ব্যক্তি তার মনের কোনো অবস্থা যখন সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে তখন এই পর্যবেক্ষণকে অন্তর্দর্শন বা আত্মনিরীক্ষণ (ইংরেজি: Introspection) বলা হয়। নিজের মনের অবস্থা ব্যক্তির নিজের পক্ষে পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা মানুষের মনের উন্নততর বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। আত্মনিরীক্ষণের ফল ব্যক্তির বর্ণনার মাধ্যমেই মাত্র অপরে জানতে পারে। তার সে বিবরণ যথার্থ কিনা তা প্রমাণ বা পরীক্ষার উপায় থাকে না।
মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগগত দিক বিকশিত হওয়ার পূর্বে বিংশ শতকের প্রায় তিন দশক পর্যন্ত আত্মনিরীক্ষণকেই মনোবিজ্ঞানীগণ মনের সব রকম প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের একমাত্র উপায় বলে মনে করতেন। কারণ তাঁদের ধারণা ছিল, মনোবিজ্ঞান হচ্ছে মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বিজ্ঞান। মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যার মন সে ব্যতীত অপরে কেমন করে জানবে? যার দাঁতে ব্যথা একমাত্র সেই বলতে পারবে ব্যথা কিরূপ। মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে পুত্রের মনে কি ভাবের উদ্ভব হয়েছে তা পুত্রই মাত্র বলতে পারবে। আর এর উপায় হচ্ছে ব্যক্তির মনের চোখকে মনের ঘটনার উপর নিক্ষেপ করে তা নিরীক্ষণ করে তার বিবরণ অপরকে জানানো। একথা সহজেই বুঝা যায় যে, আত্মনিরীক্ষণের এই উপায় একান্ত ব্যক্তিগত। তা ছাড়া ব্যক্তির মনে যখন কোনো আবেগ বা উত্তেজনা সৃষ্টি হয় সেই মুহুর্তে উত্তেজিত ব্যক্তির পক্ষে নিরপেক্ষ এবং অনুত্তেজিত ভাব নিয়ে নিজের উত্তেজিত মনকে নিরীক্ষণ করা কতখানি সম্ভব, এটা একটা বড় প্রশ্ন হিসাবে দেখা দেয়।
মনের কোনো ক্রিয়ার উপর মন দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে সেই ক্রিয়ার তীব্রতা হ্রাস পায়। আবার ঘটনার পর ব্যক্তি তাকে স্মরণ করার চেষ্টা করলে সে স্মৃতিও যথাযথ নাও হতে পারে। আত্মনিরীক্ষণের এসকল অসুবিধার কারণে মনোবিজ্ঞানীগণ পরবর্তীকালে নতুন পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে আত্মনিরীক্ষণবাদী মনোবিজ্ঞানের স্থলে আচরণবাদী ও প্রয়োগবাদী মনোবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে আত্মনিরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের প্রধান পদ্ধতি বলে বিবেচিত হয় না। দেহের সঙ্গে মনের সম্পর্কের ভিত্তিতে দেহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং পৌণঃপুনিক পরীক্ষাযোগ্য বিভিন্ন পরীক্ষণ পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৩৬-২৩৭।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।