গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল-ডেমোক্রাসির দুই রণকৌশল (১৯০৫) (ইংরেজি: Two Tactics of Social Democracy in the Social Revolution) ভি. আই. লেনিনের লিখিত একটি পুস্তক। তিনি এই পুস্তকটি লেখেন ১৯০৫ সালের জুন-জুলাই মাসে রুশ বলশেভিক পার্টির, তৎকালীন নাম ছিলো রুশ সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টি, তৃতীয় কংগ্রেস এবং একই সময়ে জেনেভায় আয়োজিত মেনশেভিক সম্মেলনের পরে। বইটি বের হয় জেনেভা থেকে রুশ সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক শ্রমিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংস্করণে; তখন লেনিন সেখানে থাকতেন এবং কাজ করতেন। সেই ১৯০৫ সালেই পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক এবং আলাদাভাবে মস্কো কমিটি কর্তৃক দশ হাজার সংখ্যায় বইখানা আবার পুনর্মুদ্রিত হয়। রাশিয়ায় বহু শহরে বেআইনিভাবে ছড়িয়ে দেয়া এই বইখানি আন্ডারগ্রাউন্ডে পার্টি এবং শ্রমিক চক্রগুলিতে অধ্যয়ন করা হতো। ১৯০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিটার্সবুর্গ প্রেস কমিটি বইখানায় প্রকাশিত ভাব-ভাবনাকে জার সরকারের বিরোধী অপরাধজনক কার্য বিবেচনা করে সেটিকে নিষিদ্ধ করেছিলো। মার্চ মাসে পিটার্সবুর্গ আদালত ঐ নিষেধাজ্ঞাটাকে অনুমোদন করে পুস্তিকাটিকে নষ্ট করবার হুকুম জারি করেছিল। তবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে—ভি. আই. লেনিনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রচনাটি নষ্ট করতে সমর্থ হয়নি সরকার।[১]
লেনিন নতুন নতুন পাদটীকা দিয়ে এই বইখানির বয়ানটাকে সম্পূরিত করেছিলেন এবং রচনাটিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তার ‘বারো বছরে’ নামে রচনা-সংগ্রহের প্রথম খণ্ডে, সেটি পিটার্সবুর্গে প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯০৭ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। রচনা-সংগ্রহের ভূমিকায় তিনি বইটির তাৎপর্য সম্বন্ধে লিখেছিলেন,
“এখানে প্রণালীবদ্ধভাবেই বিশদে বিবৃত হয়েছে মেনশেভিকদের সংগে বুনিয়াদী রণকৌশলগত পার্থক্যগুলি। লন্ডনে রুশ সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির (বলশেভিক) বসন্তকালীন তৃতীয় কংগ্রেস এবং জেনেভায় মেনশেভিক সম্মেলনের প্রস্তাবগুলি এইসব পার্থক্যকে চূড়ান্ত আকার দিয়েছে এবং প্রলেতারিয়েতের কর্তব্যের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের সমগ্র বুর্জোয়া বিপ্লবের মূল্যায়নে পার্থক্যগুলিকে মূলগত ভিন্নমুখীনতায় নিয়ে এসেছে।”[১]
মূলত বলশেভিক পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসের তাৎপর্য নিয়ে লেনিন এই বইটি লিখেছিলেন। এই রচনাটিতে তিনি সূচিত বিপ্লবের সমস্ত প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করেন ও পার্টির কর্তব্য নির্ধারণ করে দেন। এতে তিনি দেখান যে বিপ্লব ও তার চালিকা শক্তির ভিন্ন ভিন্ন বিচার করছে বলশেভিক এবং মেনশেভিকরা, শ্রমিক শ্রেণী ও পার্টির কর্তব্য দেখছে ভিন্ন চোখে, নির্ণয় করছে নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন রণকৌশল।
