রাজনীতির বিকল্প এখনো কিছু বের হয়নি; সব কিছুতেই রাজনীতি আছে। আর একুশ শতকের রাজনীতিতে প্রাধান্যকারী ভূমিকায় আছে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ। বর্তমান পুঁজিবাদি-সাম্রাজ্যবাদি রাজনীতিকে, মুদ্রার ও স্বার্থের রাজনীতিকে, লোভ ও হিংসার রাজনীতিকে, যুদ্ধ ও অস্ত্রের রাজনীতিকে সমাজতন্ত্রের রাজনীতি দিয়ে পরাজিত করতে পারলেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। এই বৈষম্যমূলক রাজনীতি টিকেই আছে মুদ্রা বা অর্থ বা টাকার (ইংরেজিঃ Money) শক্তিতে। মুদ্রাকে নানা রূপে টিকিয়ে রেখেছে মুনাফা ও ব্যবসার নামে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদ।
পুঁজিবাদের নীতিকে টিকিয়ে রাখে টাকা নামক এক কাগজ যা একদা মানুষের লেনদেন, তুল্যমূল্য ও সঞ্চয়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছিল। সেই টাকা এবং মুনাফা আজ মানুষের শত্রু। মুদ্রা আজ শুধু শ্রমের মাপকাঠি নয়, প্রায় প্রত্যেক জিনিসের মাপকাঠি। যে মানুষ একদা ছিলো সম্পদ উৎপাদনকারী, প্রকারান্তরে তারা এখন মুদ্রা বা টাকা উৎপাদনকারী এক ভারবাহী পশু ছাড়া আর কিছু নয়।
কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) উল্লেখ করেছেন বুর্জোয়াদের উদ্ভবের সাথে সাথে মুদ্রা সব সম্পর্কের স্থান দখল করে নিচ্ছিল। বুর্জোয়া শ্রেণি যেখানেই শক্তি অর্জন করতে পেরেছিল সেখানেই সামন্তবাদী, পিতৃতান্ত্রিক, প্রকৃতি-শোভন সব সম্পর্ককেই শেষ করে দিয়েছিলো। কমিউনিস্ট ইশতেহারে মার্কস এঙ্গেলস লিখেছিলেন যে, ‘মানুষের সঙ্গে মানুষের অনাবৃত স্বার্থের বন্ধন, নির্বিকার ‘নগদ টাকার’ বাঁধন ছাড়া আর কিছুই’[১] বুর্জোয়ারা বাকি রাখে নি।
আজ সারা পৃথিবীতে আমরা মুদ্রার সেই সর্বব্যাপকতা আর সর্বত্র বিরাজমানতা দেখতে পাই। আর মুদ্রার সর্বব্যাপকতাই তার সর্বশক্তিমত্তা। মার্কস এর ভাষায়, “টাকা হচ্ছে প্রয়োজন ও বস্তুর মধ্যেকার যোগসূত্র_ মানুষের জীবন ও খাদ্যের মধ্যেকার যোগসূত্র, তবে যা আমার জন্য আমার জীবনের মধ্যস্থতা করে, সে তো আমার জন্য অন্যান্য জনগণেরও মধ্যস্থতা করে।”[২] পুঁজিবাদী দুনিয়ায় অর্থের ক্ষমতা সম্পর্কে কার্ল মার্কস লিখেছেন যে অর্থ একজন ব্যক্তির ভিত্তিকে বদলে দিতে পারে। যে ব্যক্তি অর্থের মালিক, সেক্ষেত্রে অর্থের ক্ষমতা যতটুকু, ব্যক্তির ক্ষমতাও ততটুকু হয়ে যায়। অর্থের গুনাবলীই, অর্থের মালিকের গুণাবলী আর অত্যাবশ্যকীয় ক্ষমতা হয়ে দাঁড়ায়। টাকা কীভাবে একজন ব্যক্তিকে আমূল বদলে দেয় সে সম্পর্কে মার্কস লিখেছেন,
