সহজাত ধারণা হচ্ছে মানুষের মনের ভেতরের জন্মগত ধারণা

সহজাত ধারণা বা সহজাত ভাব (ইংরেজি: Innate ideas বা Innatism) কে দর্শনে দাবি করা হয় মানুষের মনের ভেতরের জন্মগত ধারণা, যা অভিজ্ঞতার সাথে প্রাপ্ত বা সংকলিত ধারণার বিপরীত। ভাববাদী দর্শনের মতে মানুষের মনের ভাব বা ধারণা দুরকমের। ১. অভিজ্ঞতাগত ভাব; ২. জন্মগত বা সহজাত ভাব।

সহজাত বা জন্মগত ভাব বলতে ভাববাদী দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানীগণ মনে করে থাকেন যে, মানুষের মনের সব ভাব অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত নয়। তার মনে এমন কতকগুলি ভাব থাকে যেগুলি তার জন্মগত। এগুলিকে মানুষ ইন্দ্রিয়ানুভুতি বা অভিজ্ঞতা থেকে লাভ করতে পারে না। এঁদের মতে ধর্ম, নীতি, ন্যায়শাস্ত্র, অংকশাস্ত্র প্রভৃতি এরূপ জন্মগত ভাবের ভিত্তিতে গঠিত। সংখ্যা কিংবা ২+২=৪, ঈশ্বর, ধর্ম কিংবা ন্যায়শাস্ত্রের বিধান বা সময়, স্থান ইত্যাদির ধারণা মানুষের সহজাত ধারণা। সহজাত ধারণার অস্তিত্বে যারা বিশ্বাস করে তাদের মতে সহজাত ধারণা যেমন সার্বিক অর্থাৎ স্বভাবস্বীকৃত, তেমনি সেগুলি সত্য ও অনিবার্য। সত্য, কেননা মানুষের মন সেগুলি অসত্য বলে কল্পনা করতে পারে না। এগুলি অসত্য হলে বিশ্বজগতের অস্তিত্ব অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত বলেন ‘আমি চিন্তা করি’-এটি এমন একটি ধারণা যাকে মানুষ আদৌ সন্দেহ বা অস্বীকার করতে পারে না। কারণ, মানুষের সন্দেহ করাটাও একটা চিন্তার প্রকাশ। সন্দেহের অতীত এই ধারণা মানুষের জন্মগত। এই ধারণার মূল ভিত্তিতেই মানুষের জ্ঞানরাজ্য গঠিত। সহজাত ধারণা অনিবার্য। কারণ, সহজাত ধারণা ব্যতীত মানুষের জ্ঞানজগৎ অকল্পনীয় হয়ে পড়ে।

ভাবের উদ্ভব এবং প্রকারভেদ দর্শনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ ‘সহজাত ধারণাগুলিকে’ মানুষের মনের বিশ্লেষণমূলক ক্ষমতার এবং যুগ যুগব্যাপী অভিজ্ঞতার পরিফল বলে মনে করে থাকেন। এগুলিকে আদিকাল থেকে সহজাত বলে বলে স্বীকার করেন না। ভাবের উৎস সম্পর্কে অবৈজ্ঞানিক মনোভাবের কারণেই বহু পরীক্ষিত এবং বহু অভিজ্ঞতালব্ধ আপাত সহজ ও সন্দেহের অতীত ভাবকে মানুষ স্বতঃসিদ্ধ ও সহজাত বলে মনে করে। মানুষ ভাবের আকর। মানুষের সঙ্গে বস্তুজগতের নিয়ত প্রবাহমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের মাধ্যমেই মানুষের মনে বস্তু সম্পর্কে ভাবের সৃষ্টি হয়। বস্তুবাদীদের মতে সকল প্রকার ভাব সম্পর্কেই একথা প্রযোজ্য।

আরো পড়ুন:  বেনেদেত্তো ক্রোচে ছিলেন আধুনিককালের প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২২৬-২২৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!