আকন্দ গাছের পরিচয় ও ১৩টি ঔষধি গুণাগুণ এবং উপকারিতা

আকন্দ

গণের বৈজ্ঞানিক নাম: Calotropis R. Br., Mem. Werner. Soc. 1: 39 (1811).
জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ/রাজ্য: Plantae বিভাগ: Angiosperms অবিন্যাসিত: Eudicots অবিন্যাসিত:Asterids বর্গ: Gentianales পরিবার: Apocynaceae গণ: Calotropis

ক্যালোট্রপিস হচ্ছে এপোসিনাসি পরিবারের একটি গণের নাম। এই গণে মাত্র তিনটি প্রজাতি রয়েছে যারা আকন্দ নামে পরিচিত। আকন্দ হচ্ছে এক প্রকারের ঝোপ ও গুল্ম জাতীয় মাঝারি ধরনের ওষধি গাছ। প্রজাতি তিনটির নাম হচ্ছে যথাক্রমে ১. বড় আকন্দ (বৈজ্ঞানিক নাম Calotropis gigantea), ২. ছোট পাতা আকন্দ (বৈজ্ঞানিক নাম: Calotropis procera) এবং ৩. মাঝারি আকন্দ (বৈজ্ঞানিক নাম: Calotropis acia).

গণের বিবরণ: ক্যালোট্রপিস বা আকন্দ বৃহৎ শাখাবিশিষ্ট গুল্ম বা ছােট বৃক্ষ। কাণ্ড ও শাখাসমূহ তুলার মত ঘন ক্ষুদ্র কোমল রােমাবৃত বা মসৃণ। পত্র প্রশস্ত, কিছুমাত্রায় পুরু ও পুরুষ্ট, অর্ধবৃন্তক বা মধ্যশিরার নিম্নে গ্রন্থি বিশিষ্ট পত্রবৃন্তক। সাইম ছত্রমঞ্জরী-সদৃশ বা উপ-সমভূমঞ্জরী, পর্বে একল। পুষ্প মধ্যম-আকৃতির, দৃষ্টি আকর্ষক। বৃতি খন্ড ডিম্বাকার, অভ্যন্তরে গ্রন্থিল, শীর্ষ সূক্ষ্মাগ্র। দলমণ্ডল উপচক্রাকার বা স্পষ্টতঃ ঘন্টাকৃতি, ফ্যাকাশে বেগুনি বা শুদ্ধ শুভ্র, মসৃণ, খন্ডের দৈর্ঘ্য সংযুক্ত অংশের ব্যাসার্ধের তুলনায় অনেক বেশী, ডিম্বাকার, মুকুলে প্রান্ত স্পর্শী। কিরীট একক, শল্ক পাঁচটি, মাংসল, পার্শ্বীয়ভাবে চাপা, পুংকেশরীয়। সমস্ত দৈর্ঘ্য জুড়ে লগ্ন, পৃষ্ঠীয়ভাবে তরীদলীয় । পরাগধানী একটি যােজক বিশিষ্ট যা অধােমুখী ঝিল্লিময় শীর্ষে পরিণত হয়েছে। পলিনিয়া আয়তাকার, বিলম্বী। প্রতি পরাগধানী কোষ্ঠে একল। গর্ভদণ্ড শীর্ষ পঞ্চকোণী। ফলিক্যাল খর্ব, পুরু ও মাংসল, নৌকা-আকৃতি। বীজ ডিম্বাকার, রােম অতি মােলায়েম ও কৌশিক।[১]

বাংলাদেশ ও ভারতে প্রধানত ছোট পাতা আকন্দ ও বড় আকন্দ প্রজাতি দুটি যথেষ্ট পাওয়া যায়। মাঝারি আকন্দটি কিছুটা কম পাওয়া যায়। বড় আকন্দের দুটি উপপ্রজাতি আছে, সেগুলো হচ্ছে শ্বেত আকন্দ ও রক্ত আকন্দ।

