ভূমিকা: নিম বা নিম্ব মেলিয়াসি পরিবারের এযারিডাক্টা গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রজাতি। এরা মাঝারি থেকে বৃহদাকার চিরহরিৎ থেকে অর্ধ পত্রঝরা বৃক্ষ।
বিবরণ: নিম গাছ ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। অল্প বয়স্ক বাকল মসৃণ, বয়ষ্ক কান্ডের বাকল বিদীর্ণ এবং স্তরে স্তরে সজ্জিত, পাটল বর্ণ বাদামী বা ধূসর, ভেতরের বাকল কমলা থেকে লাল, চটচটে এবং গন্ধময় রসযুক্ত। পল্লব ৪ থেকে ৮ মিমি লম্বা, উল্লম্ব এবং ফ্যাকাশে বায়ুরবিশিষ্ট, ক্ষতিগ্রস্থ হলে রসুনের মতো গন্ধ ছড়ায়।
পাতা একান্তর, সচূড় পক্ষল, ১৫ থেকে ৩৫ সেমি লম্বা, পত্রক ৪ থেকে ৭ জোড়া, কচি অবস্থায় লালচে, পত্রবৃন্ত ৩ থেকে ৭ সেমি লম্বা, প্রায় মসৃণ, নিচের পত্রকগুলো একান্তর এবং উপরের পত্রক প্রতিমুখ থেকে উপপ্রতিমুখ, ৫-৯ x ১.৫- ৩.৫ সেমি, কাস্তে আকৃতি-ভল্লাকার, প্রায় মসৃণ, শীর্ষ লম্বা দীর্ঘা, নিম্নপ্রান্ত কিছুটা বিস্তৃত, অত্যধিক অপ্রতিসম, তীক্ষ্ণ, কিনারা ক্রকচ, মধ্যশিরার উভয় পাশে পার্শ্বীয় শিরা ১২-১৬টি, স্থুল, ছড়ানো, পত্রকবৃন্ত ১-২ মিমি লম্বা।
পুষ্পমঞ্জরী কাক্ষিক, অসংখ্য পুষ্পবিশিষ্ট যৌগিক মঞ্জরী, অথবা ঝরে যাওয়া পাতার কক্ষে, সুগন্ধিময়, ৩০ সেমি পর্যন্ত লম্বা, অমসৃণ, পুষ্পমঞ্জরীর শাখাসমূহ ১৬ সেমি পর্যন্ত লম্বা, রুক্ষ্ম, উপশাখাগুলো পুনরায় ২ থেকে ৩ বার বিভাজিত হয়, শীর্ষ ১-৩টি পুষ্পবিশিষ্ট ক্ষুদ্রাকার স্তবক, সুক্ষ্ম রেশমিময়, মঞ্জরীপত্র এবং মঞ্জরীপত্রিকা ০.৫-১.০ মিমি লম্বা, ভল্লাকার, কমবেশী রোমশ, পুষ্পবৃন্তিকা ১.৫ মিমি (প্রায়) লম্বা, অপ্রকৃত পুষ্পবৃন্তিকার সংযোগস্থল স্ফীত, সুক্ষ্ম রোমশ। বৃতি ১ মিমি (প্রায়) লম্বা, রঙ্গনলাকার, খন্ডগুলো প্রান্ত-আচ্ছাদী, গোলাকৃতির, রোমশ, কিনারা সিলিয়াযুক্ত। পাপড়িগুলো রৈখিক, চমসাকার, ৪-৬ মিমি লম্বা, সাদা, প্রান্ত-আচ্ছাদী, উভয়পৃষ্ঠ রোমশ।
পুংকেশর ৮ থেকে ১০টি, পুংদন্ডগুলো সংযুক্ত হয়ে ১০টি অগ্রস্থ উপাঙ্গবিশিষ্ট একটি বেলানাকার পুংকেশরীয় নল গঠন করে, পরাগধানী ০.৬ মিমি (প্রায়) লম্বা, পাদলগ্ন, চক্র বলয়াকার, গর্ভাশয়ের পাদদেশে একাঙ্গীভূত। গর্ভাশয় ৩-প্রকোষ্ঠীয়, প্রতি প্রকোষ্ঠে ডিম্বক সাধারণত ২টি, মসৃণ অথবা রোমশ, গর্ভদন্ড ১টি, গর্ভমুণ্ড মুণ্ডাকার।
ফল ড্রুপ, ১-২ সেমি লম্বা, উপবৃত্তাকার, সবুজ, পরিপক্ক অবস্থায় হলুদ। বীজ নিরেট ডিম্বাকার, বীজত্বক পাতলা এবং ঝিল্লিময়। ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ৩০ (Styles and Vosa, 1971).