“আমি কুশ্রী, কিন্তু আমার জন্য আমি সবচাইতে রূপবতী রমণীটি খরিদ করতে পারি। অতএব আমি আর কুশ্রী নই, কারণ কুশ্রীতার প্রভাব এর বিকর্ষণ ক্ষমতা অর্থ দূর করে দিচ্ছে। ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যে আমি খোঁড়া, কিন্তু অর্থ আমাকে দু-চারটি নয়, চব্বিশটি পা দিয়ে সাজিয়ে দেবে। অতএব আমি খোঁড়া নই। আমি মন্দ, অসৎ, বিবেকহীন, নির্বোধ; কিন্তু অর্থ তো সন্মানের জিনিস–তাই অর্থের মালিকও সন্মানিত। অর্থ চরম শুভ, তাই এর মালিকও তাই। এর পাশাপাশি অর্থ আমাকে অসৎ হওয়ার যন্ত্রণা থেকে বাঁচায়ঃ আমাকে ধরে নেয়া হয় সৎ। আমি নির্বোধ, কিন্তু অর্থ হচ্ছে সবকিছুর আসল মগজ, তারপর আর কিভাবে অর্থের মালিক বুদ্ধিহীন হতে পারে? তাছাড়া আমি নিজের জন্য চতুর লোকদের কিনতে পারি। আর যে কিনা চতুর লোকদের উপর দাপটে বেড়ায় সে কি ঐসব চতুর লোকদের চেয়েও চতুর নয়? যে আমি অর্থকে ধন্য ধন্য করি সে আমি কি মানব হৃদয় যা কিছুর দিকে চেয়ে থাকে তার সব কব্জা করতে পারি না? সে আমি কি সব মানব সামর্থ ধারণ করি না? তা হলে আমার অর্থ কি আমার সব অক্ষমতাকে ক্ষমতায় বদলে দেয় না’?[৩]
মার্কসের মতে এমনিভাবে টাকা ব্যক্তির মূল ক্ষমতাকে বা পূর্ব ক্ষমতাকে বদলে দেয়; ব্যক্তি অর্থহীন অবস্থায় যা করতে পারতো, অর্থের মালিক হবার পরে তার ক্ষমতার পরিধি বদলে যায়, অর্থাৎ তার ব্যক্তিত্বই বদলে যায়।
“যা আমি মানুষ হিসেবে করতে অক্ষম, অর্থাৎ আমার ব্যক্তিগত মেধা দিয়ে করতে অক্ষম, সেটা টাকা দিয়ে আমি করিয়ে নিতে পারি। সুতরাং টাকা আমাদের মেধাশক্তিগুলোকে পর্যন্ত… তাদের বিপরীতে পরিণত করতে পারে, অক্ষমকে সক্ষম করতে পারে। আমার যদি কিছু খেতে ইচ্ছে হয় অথবা গাড়িতে ভ্রমণ করার ইচ্ছা হয়… টাকা তবে সে খাবার ও গাড়িকে এনে হাজির করতে পারে। অর্থাৎ টাকা আমাদের ইচ্ছাগুলোকে কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে। তাদেরকে কল্পিত অস্তিত্ব থেকে বাস্তব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্বে অনুবাদ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় টাকাই হচ্ছে প্রকৃত সৃজনীমূলক শক্তি।”[৪]
শিল্প যুগের শুরুতে মূলত বুর্জোয়ারা টাকাকেই সবকিছুর মাপকাঠি বানিয়েছিলো। আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ থেকে সামন্ত সমাজ পর্যন্ত মানুষকে সমস্ত দার্শনিকরাই বলেছেন সমাজবদ্ধ সামাজিক জীব। কিন্তু বুর্জোয়ার উৎপত্তি হবার সাথে সাথে প্রয়োজন পড়লো মানুষের সামাজিক পরিচয় ভুলিয়ে দেবার। প্রয়োজন পড়লো মানুষকে এমন এক পরিচয়ে পরিচিত ও উপস্থাপিত করানোর যেখানে সে একক, একা, নৃশংস। মানুষকে দেখানোর প্রয়োজন পড়লো এক ব্যক্তিবাদী সমাজবিচ্ছিন্ন জন্তুরূপে। দার্শনিক টমাস হবসের (১৫৮৮-১৬৭৯) জবানিতে বুর্জোয়ারা মানুষকে নেকড়ের মতো হিংস্র, লোভি, নোংরা পশু হিসেবে সর্বপ্রথম উপস্থিত করে।[৫] মুদ্রাঅলা মানুষকে শেকসপীয়ারও পশুই মনে করতেন, সব ধর্ম প্রবর্তকেরাই টাকা ও স্বর্ণকে শয়তানের বিষ্ঠা বলেছেন।