রাশিয়ার তখনকার ঘটমান বিপ্লবকে লেনিন ও বলশেভিকরা মনে করতেন নয়া গণতান্ত্রিক বা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক।[২] তার কাজ হলো ভূমিদাসপ্রথার জেরের অবসান, জারতন্ত্রের উৎসাদন, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা অর্জন। মার্কসবাদের ইতিহাসে লেনিনই প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুগে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য, তার চালিকা শক্তি ও পরিপ্রেক্ষিতের প্রশ্ন ব্যাখ্যা করেন। লেনিন মনে করতেন বুর্জোয়া বিপ্লবের পূর্ণ বিজয়ে প্রলেতারিয়েত আগ্রহী, কেননা তাতে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম কাছিয়ে আসবে ও তা সহজসাধ্য হবে। তাছাড়া, প্রলেতারিয়েতকেই হতে হবে বিপ্লবের প্রধান চালিকা শক্তি ও নেতা। প্রলেতারিয়েতের সহযোগী হওয়া উচিত কৃষকদের, জমিদারদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়া ও জারতন্ত্রের উচ্ছেদে তারা আগ্রহী। এইভাবে বিপ্লবের প্রসার নির্ভর করছিল তার মূল চালিকা শক্তি — প্রলেতারিয়েত ও কৃষককুলের ওপর। আর রুশ বুর্জোয়ার কথা ধরলে, তারা ছিল জারতন্ত্র সংরক্ষণের পক্ষে, নিজেদের শ্রেণি প্রকৃতির কারণেই তারা বিপ্লবী হতে পারত না।
প্রথম রুশ বিপ্লব তার চালিকা শক্তির দিক থেকে ছিল জনসাধারণধর্মী, — সর্বজনীন। আর সংগ্রাম ও পদ্ধতির দিক থেকে লেনিন তাকে চিহ্নিত করেছিলেন প্রলেতারতীয় বলে। তাতে অবলম্বিত হতো রাজনৈতিক ধর্মঘট ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মতো সংগ্রামের গণভিত্তিক রূপ। লেনিন দেখিয়ে দেন যে সশস্ত্র অভ্যুত্থানই হলো জারতন্ত্র উচ্ছেদের নির্ধারক উপায় যার মাধ্যমে প্রলেতারিয়েত ও কৃষকদের বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব এবং তার সংস্থা হওয়া চাই সাময়িক বৈপ্লবিক সরকারকে।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিবিকাশের তত্ত্ব রচনা লেনিনের একটা বড়ো কীর্তি। গোটা কৃষককুলের সঙ্গে একত্রে বুর্জোয়া বিপ্লবে বিজয় অর্জন করে প্রলেতারিয়েত শুধু তাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সংগ্রামের গতিপথে সে নিজের শক্তি সংগঠিত করে, দরিদ্র কৃষক ও শহুরে গরিবদের নিজের সঙ্গে জুটিয়ে আঘাত হানবে পুঁজিবাদের ওপর। এইভাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিবিকশিত হবে সমাজতান্ত্রিকে। লেনিনীয় তত্ত্ব খন্ডন করে রুশ মেনশেভিক ও পশ্চিম ইউরোপীয় সুবিধাবাদীদের নীতি, শহর ও গ্রামের আধা-প্রলেতারীয়দের পক্ষে যা সম্ভব সেটা তারা ছোটো করে দেখত। সুবিধাবাদীরা মনে করত যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে প্রলেতারিয়োত নামবে একা, সহযোগী ছাড়াই, তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটতে পারবে শুধু যখন প্রলেতারিয়েত হবে দেশের অধিকাংশ। এই প্রতিপাদনের ভ্রান্তি ও ক্ষতিকরতা লেনিন দেখিয়ে দেন। রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পুরোপুরি প্রমাণ করে লেনিনীয় তত্ত্বের সঠিকতা। গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল-ডেমোক্রাসির দুই রণকৌশল পুস্তকে লেনিন যেসকল ধ্যান-ধারণা বিকশিত করেছেন, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্যে সংগ্রামে তা সারা বিশ্বের জনগণের কাছে প্রভূত তাৎপর্য ধরে।
তথ্যসূত্র:
১. ভি. আই. লেনিন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল-ডেমোক্রাসির দুই রণকৌশল; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ১৩৫।
২. বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে পড়ুন অনুপ সাদির প্রবন্ধ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রসঙ্গে লেনিনবাদ।
৩. ভি. আই. লেনিন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল-ডেমোক্রাসির দুই রণকৌশল; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ৫-৭।
রচনাকাল ১ ডিসেম্বর, ২০১৭
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।