বংশ বিস্তার ও চাষাবাদ: বাড়ির আঙিনায় চাষ করা হয়, উন্মুক্ত জায়গা, ঝোপ-ঝাড় এবং ক্রান্তীয় তৃণভূমি। মার্চ থেকে জুলাই মাসে ফুল ও ফল ধরে। নিম গাছের বীজ দ্বারা নতুন চারা জন্মে।
বিস্তৃতি: আদি নিবাস মায়ানমার কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এশিয়া এবং আফ্রিকাতে ব্যাপক চাষ হয়, যেখানে ইহা ব্যাপকভাবে দেশীয়করণ হয়েছে। বাংলাদেশের সর্বত্র প্রজাতিটি লাগানো হয় এবং দেশীয়করণও হয়েছে।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:
ইহার বাকল তিক্ত স্বাদবিশিষ্ট, বলবর্ধক এবং অনিয়মিত ঋতুস্রাব ও সবিরাম জ্বরে উপকারী। ইহা থেকে মূল্যবান আঠা এবং ট্যানিন পাওয়া যায়। পাতা, বাকল এবং বীজ তৈল ম্যালেরিয়া, একজিমা, আমাশয় এবং আলসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এগুলো আবার দাউদের মতো চর্মরোগে একটি পরজীবীনাশক হিসেবে বিশেষ কার্যকরী। পোকামাকড়ের হাত থেকে বই-পুস্তক রক্ষার জন্য বহুকাল ধরে ইহার চাপ দেয়া পাতা ব্যবহৃত হয়ে আসছে, লিমোনয়েড (limonoid) এবং অ্যাজাডির্যাকটিন (azadirachtin) এর ন্যায় জীবানু প্রতিরোধক হিসেবে।
নীম বীজ গুড়ো করে কার্বোফুরান (carbofuran) এর সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করলে ধানের পাতা ফড়িং এবং টুংরো ভাইরাস দমনে ভাল কাজ হয়। নিমিডিয়ান (nimidiam) হচ্ছে ইহার বীজ তৈল থেকে পৃথকীকৃত একটি উপাদান যা ইঁদুরে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট গেঁটেবাত এবং ফোলায় একটি কার্যকরী যন্ত্রণাকর প্রদাহ লাঘবকারী। নীম তেলে কার্যকরী গর্ভনিরোধক গুণাবলীও বিদ্যমান। ইহার বীজে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ তেল বিদ্যমান যা প্রদীপ জ্বালাতে ব্যবহৃত হয় এবং লুব্রিকেন্ট হিসেবে জ্বালানীক্ষেত্রে উল্লেখয্যোগ্য ভূমিকা পালন করে। ইহার মধ্যত্বক মিথেন গ্যাস তৈরির ক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনাময় উৎস হতে পারে। সাবান, টুথপেষ্ট এবং লোশন তৈরীর একটি উপাদান হিসেবে নীম ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নিম গাছের ভেষজ গুনাগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন
জাতিতাত্বিক ব্যবহার: ভারতে লোধা উপজাতীরা জ্বরের চিকিৎসায় ১০ মিলি পরিমান ইহার শিকড়ের বাকলের ক্বাথ ব্যবহার করে এবং ইহার বীজ তেল চর্মরোগের চিকিৎসায় নিদানবৃত্ত দিয়ে থাকে। সাঁওতালরা ইহার পাতার ক্বাথ। পচনশীল ক্ষত পরিষ্কার করতে ব্যবহার করে, আর ওরাওন মহিলারা গর্ভনিরোধক হিসেবে প্রায় ২০ মিলি পরিমান ইহার বাকলের ক্বাথ ঋতুস্রাবের পরে সেবন করে থাকে (Pal and Jain, 1998). মালয় পেনিন সুলায় কচিপাতা এবং ফুল সিদ্ধ করে ভাতের সাথে খাওয়া হয়।
নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ইহা সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ রোপনযোগ্য প্রজাতি এবং ইহা খুঁটি ও জ্বালানীর জন্য ব্যবহৃত হয়। ঘুর্নিঝড় প্রতিরোধ করতে, ছায়া প্রদানকারী উদ্ভিদ হিসেবে এবং রাজপথ বিথি হিসেবে ব্যাপক হারে নিমগাছ লাগানো হচ্ছে। ৫০,০০০টি নিমগাছ বিশিষ্ট বিশ্বের বৃহত্তম বনায়ন সৌদি আরবে যা প্রতিবছর হজ্বব্রত পালনের জন্য আগত ২ মিলিয়ন বা তারও অধিক মুললিম তীর্থযাত্রীদের ছায়া প্রদানের জন্য লাগানো হয়েছে। ইহা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিকারক এবং অসংখ্য মূল্যবান উপজাতের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস।
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) নিম প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে নিম সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে ইহার বহুমুখী ব্যবহারের জন্য ব্যাপক পরিসরে বনায়ন করা দরকার।
তথ্যসূত্র:
১. এম অলিউর রহমান এবং শুক্লা রানী বসাক (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ০৯ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৯২-৯৪। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।