মুদ্রা যতদিন শ্রমের মাপকাঠি থাকবে ততদিন শোষণ থাকবে। শ্রমের বিনিময় মাপকাঠি টাকাকে উৎখাত করার চেষ্টা হতে পারে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সবচেয়ে আনন্দময় লড়াই। মুদ্রা এবং মুনাফাহীন সমাজই হবে প্রকৃত মানুষের সমাজ। কিন্তু বুর্জোয়ার কাছে নীতিবোধ বলে কিছু নেই। মুদ্রা ও মুনাফাই তার কাছে একমাত্র কোরান, বেদ, বাইবেল, ত্রিপিটক। এই কারণেই টি. জে. ডানিং-এর মত উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস লিখেছেন,
“যথেষ্ট মুনাফার ক্ষেত্রে পুঁজি ভারি সাহসী। সুনিশ্চিত শতকরা দশে পুঁজি যে কোনো জায়গায় পুঁজির নিয়োগ সম্ভব করবে; সুনিশ্চিত শতকরা কুড়িতে সৃষ্টি হবে আগ্রহ; সুনিশ্চিত শতকরা পঞ্চাশে তার ঔদ্বত্ত্য সীমা ছাড়াবে, শতকরা একশোয় তা সমস্ত মানবিক নিয়ম পদদলিত করতে প্রস্তুত থাকবে; শতকরা ৩০০ এমন অপরাধ নেই যাতে সে কুণ্ঠিত, এমন ঝুঁকি নেই যা সে নেবে না, এমনকি পুঁজির মালিকের ফাঁসি হতে পারে জেনেও ছুটবে লাভের অদম্য লালসায়। যদি হাঙ্গামা ও সংঘর্ষে মুনাফা আসে, তবে অবাধে দুয়েরই উসকানি দেবে সে। যা বলা হলও তা যথেষ্ট প্রমাণিত হয়ে গেছে চোরা-চালান ও ক্রীতদাস-বাণিজ্যে।”[৬]
কার্ল মার্কস পুঁজি গ্রন্থে টাকার সর্বাত্মক বিপ্লবী ক্ষমতার কথা বলতে গিয়ে ‘টিমন অফ এথেন্স’ নাটক থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। একই উদ্ধৃতি দিয়েছেন অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি ১৮৪৪ বইয়েও। শেকসপিয়ারের অর্থনৈতিক চিন্তাকে কার্ল মার্কস খুব গুরুত্ব দিতেন।
ব্যক্তিবাদ মানুষের ভেতরে লোভ আর ঘৃণার জন্ম দেয়। মুদ্রা, মুনাফা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকেই আসে ব্যক্তিবাদ। আর এই ব্যক্তিগত সম্পদকে মানুষকে বন্দি করেছে, ক্রীতদাস, ভূমিদাস, শ্রমদাসে রূপান্তরিত করেছে। ‘থলিতে টাকা ভরো’ হচ্ছে শয়তান ইয়াগোর[৭] উপদেশ। মুদ্রালোভি ও মুনাফাপন্থিদের শেকসপীয়র শয়তানরূপেই চিত্রিত করেছেন। মুনাফা সম্পর্কে মহাকবি শেকসপীয়ার ‘টিমন অফ এথেন্স’ নাটকে ফলকনব্রিজের জবানিতে বলাচ্ছেন,
“মুনাফা হলো জগতের দাঁড়িপাল্লার সবচেয়ে ভারি বাটখারা। এমনিতে পৃথিবীর ভারসাম্য মোটামুটি সঠিক, নিক্তির দুদিক মোটামুটি সমান ভারি। কিন্তু এই অতিরিক্তটুকু, এই জোচ্চুরির বাটখারাটি, সর্বগতির এই নিয়ন্তাটি, এই মুনাফাটিকে একদিকে চড়ালেই, জগত হারিয়ে ফেলে নিরপেক্ষতা, হারায় দিগ্বিদিক-জ্ঞান, হারায় লক্ষ্য, গতিপথ, উদ্দেশ্য। এহেন এক লালসা, এই মুনাফা, এই কুটনী, এই বেশ্যার দালাল …।”[৮]
ক্রোধকম্পিত শেকসপীয়ার যেন আর গালি খুঁজে পাচ্ছিলেন না গালাগালের অভিধান থেকে। মুদ্রা, মুনাফা ও ব্যক্তিবাদের বিপক্ষে ছিলো শেকসপীয়ারের যুদ্ধ। তার ‘রোমিও ও জুলিয়েট’ নাটকে আমরা দেখি রোমিও বিষ কিনছেন মান্তুয়া শহরে, এক দারিদ্র-জর্জরিত ওঝার কাছ থেকে, যদিও সে শহরে বিষ বিক্রয় নিষিদ্ধ। রোমিও স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে লোকটির দ্বিধা দেখে বলছেন,
