নদীতে ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে।
বাংলাদেশের নদীকোষ গ্রন্থে ড. অশোক বিশ্বাস তালমা নদীকে জলপাইগুড়ি জেলার বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। পঞ্চগড়ের ভিতরগড় অঞ্চলে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদী বাংলাদেশে প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে পঞ্চগড় শহরের প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে কাজলদীঘির নিকটবর্তী করতোয়া নদীতে পড়েছে।
তালমা নদীটি প্রাচীন নগরী ভিতরগড়ের উত্তর দিক বেষ্টন করে এসে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তালমা নদী দুটি কারণে জনজীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নদী হিসেবে বিবেচিত। একটি গুরুত্ব আর্থিক বিবেচনায়। নদীখাত থেকে নুড়ি আহরণ করে সারাবছর অনেকেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। আর দ্বিতীয় গুরুত্ব হলো সংস্কৃতির সম্প্রীতি বিবেচনায়। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পরে প্রতি বছর এই নদীতীরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে মেলা হয়। তখন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নদী পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামের লোকজন উপচে পড়ে সে মেলায়। উভয় দেশের আত্মীয়স্বজনের সাথে সাক্ষাত, উপহার, মিষ্টান্ন বিনিময় চলে। এই মেলা এখনো দুদেশের তালমা পাড়ের মানুষের সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির।[২]
তথ্যসূত্র:
১. মানিক, মোহাম্মদ রাজ্জাক, বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, পৃ: ১২০-১২১।
২. ড. অশোক বিশ্বাস, বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ২১৫
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।