বিখ্যাত প্রলেতারীয় গান ‘আন্তর্জাতিকের’ (ওঠো জাগো অনশনবন্দী’, ইত্যাদি) রচয়িতা ফরাসী শ্রমিক-কবি ইউজিন পতিয়েরের মত্যুর পর থেকে পঁচিশ বছর পুরেছিল গত বছর ১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে।
সমস্ত ইউরোপীয় এবং অন্যান্য ভাষায় গানটির তরজমা হয়েছে। কোনো শ্রেণিসচেতন শ্রমিক যেকোনো দেশে গিয়ে পড়ুন, নিয়তি তাকে যেখানেই ফেলুক না কেন, নিজেকে তার যতই ভিনদেশী মনে হোক না কেন, ভাষা-ছাড়া, বন্ধুবান্ধব-ছাড়া, স্বদেশভূমি থেকে বহু, দূরে – তিনি কমরেড আর বন্ধুবান্ধব পেয়ে যেতে পারেন ‘আন্তর্জাতিকের’ সুপরিচিত সুর দিয়ে।
সমস্ত দেশের শ্রমিক তাদের সবচেয়ে আগুয়ান যোদ্ধার, প্রলেতারিয়ান কবির গানটিকে গ্রহণ করেছে, সেটাকে করে তুলেছে প্রলেতারিয়েতের পৃথিবী জোড়া গান।
এইভাবে, সমস্ত দেশের শ্রমিক এখন ইউজিন পতিয়েরের স্মৃতিকে সম্মান করে। তাঁর স্ত্রী আর মেয়ে এখনও বেঁচে আছেন, তাঁরা আছেন দারিদ্রের মধ্যে, যেভাবে সারা জীবন কাটিয়ে গেছেন ‘আন্তর্জাতিকের’ রচয়িতা। ১৮১৬ সালে ৪ঠা অক্টোবর প্যারিসে তাঁর জন্ম হয়। প্রথম গান রচনার সময়ে তাঁর বয়স ছিল ১৪, এই গানটির নাম ‘মুক্তি জিন্দাবাদ!’ ১৮৪৮ সালে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের মহাযুদ্ধে তিনি ছিলেন ব্যারিকেডের যোদ্ধা।
পতিয়েরের জন্ম হয়েছিল গরিব পরিবারে, সারা জীবন তিনি থেকে গিয়েছিলেন গরিব মানুষ, প্রলেতারিয়ান, তাঁর রুজি রোজগার হতো প্যাকারের কাজ করে এবং পরে কাপড়ে নকশা একে।
১৮৪০ সাল থেকে তিনি ফ্রান্সের জীবনের সমস্ত বড় ঘটনায় সাড়া দিয়েছেন সংগ্রামী গান বেধে, জাগিয়ে তুলেছেন অনগ্রসরদের চেতনা, শ্রমিকদের এক হতে ডাক দিয়েছেন, ধিক্কার দিয়েছেন বুর্জোয়াদের উপর এবং ফ্রান্সের বুর্জোয়া সরকারগুলির উপর।
মহান ‘প্যারিস কমিউনের’ (১৮৭১) দিনগুলিতে পতিয়ের তার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রদত্ত ৩,৬০০ ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন ৩,৩৫২টা। প্রথম প্রলেতারীয় সরকার কমিউনের সমস্ত কাজে তিনি অংশগ্রহণ করতেন।
কমিউনের পতনের ফলে পতিয়ের বাধ্য হয়ে পালিয়ে ইংলণ্ডে এবং পরে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গান ‘আন্তর্জাতিক’ রচিত হয়েছিল ১৮৭১ সালের জুন মাসে বলা যেতে পারে, মে মাসে রক্তাক্ত পরাজয়ের পরদিন…
কমিউন চূর্ণ হল — কিন্তু, পতিয়েরের ‘আন্তর্জাতিক’ তার ভাবভাবনা ছড়িয়েছে সারা পৃথিবীতে, আর এখন সেটা অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে প্রাণবন্ত।
১৮৭৬ সালে, নির্বাসনে পতিয়ের একটা কবিতা লিখেছিলেন ‘ফ্রান্সের মেহনতীদের উদ্দেশে আমেরিকার মেহনতীরা’। এতে তিনি বর্ণনা করেছিলেন পুঁজিবাদের জোয়াল-পরানো শ্রমিকদের জীবন, তাদের গরিবি, তাদের হাড়ভাঙা খাটুনি, তাদের উপর শোষণ এবং তাদের আদর্শের আগামী বিজয়ের প্রতি তাদের দৃঢ় আস্থা।
কমিউনের শুধু নয় বছর পরে পতিয়ের ফ্রান্সে ফিরেছিলেন, সেখানে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই যোগ দিয়েছিলেন শ্রমিক পার্টিতে। তাঁর রচনার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৪ সালে, আর ‘বৈপ্লবিক গীতিমালা’ নামে দ্বিতীয় খণ্ড বেরিয়েছিল ১৮৮৭ সালে।
এই শ্রমিক-কবির অন্যান্য কতকগুলি গান প্রকাশিত হয়েছিল তিনি মারা যাবার পরে।
১৮৮৭ সালে ৮ই নভেম্বর প্যারিসের শ্রমিকেরা ইউজিন পতিয়েরের মরদেহটিকে নিয়ে গিয়েছিল পিয়ের লাশেজ কবরখানায়, বধ-করা কমিউনার্ডদের গোর দেওয়া হয় সেখানে। লাল ঝাণ্ডা ছিনিয়ে নেবার চেষ্টায় পুলিস জমায়েতের উপর হিংস্র হামলা চালিয়েছিল। এই নাগরিক-অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শামিল হয়েছিল বিরাট জনসমষ্টি। চারদিক থেকে আওয়াজ উঠেছিল ‘পতিয়ের জিন্দাবাদ’!
পতিয়ের মারা গেলেন দারিদ্রদশার মধ্যে। কিন্তু, যে-স্মরণিক তিনি রেখে গেলেন সেটা যথার্থই মানুষের সৃষ্টির চেয়ে স্থায়ী। সর্বশ্রেষ্ঠ গানে-প্রচারকদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর প্রথম গান রচনার সময়ে শ্রমিক সমাজতন্ত্রীদের সংখ্যা ছিল বড়জোর কয়েক দশক। ইউজিন পতিয়েরের ঐতিহাসিক গানটিকে এখন জানে কোটি-কোটি প্রলেতারিয়ান।
২২ম খণ্ড, ২৭৩-২৭৪ পঃ
২ নং ‘প্রাভদা’,
৩ জানুয়ারি, ১৯১৩
স্বাক্ষর: ন, ল,[২]
টিকা:
১. ইউজিন পতিয়ের বা ওজেন পোতিয়ে বা ওজেন এদিন পোতিয়ে (৪ অক্টোবর, ১৮১৬ – ৬ নভেম্বর, ১৮৮৭) – ফরাসি শ্রমিক, কবি, প্রলেতারিয় সংগীত আন্তর্জাতিক-এর রচয়িতা।
২. লেখক অনুপ সাদি সম্পাদিত ভি. আই. লেনিনের প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য প্রসঙ্গে, টাঙ্গন ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ৫৯-৬০ থেকে এই লেখাটি রোদ্দুরে ডট কমে সংকলন করা হয়েছে।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।