“এই নাও, স্বর্ণমুদ্রা, আরো ভীষণ এক বিষ। এই ঘৃণ্য জগতে তোমার বেআইনি নিস্তেজ ঔষধের চেয়ে অনেক বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটায় এই সোনা। আমিই তোমায় বিষ বেচলাম, তুমি বেচোনি আমায়।”[৯]
স্বর্ণের ভূমিকা সম্পর্কে লেনিন যারপরনাই সচেতন ছিলেন। উল্লেখ করা খুব উচিত হবে যে তাঁর একটি নিবন্ধের নাম হচ্ছে স্বর্ণের তাৎপর্য যা তিনি ১৯২১ সালের ৫ নভেম্বর লিখেছিলেন। উক্ত নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে ১৯১৪-১৮ সালের প্রথম সাম্রাজ্যবাদী মহা যুদ্ধে “সোনার জন্য ১ কোটি লোককে হত্যা ও ৩ কোটি লোককে পঙ্গু করা হয়েছিল”। উক্ত লেখায় তিনি এক আশ্চর্য ভবিষৎবাণী করেন যা তাঁর অতুলনীয় সৃজনশক্তিকে তুলে ধরে। সেই লেখায় তিনি উল্লেখ করেন অদূর ভবিষ্যতের “এই ধরনেরই কোনো একটা যুদ্ধে খুব সম্ভবত ২ কোটি লোককে হত্যা ও ৬ কোটিকে পঙ্গু করার আয়োজন হচ্ছে” এবং প্রথম সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধের এই কথাটা যে লোকেরা “ভোলেনি তাদের পক্ষে সবচেয়ে ‘ন্যায্য’ ও সবচেয়ে চোখে আঙ্গুল দেয়া শিক্ষাপ্রদ”[১০] ব্যাপার হচ্ছে এটাই।
মুদ্রা সম্পর্কে সব বিপ্লবীরাই নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন। মুদ্রা আর মুনাফার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন মধ্যযুগের বেশিরভাগ বিদ্রোহীরা। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরুদ্ধে এশিয়াবাসী জ্বলে উঠেছে বহুবার। ব্যক্তিগত মালিকানাহীন ভূমি-ব্যবস্থাপনা ছিলো প্রাচ্য-স্বর্গের মৌলিক বুনিয়াদ। ফলে আধুনিক কালের ফ্রান্স-ব্রিটিশ বিরোধী সমস্ত প্রাচ্যবাসীর বিদ্রোহ মূলত ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রাচ্যবাসীর গৌরবের লড়াই। আধুনিক যুগের মহান বিপ্লবী চে গ্যেভারা বলেছেন,
“পুঁজিবাদি ব্যবস্থায় মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষের ধারণাতীত একটি নিষ্ঠুর নিয়মের বাঁধনে। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিটি সমাজের সমষ্টির সংগে বাঁধা থাকে একটি অদৃশ্য নাড়ির টানে_ টাকার নিয়মের বাঁধনে। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই তা সক্রিয় এবং নির্ধারিত করে জীবনের গতি ও ভাগ্যকে।”[১১]
টাকা সম্পর্কে ফিদেল ক্যাস্ত্রোও একই রকমের ধারনা পোষণ করেছেন। ফিদেলের কাছে টাকাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার লড়াইটা মুখ্য। তিনি বলেছেন,
“পুঁজিবাদ তার টাকাকে ব্যবহার করছে, আমরা সমাজতন্ত্রীরা এটাকে ছুঁড়ে ফেলব।”[১২]