বড় আকন্দ এশিয়া ও আফ্রিকার এক ঔষধি গুল্ম

আকন্দের ওষুধী গুণঃ আকন্দ গাছের ব্যবহার চুলের রোগ, ব্যাথা এবং বিষনাশে বিশেষ কার্যকরী। দাদ ও টাকপড়া নিবারক। আকন্দের কষ তুলায় ভিজিয়ে লাগালে দাদের ব্যথা দুর করে এবং যোনিতে ধারণ করলে গর্ভপাত ঘটায়। আকন্দ বাত বেদনা নিবারক ও ফোলা অপসারক। আকন্দ পাতা ও হলুদের তৈরি বড়ি শোথ/ ফোলা/পান্ডু রোগ নাশক এবং এর রস কৃমি নাশক। গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা শুরু হলে ০.৬৫ গ্রাম পরিমাণ আকন্দ পোড়া ছাই পানিসহ পান করলে সঙ্গে সঙ্গে উপকার পাওয়া যায়। পেট কামড়ানি বা পেট জ্বালায় আকন্দ পাতার সোজা দিকে সরিষার তেল মাখিয়ে পাতাটি অল্প গরম করে পেটের উপর রাখলে বা ছেঁক দিলে পেট কামড়ানো বা পেট জ্বালা বন্ধ হয়। শোথ বা ফোলা রোগে আকন্দ বিশেষ উপকারী। ফোলাজনিত কারণে কোন স্থান ফুলে উঠলে আকন্দপাতা বেঁধে রাখলে উপকার পাওয়া যায়। শ্বাস কষ্টে আকন্দের শিকড়ের ছাল প্রথমে গুড়া করে তারপর আকন্দের আঠায় ভিজিয়ে রেখে পরে শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর তা চুরুট বানিয়ে ধুমপান করলে শ্বাস কষ্ট ভাল হয়। নিউমোনিয়াজনিত বেদনায় আকন্দ পাতার সোজা দিক ঘি মেখে ব্যথার জায়গায় বসিয়ে লবনের পুটলি দিয়ে ছেক দিলে উপকার পাওয়া যায়। হজম শক্তি কমে গেলে  ২ গ্রাম পরিমাণ শুকনো আকন্দ মুল গুড়া করে খেলে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়। আকন্দের ব্যবহার্য অংশ হলো ফুল, পাতা, শিকড় ও আঠা।[২]

আরো পড়ুন:  বন শুলফা উপকারী গুল্ম

লোকায়তিক ব্যবহার

১. হাঁপানি রোগে: ১৪ টি আকন্দ গাছের ফুলের, সাদা হলে ভাল হয়, মাঝখানের চৌকো মন্ডিত অংশটি নিতে হবে, তার সঙ্গে ২১টি গোলমরিচ দিয়ে একসঙ্গে বেটে ২১টি গুলি (বড়ি) করে শুকিয়ে নিতে হবে। প্রতিদিন সকালে একটি করে বড়ি খেতে হবে, খানিকক্ষণ বাদে একটু দুধ খেতে হবে, আর পথ্য হিসেবে এই ২১ দিন শুধু দুধ-ভাত, বা দুধ-রুটি খেয়ে থাকতে হবে, এটাতে অনেকের উপশম হয়ে যায়, তবে এটা কতটা বৈজ্ঞানিক সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে; তা ছাড়া হাঁপানি ও তার সঙ্গে হৃদযন্ত্রের দৌর্বল্য এসেছে বা আছে অথবা কার্ডিয়াক এ্যাজমা (Cardiac ashmaaaa) আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সমীচীন হবে না বলে মনে করি; তবে এটাও ঠিক, শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হতে থাকলেই যে হাঁপানি হয়েছে, এটা মনে করা ঠিক হবে না; যদি দেখা যায় কফের প্রবণতার সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট হতেই থাকে, তখনই চিন্তার ক্ষেত্র হয় এটা শ্বাসরোগ কিনা।

২. অজীর্ণ, অগ্নিমান্দ্য ও অম্লরোগ (এ্যাসিডিটি):  আকন্দ পাতা অর্ধশুক্ষ করে তার সঙ্গে সমান পরিমাণ সৈন্ধব লবণ মিশিয়ে, তবে এই মাত্রাটা অনেকটা ঠিক হতে হবে,যদি কাঁচা পাতার ৮ ভাগের ১ ভাগ অর্থাৎ কাঁচা ওজনের ১/৮ ওজন সৈন্ধব লবণ মিশিয়ে (এটা আসল হওয়া চাই, কারণ এখন প্রায় সব সৈন্ধবই নকল বিক্রি হচ্ছে) হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে মুখটা সারা (মাটির ঢাকনা) দিয়ে বন্ধ করে মাটি লেপে, শুকিয়ে, ঘুটের আগুনে পোড়া দিতে  হবে, তারপর ঐ কালো দ্রব্যটি বের করে একসঙ্গে গুড়ো করে নিতে হবে (একেই বলে অন্তর্ধূমে পোড়ানো)। এই চূর্ণ আধ গ্রাম মাত্রায় খাবারের পরে পানি দিয়ে খেতে হবে।

৩. হাঁপানি: আকন্দ গাছের মূলের ছাল শুকিয়ে চূর্ণ করে আকন্দের আঠা দিয়ে মেড়ে শুকিয়ে নিয়ে এটাকে বিড়ির পাতায় মুড়ে বিড়ি তৈরী করে সেটাকে ধরিয়ে তার ধোঁয়া টানলে হাঁপের টানের লাঘব হবে।

