গণমঙ্গল বা সর্বহিত কাকে বলে

গণমঙ্গল বা সর্বহিত (ইংরেজি: Common Good) প্রত্যয়টি জনস্বার্থ, জনকল্যাণ, জাতির উন্নতি ইত্যাদি শব্দের প্রায় সমার্থক। সমানভাবে ব্যবহৃত এই শব্দগুলি খুব তেমন স্বচ্ছ নয়, তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র যেমন রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে এক একটির প্রয়ােগ অর্থবহ।

গণমঙ্গল বা সর্বহিত প্রত্যয়টি গ্রিসের প্রাচীন রাষ্ট্রদর্শন থেকে এসেছে। গ্রিসের কোনও পুররাষ্ট্রে বসবাস সূত্রেই তাদের অধিবাসীরা ব্যক্তিগত পরিচিতি লাভ করত। পুররাষ্ট্রের জয়-পরাজয়, ভাল-মন্দ ইত্যাদির সঙ্গে তার অধিবাসীদের সম্পর্ক ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে আবেগপূর্ণ ও অবিচ্ছিন্ন; সেই পটভূমিকায় লােকে নিজের পরিবার, বিষয় আশয় ও জীবনকে পর্যন্ত তুচ্ছ জ্ঞান করত। আরিস্তোতল তাই মনে করতেন যে সমস্ত গােষ্ঠীর লক্ষ্যই যদি সাধারণভাবে গণমঙ্গল হয় তা হলে সর্বোচ্চ সংগঠন হিসাবে রাষ্ট্র সর্বাত্মক মঙ্গল বিধায়ক। সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রই তাতে প্রাধান্য পায়, তার অংশবিশেষের ভাল-মন্দের প্রশ্ন গৌণ। স্বভাবতই তাতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অচল প্রতিপন্ন হয়।

বলা হয়ে থাকে যে সাধারণের মঙ্গলার্থে রাষ্ট্র বিরাজ করে। সেই দৃষ্টিতেই নাগরিকদের আনুগত্য ও আইনের যৌক্তিকতা দেখানাে হয়। গণমঙ্গলের তাগিদেই লােকে দেশের জন্য যুদ্ধে প্রাণ দেয়, আবার সর্বজনের স্বার্থে ছোঁয়াচে রোগীকে জনগণ থেকে পৃথক রাখা হয়। গণমঙ্গলে ব্যক্তিমানুষের মঙ্গল কতটা সেটাই হলো প্রশ্ন। ব্যক্তিমানুষকে পুরসমাজের মঙ্গলার্থে আত্মস্বার্থ বিসর্জন দেবার কথা বলা হয়। ব্যক্তিমানুষের যাবতীয় স্বার্থ ও মঙ্গল বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে দিয়ে চরিতার্থতা লাভ করে। সমাজের পরিবর্তে নিজের স্বার্থচিন্তা সেজন্য সমাজস্বার্থের পরিপন্থী এবং নীতিগতভাবে অসঙ্গত। আদর্শ নাগরিক সমাজস্বার্থকে নিজের স্বার্থের উপরে স্থান দেয়।

কারও কারও মতে গণমঙ্গলের দুটি দিক থাকা সঙ্গত: একটি হলো সাধারণভাবে পুরসমাজের মঙ্গল, এবং অপরটি সমাজের প্রতিজনের মঙ্গল। কথাটি সব ধরনের সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। রুশো সেজন্য গণঅভীপ্সা ও সকলের অভীপ্সাকে পৃথকভাবে বিচার করেন। তবে রুশো জনস্বার্থের নামে মানুষের নির্লজ্জ স্বার্থপর আচরণের নিন্দা করেন। টমাস হিল গ্রিনের মতে সমাজের জটিল ঐতিহাসিক বিবর্তনে গণমঙ্গল প্রত্যয়ের উদ্ভব এবং তাতে ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারিত হয়; লােকে নিজ জীবনের পরিপূর্তি খুঁজে পায় তাতে।

আরো পড়ুন:  অবকাশ যাপনে কমরেড লেনিন

গণমঙ্গল প্রসঙ্গে চর্চাসূত্রে ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রিক বাধ্যতার প্রশ্ন এসে পড়ে। টমাস হবস, জন লক, জেরেমি বেনথাম প্রমুখ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদীরা মনে করতেন যে প্রতিটি বিষয় ব্যক্তিমানুষের মঙ্গল বিধায়ক কি না সেটাই বিবেচ্য, গণমঙ্গলের প্রশ্ন গৌণ। অবশ্য লক ও বেনথাম হিতবাদী দৃষ্টিতে অধিক সংখ্যক মানুষের মঙ্গলবিধান চাইতেন।

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!