টাকা এমনি এক বস্তু যা কাগজে তৈরি হলেও মোটেও নিরীহ কিছু নয়। টাকা নিয়ে বাঙালি কবিরাও ভেবেছেন এবং অনেক কবি ও লেখক টাকাকে ঘৃণা করেছেন। এরকম একজন লেখক হচ্ছেন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭ – ১৯১২)। তিনি বিষাদসিন্ধু উপন্যাসে টাকা সম্পর্কে যুক্তি দিয়ে আলোচনা করে বলছেন টাকা ‘মধুমাখা বিষসংযুক্ত’[১৩] যা অনবরত এই জগতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। টাকা নিয়ে বাংলা ভাষায় একটি কবিতা প্রচারিত হতে দেখা যায়। সেই কবিতায় দেখা যাচ্ছে কবি লিখছেন ‘টাকা, ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র মানুষের উপর’।[১৪]
মার্কসবাদ টাকাকে দীর্ঘমেয়াদে উচ্ছেদ করতে চেয়েছে। টাকার পুঁজি হবার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে চেয়েছে। মার্কসবাদীগণ মুদ্রার বিধ্বংসী কাল শেষ করবার জন্য সংগ্রাম করেছেন। জগতের সকল আশাবাদী মানুষ এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে শোষকরা শেষ হবেই, মুদ্রার কাল শেষ হবেই, পশুরা পরাজিত হবেই। পশুদের পরাজিত করার একমাত্র পথ প্রলেতারিয় বিপ্লব সম্পন্ন করা। প্রলেতারিয়েতের শ্রমশক্তি দ্বারা কোনো দেশের উৎপাদনী শক্তি বিকশিত হলেই কেবল মুদ্রাকে মানুষের পদানত ও উৎখাত করা সম্ভব। ‘শেষ পর্যন্ত যখন সমস্ত পুঁজি, সমস্ত উৎপাদন, সমস্ত বিনিময় জাতির হাতে একত্রিত হবে, তখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি আপনা থেকেই নিশ্চিহ্ন হবে, টাকা হয়ে দাঁড়াবে অপ্রয়োজনীয়, আর উৎপাদন এত বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষ এতো পরিবর্তিত হয়ে যাবে যে, পুরাতন সামাজিক সম্পর্কগুলোর শেষ নিদর্শনগুলোও খোলস ত্যাগ করে নতুন হয়ে উঠবে’।[১৫]
তথ্যসূত্র ও টীকা:
১. কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, ১৮৪৮, বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত, অনুচ্ছেদ ১৫।
২. দেখুন কার্ল মার্কস; অর্থনৈতিক ও দার্শনিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট, জাভেদ হুসেন অনূদিত, ১৮৪৪, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১১৮।
৩. কার্ল মার্কস; অর্থনৈতিক ও দার্শনিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট, জাভেদ হুসেন অনূদিত, ১৮৪৪, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১২০-১২১।
৪. কার্ল মার্কস; অর্থনৈতিক ও দার্শনিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট, জাভেদ হুসেন অনূদিত, ১৮৪৪, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১২১।
৫. Thomas Hobbes, Leviathan, McMaster University Archive, ch. XIII. Page 78; মূল ইংরেজি বাক্যটি হচ্ছে The life of man, solitary, poor, nasty, brutish, and short.