আরো পড়ুন:  জাগমদন এশিয়ায় জন্মানো ভেষজ গুণ সম্পন্ন গুল্ম

৪. অর্শের বলি: যাঁদের অর্শের বলি বাইরে বেরিয়ে রয়েছে, তাঁরা আকন্দ গাছের পাতার চূর্ণে আগুনে দিয়ে সেই ধূম লাগালে কয়েকদিনের মধ্যেই চুপসে যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে খসেও যায়। এ ব্যবস্থাটা আছে চরক সংহিতায়।

৫. ব্রণ ফাটাতে: আকন্দ গাছের পাতা দিয়ে ব্রণ চেপে বেধে রাখার উপদেশ, এ কথাটার উল্লেখ কিন্তু অথর্ববেদেই আছে।

৬. বিছা কামড়ের জ্বালায়: দষ্টস্থানে এর আঠা লাগালে যন্ত্রণার উপশম হয়, এমন কি পাতা বেটে লাগালেও কমে যায়।

৭. ঊরুস্তম্ভ রোগে: জলে অল্প তেল মিশিয়ে একটি পাতা সিদ্ধ করে, সেই জল ছেকে নিয়ে সেই ক্বাথ ২/৩ বারে একটু একটু করে খেলে ঊরুস্তম্ভ ধীরে ধীরে চুপসে যায়, আর ফোলে না বা পাকে না।

৮. দূষিত ক্ষতে: একটি আকন্দ পাতা জলে সিদ্ধ করে ঐ ক্বাথ দিয়ে ধুতে হবে , এটাতে পুঁজ তৈরি হওয়ার উৎস বন্ধ হবে।

৯. কুষ্ঠের প্রথমাবস্থায়: আকন্দের পাতা শুকিয়ে নিয়ে তার ৩ গ্রাম, ছাতিম (Alstonia Scholaris) ছাল ৫ গ্রাম একসঙ্গে ৫০০ মিলিলিটার জলে বা আধ সের আন্দাজ সিদ্ধ করে ১২৫ মিলিলিটার অর্থাৎ চতুর্থাংশ থাকতে নামিয়ে মোটা কাপড় দিয়ে ছেকে নিয়ে দুধের সঙ্গে ১ দিন অন্তর খেতে হবে এবং দুধ মিশানো পানি দিয়ে ধুতে হবে। এর দ্বারা কিছুদিনের মধ্যে রোগমুক্তি হবে।

১০. বুকে সর্দি বসায়: হাঁসফাঁস করতে হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে বুকে পুরনো ঘি মালিশ করে, আকন্দ পাতা গরম করে, সেই পাতা দিয়ে সেক দিলে সর্দি উঠে যায়।

১১. হেড়ে মাথা: অনেক সময় দেখা যায় শিশুর মাথাটা অস্বাভাবিক বড়, সে ক্ষেত্রে আকন্দ তুলোর বালিশ করে শোয়ালে মাথাটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যায়। এটা সাধারণতঃ এক বছর বয়সের মধ্যে ব্যবহার করা উচিত।

১২. সান্নিপাতিক দোষে: কানে পুজ, মাথা ভার, কান দিয়ে পানি গড়ানো, এক্ষেত্রে প্রাচীন মত হ’লো উর্ধ্ব জত্রুতে শ্লেষ্মার আধিক্য আর সেখানকার অগ্নিবল কম থাকা, এখানে ঐ আকন্দের তুলোর বালিশে শোয়ালে ঐ দোষটা আস্তে আস্তে চলে যায়।

আরো পড়ুন:  দিয়েং জুলকাহ পার্বত্যঞ্চলে জন্মানো ভেষজ ও শোভাবর্ধক গুল্ম

১৩. খোস ও একজিমায়: সরষের তেল আগুনে চড়িয়ে নিষ্ফেন হলে, আকন্দের আঠা তেলের সিকি ভাগ দিয়ে জ্বাল করতে হয়, তারপর নামাবার সময় একটু কাঁচা হলুদের রস দিয়ে নামাতে হবে। ঐ তেল লাগালে ঐ ধরনের রোগগুলি সেরে যায়।[২]

সতর্কীকরণ: আকন্দ গাছের সব অংশই বিষাক্ত। তাই ব্যবহারে সতর্ক হোন। অতিরিক্ত ব্যবহারে ক্ষতি হবে। ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. এম আতিকুর রহমান (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস”  আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ ৬ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৩৬। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

২.আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা,৫-৯।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Anup Sadi

Leave a Comment

error: Content is protected !!