মোগল বিরোধী গণ-অভ্যুত্থান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ক্রমাগত ফুসে উঠেছিল নানাভাবে। যদিও এইসব অভ্যুত্থানের প্রকৃতি ছিলো ভিন্ন-ভিন্ন এবং এগুলির মধ্যে সংযোগ কিংবা সময় ছিলো সামান্যই। এগুলির পেছনে চালক-শক্তি এবং লক্ষ্য ইত্যাদিও ছিলো বিভিন্ন বিচিত্র যেমন, উদাহরণস্বরূপ, বিদ্রোহী জাঠদের অধিকাংশ যেমন ছিলেন কৃষক তেমনই শিখ- ধর্মান্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন শহরের জনসাধারণ। আবার মরাঠা, রাজপুত ও শিখর। যেমন উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ও তাঁদের ধর্ম-বিশ্বাস অক্ষুন্ন রাখার সপক্ষে সংগ্রামকে অত্যন্ত গুরত্ব দিচ্ছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনে উদ্যোগী আফগানদের কাছে তেমনই এই ধর্মবিশ্বাসের সমস্যাটি ছিল অনেকখানি অবান্তর। বরং আফগানরা আওরঙ্গজেবের মতোই সুন্নিমতাবলম্বী মুসলমান ছিলেন। এই সমস্ত বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান ঘটছিল তখন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয় সচেতনার উন্মেষ ঘটার ফলে। আগ্রা ও দিল্লী অঞ্চলে জাঠ-কৃষকরা উচু হারে কর ধার্য করার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। তাঁদের নেতা গোলার অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁরা কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করলেন এবং আগ্রা থেকে দিল্লীগামী বাণিজ্য-ক্যারাভানপথটি দিলেন বন্ধ করে। মোগল-বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশিদিন যুদ্ধে পেরে ওঠা জাঠদের পক্ষে সম্ভব হল না, ফলে বীরোচিত প্রতিরোধ সত্ত্বেও পদস্তু হলেন তাঁরা। সৈনশিবিরে বন্দী করে রেখে গোকলাকে পরে আগ্রায় হত্যা করা হল।
১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে নারনোলে (ওই নামেরই অঞ্চলে অবস্থিত) সৎনামী (অর্থাৎ, সত্যিকার নামধারী)-সম্প্রদায় বিদ্রোহ করলেন। এই সম্প্রদায়ভুক্ত বিদ্রোহী জাঠরা আওরঙ্গজেবকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন। দশ হাজার মোগল-সৈন্যের এক বাহিনী এই অভ্যুত্থানকে দমন করে। কিন্তু জাঠদের অভ্যুত্থান ফের একবার ফুসে ওঠে ১৬৮৫ থেকে ১৬৯১ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে, আর তারপর আরও একবার তো মাথা তোলে চৌরামন নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ১৭০৪ খ্রীস্টাব্দে।
ওদিকে ইউসুফজাই, খট্টক কিংবা আফ্রিদি-সম্প্রদায়গুলির নেতৃত্বে আফগানদের বিদ্রোহ বারেবারে দেখা দিতে থাকে। কখনও-কখনও, যেমন ১৬৬৭ ও ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে, আফগানরা তাদের সংকীর্ণ গিরিবর্ত্নগুলির মধ্যে যুদ্ধ করে একেকটা গোটা মোগল-বাহিনীকেই ধংস করে দিতে সমর্থ হন। কিন্তু এরপর আওরঙ্গজেব নিজে তাঁর সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ গ্রহণ করেন এবং কিছু-কিছু, আফগান উপদলীয় নেতাকে উৎকোচ দিতে ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর আফগান সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে দিতে শুরু করেন। ফলে ১৬৭৬ খৃীষ্টাব্দের মধ্যেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায় আফগান উপজাতিদের মধ্যেকার ঐক্য। একমাত্র জনৈক একাগ্র দেশপ্রেমিক ও বিশিষ্ট কবি কুশল খাঁ মোগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান এবং খটুক-ভূখণ্ডে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর (১৬৮১ খ্রীস্টাব্দে) অভ্যন্তরীণ কলহবিবাদে ওই রাজ্যের পতন ঘটে। এমন কি আজও আফগানরা কবি ও বীর-নায়ক হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকেন কুশল খাঁ’র স্মৃতির উদ্দেশ্যে।
শিখরাও মোগলদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যান। ক্রমশ বেশি বেশি করে শিখদের দলে যোগ দিতে থাকেন পাঞ্জাবের জনসাধারণের বিভিন্ন অংশ। শিখসম্প্রদায়ের নবম গুরু তেগ বাহাদুর এই বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ করেন ও আনন্দপুরে এক দুর্গ স্থাপন করেন। পাঞ্জাবি কৃষকরাও সাড়া দিতে থাকেন তাঁর আহানে। কিন্তু ইতিমধ্যে মোগলদের হাতে ধরা পড়ে যান তিনি এবং ১৬৭৫ খীস্টাব্দে দিল্লীতে তাঁকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়। তাঁর পুত্র গরু গোবিন্দ সমগ্র শিখ-আন্দোলনকে পুনর্গঠিত করেন সামরিক শিক্ষার ভিত্তিতে, এর পর থেকে শিখ-আন্দোলন আর বণিক ও কারুশিল্পীদের সমর্থনপুষ্ট নিছক একটি সম্প্রদায়গত ধর্মীয় আন্দোলন হয়ে রইল না, তা