৬. টি. জে ডানিং-এর লেখা গ্রন্থ ‘ট্রেডস ইউনিয়নস এন্ড স্ট্রাইক্স’ থেকে মার্কস ব্যবহার করেছেন পুঁজি গ্রন্থের ৮ম অধ্যায়ে।
৭. ইয়াগো, উইলিয়াম শেকসপীয়ার রচিত ওথেলো নাটকের ব্যক্তিস্বতন্ত্রবাদী খল চরিত্র।
৮. উইলিয়াম শেকসপীয়ার; টিমন অফ এথেন্স; দ্বিতীয় অংক, প্রথম দৃশ্য, লাইন ৫৬১।
৯. উইলিয়াম শেকসপীয়ার, রোমিও ও জুলিয়েট; অংক পাঁচ, দৃশ্য ১।
১০. লেনিন, ভি আই; স্বর্ণের তাৎপর্য, ৫ নভেম্বর, ১৯২১, রচনা সংকলন, চার ভাগে সম্পূর্ণ, চতুর্থ ভাগ, পৃষ্ঠা ২৫৪।
১১. চে গ্যেভারা; সমাজতন্ত্র ও মানুষ; সুজিত সেন; লাতিন আমেরিকা ও কিউবা, বিপ্লবি সংগ্রামের ধারা; পুস্তক বিপণী; কোলকাতা; পৃষ্ঠা ২৮৯।
১২. ফিদেল ক্যাস্ত্রো, Fidel Castro in the Observer, 8 November 1964; ইংরেজি বাক্যটি এইরকমঃ ‘Capitalism is using its money; we socialists throw it away’.
১৩. মীর মশাররফ হোসেন, বিষাদ সিন্ধু, উদ্ধার পর্ব; লেখকের উদ্ধৃতিটি এরকম “সকল অনর্থের মূল ও কারণই তুমি। তোমার কী মোহিনীশক্তি! কী মধুমাখা বিষসংযুক্ত প্রেম, রাজা, প্রজা, ধনী, নির্ধন, যুবক, বৃদ্ধ, সকলেই তোমার জন্য ব্যস্ত,-মহাব্যস্ত-প্রাণ ওষ্ঠাগত। তোমারই জন্য-কেবলমাত্র তোমারই কারণে-কত জনে তীর, তরবারি, বন্দুক, বর্শা, গোলাগুলি অকাতরে বক্ষ পাতিয়া বুকে ধরিতেছে।”
১৪. কবিতাটি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র (১৯৫৬-১৯৯১) রচিত হিসেবে প্রচারিত, কবিতাটি হিমেল বরকত সম্পাদিত মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশিত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচনাবলীতে অগ্রন্থিত কবিতা হিসেবে সংকলিত। কবিতাটি এরকম “টাকা আন্দোলন চায় না। শ্লোগান চায় না।/টাকা সম্পদের সুষম বন্টন বোঝে না।/… টাকা গুলি ছোঁড়ে। দাবি আদায়ের মিছিলে/ লেলিয়ে দেয় শান্তিরক্ষা বাহিনী।/ টাকা বুটের তলায় পিষে মারে গুলিবিদ্ধ শেফালিকে।/ টাকা পুলিশের চোখ উপড়াতে বাধ্য করে।/ টাকা, ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র মানুষের উপর।”
১৫. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কমিউনিজমের নীতিমালা, আফজালুল বাসার অনূদিত, গণপ্রকাশন ঢাকা। লেখাটি হানিফ রাশেদীন সম্পাদিত প্রতিকথা ছোট কাগজের বর্ষ ৫ সংখ্যা ৮, ফেব্রুয়ারি ২০১৮-এর পৃষ্ঠা ৫-৯ এ প্রকাশিত।
রচনাকাল ২৫ নভেম্বর, ২০১২
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।