গড়ে উঠতে লাগল বিদ্রোহী কৃষকদের সামন্ততন্ত্র-বিরোধী মতাদশভিত্তিক আন্দোলন হিসেবে। গোবিন্দ ঘোষণা করলেন যে অতঃপর ‘গুরু’র কর্তৃত্ব বিস্তৃত হবে গোটা শিখ-সম্প্রদায়ের (খালসা’র) ওপর। শিখদের কাছে দাবি করা হলো তাঁদের পূর্ববতী ‘জাতি’-পংক্তি ও ধমীয় আনুগত্যকে বর্জন করতে এবং স্বীকার করতে একমাত্র অন্যান্য শিখের সঙ্গে তাঁদের ঐক্য ও সংযুক্তিকে। শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্যে বিশেষ নিয়মকানুন প্রবর্তিত হলো এবং এর ফলে তাঁরা নির্ভুলভাবে হিন্দু ও মুসলমানদের থেকে পৃথক বলে চিহ্নিত হলেন। তাঁরা অতঃপর বিশেষ ধাঁচের পোশাক পরতে, লম্বা চুল রাখতে বিশেষ ধর্মীয় প্রতীকচিহ্ন ব্যবহার করতে শুরু করলেন।
উপরোক্ত এই সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করায় গুরু গোবিন্দ শিখ-সম্প্রদায়কে প্রবল শক্তিশালী এক সংগঠনে পরিণত করতে সক্ষম হলেন এবং এর ফলে এই সম্প্রদায় পাঞ্জাবে মোগল-রাজশক্তির বিরুদ্ধে গুরুতের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াল। শিখ-আন্দোলনের মূল ভিত্তি অবশ্য ছিলেন পাঞ্জাবিরাই, তবে ভারতের অন্য যেকোনো অঞ্চলের যে-কোনো লোকের পক্ষে বাধ্য ছিল না এ-আন্দোলনে যোগ দেয়ার। গুরু গোবিন্দ পাঞ্জাবে কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করলেন, পাহাড়ি অঞ্চলের ছোট-ছোট ‘রাজা’ ও ‘জমিদার’দের সঙ্গে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হলেন, তবু এ-সমস্ত সত্ত্বেও মোগল-সেনাবাহিনীগুলির আক্রমণ-প্রতিরোধে সক্ষম হলেন না শেষপর্যন্ত। দীর্ঘ ও দৃঢ়সংকল্প প্রবল প্রতিরোধের পর আনন্দপুরের পতন হলো, পালাতে বাধ্য হলেন গুরু গোবিন্দ। অতঃপর দীর্ঘদিন তাঁকে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে হয় এবং ১৭০৮ খীস্টাব্দে নিহত হন তিনি। কিন্তু এসমস্ত সত্ত্বেও শিখরা তাঁদের সংগ্রাম চালিয়ে যান।
মোগল-সেনাবাহিনীর মধ্যে যাঁরা ছিলেন সর্বদাই শক্তির প্রধান উৎস, সেই রাজপুতদের মধ্যেও এ-সময়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৬৭৮ খ্রীষ্টাব্দে আওরঙ্গজেবের দরবারের এক প্রাক্তন উচ্চপদস্তু ওমরাহ মাড়োয়ারের রাজার মৃত্যু ঘটলে ওই রাজ্যে মোগল-সম্রাটের পৃষ্ঠপোষিত ব্যক্তি এবং মৃত রাজার শিশুপুত্রের সমর্থকদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মাড়োয়ার রাজের এই শিশুপুত্র রাজ্যে মোগল-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের প্রতীকী নেতা হিসেবে গণ্য ছিলেন। ফলে মাড়োয়ারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করলেন আওরঙ্গজেব। এই সেনাবাহিনী যথারীতি রাজ্যটির গ্রামগুলি ধ্বংস করে দিল, শহরগুলি লুঠ করল এবং বিনষ্ট করে দিল হিন্দু মন্দিরগুলি। ঠিক ওই সময়ে মাড়োয়ারের প্রতিবেশী রাজপুত মেবাররাজ্যের রানা রাজসিংহও বিদ্রোহ করলেন। মেবারের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেব পাঠালেন পুত্র আকবর ও তাঁর সেনাবাহিনীকে, কিন্তু মেবার-সৈন্য আকবরের বাহিনীকে পদস্ত করল এবং রাজসিংহ আকবরের সঙ্গে এই গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন যে তিনি যদি তাঁর পিতাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করতে চেষ্টা করেন তাহলে রাজপুতরা সাহায্য করবেন তাঁকে। এরপর আকবর পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন কিন্তু ধূর্ত আওরঙ্গজেব আকবর ও রাজপুতদের মধ্যে মৈত্রীর সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিলেন। অতঃপর আকবর পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন মারাঠাদের।
মেবার-রাজ্যের সঙ্গে আওরঙ্গজেব এবার শান্তিচুক্তি করলেন। তবে মাড়োয়ার মোগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যায় ১৭০৯ খীস্টাব্দ পর্যন্ত। রাজপুতদের দুটি বৃহত্তম রাজ্যের প্রতিটির সামন্ততান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতা তাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে রাজপুতদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে মোগলবাহিনী কিছুটা দুর্বলই হয়ে পড়ে। কেননা রাজপুতানায় সেনাবাহিনীর বড় একটি অংশ থানাদারির কাজে রাখতে হওয়ায় সেই অংশটিকে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োগ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না মোগলদের পক্ষে।
তথ্যসূত্র:
১. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৩৫৫-৩৫৮।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।