ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সাত দফা গণদাবি উত্থাপন

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলা শহরের জয়নুল আবেদিন পার্কের বৈশাখী মঞ্চে গত ২৭ জুলাই ২০১৮ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ‘ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন’ উপলক্ষে দিনব্যাপি বিভিন্ন কর্মসূচি। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সারা দিনব্যাপি উক্ত অনুষ্ঠানে  আলোচনা,  আর্টক্যাম্প, চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা, সংগীত, কবিতা,  নৃত্য ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে রাত ১০টায় সমাপ্ত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে আলোচনা সভায় সকালে বক্তৃতা রেখেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান, পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আন্দোলন-পরউয়া’র সভাপতি ড. শাহাবুদ্দিন আহমেদ, রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ, ময়মনসিংহ জেলা সিপিবির সভাপতি অ্যাডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাত, লেখক স্বপন ধর, বিডি ক্লিনের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান ফয়সাল এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ময়মনসিংহ জেলার শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল।

বিকেলের আলোচনা সভায় নদী সুরক্ষায় গণদাবী উত্থাপন করেন ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ। এছাড়াও বক্তৃতা রেখেছেন ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র ইকরামুল হক টিটু। আলোচনা করেন কবি ও গণসংগীত শিল্পী কফিল আহমেদ এবং গবেষক অনুপ সাদি। বিকেলের আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ. এইচ. এম খালেকুজামান। আলোচনা শেষে পুরস্কার বিতরণ ও ব্যান্ড সংগীত পরিবেশন করে দৈত্যদল ও এফ মাইনরের গান।

বক্তারা আলোচনায় বলেন, সভায় বক্তারা বলেন, সবার আগে আমাদেরকে নদীকে বুঝতে হবে। আমাদের বর্তমান ও আগামী পৃথিবীকে সকল প্রাণের বাসযোগ্য রাখতে হলে নদীকে সুরক্ষা করতেই হবে। সকল ধরণের দখল, দূষণ ও নদী বিরোধী পদক্ষেপ রুখতে গণআন্দোলন তৈরি করতে হবে।

সভায় বক্তারা আরো বলেন নদীই প্রাণ, নদীই জীবন, আমাদের নদীগুলো সকল প্রাণ ও জীবনের আধার। নদীকে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করবার মাঝ দিয়েই নদী বিনাশী যাবতীয় জবর দখল আর অত্যাচার চলছে দুনিয়া জুড়ে। নদীর উপর সবচাইতে নিষ্ঠুরতম অত্যাচার আর জবর দখলের শিকার হচ্ছে আমাদের এই বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো। তন্মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি নদ আমাদের এই ব্রহ্মপুত্র অত্যাচার, অনাচারে জর্জরিত। এই নদকে বাঁচাতে হলে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের সকল মানুষকে আজ সর্বাত্মক প্রাণ প্রতিজ্ঞা নিয়ে একযোগে ভূমিকা নেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।

আরো পড়ুন:  সুরমা-মেঘনা নদী প্রণালী বাংলাদেশ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম নদী ব্যবস্থা

ব্রহ্মপুত্র নদকে রক্ষার লক্ষ্যে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষেরা জরুরী কয়েকটি গণদাবী নিয়ে ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষার সামাজিক সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু করার কথা বলা হয়। তারা আশা করেন মানুষের অংশগ্রহণ আর নদী রক্ষার নব-নব চিন্তার সমন্বয়ে নদী তথা সামগ্রিক প্রাণপ্রকৃতির এই আন্দোলন আরো স্পষ্টভাবে স্পষ্টতর হবে। ব্রহ্মপুত্র এবং অন্যান্য নদী রক্ষার উদ্দেশ্যে ‘ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন’ মোট সাত দফা কর্মসূচি আরম্ভ করে। সেসব কাজকে তারা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান।

প্রথম গণদাবী হিসেবে সভায় উল্লেখ করা হয়, নদীর স্বাভাবিক বয়ে চলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী সব কিছুকে সরানো। যেমন বাঁধ বা ড্যাম বিনির্মাণ, জলধারার বিঘ্ন ঘটায় এমন ব্রীজ বিনির্মাণ, জলধারার স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘ্ন ঘটানো বালু উত্তোলন _এই তিনটি প্রধান অন্তরায়কে দূর করবার জন্য নদীর প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই পরিস্কার নদীবান্ধব আইন এবং সেই লক্ষ্যে পাড়ে পাড়ে সর্বসাধারণের নদীবান্ধব সজাগ ভূমিকা নিশ্চিত করা দরকার। অন্যান্য ছয়টি গণদাবী নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষেরা মূলত কৃষিজীবি, মৎস্যজীবি। ব্রহ্মপুত্রের জলধারাকে কৃষি ও মৎস্যবান্ধব করার যথাযথ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অতীব জরুরী। সেই সাথে নদী নির্ভর এ দেশের লুপ্তপ্রায় আরো নানান পেশাজীবি, যেমন- মাঝিমাল্লা, মৃৎশিল্পী, তাঁতশিল্পী আবহমান বাংলার হারিয়ে যাওয়া নদীমাতৃক পেশাগুলিকে সমকালীন আর্থসামাজিক বাস্তবতার মূলধারায় ফিরিয়ে আনার বাস্তবিক উদ্যোগ, ভূমিকা গ্রহণ জরুরী।

ব্রহ্মপুত্র নদীর বুকে, পাড়ে পাড়ে জন্ম নেয়া জীব জন্তুর পাখপাখালিসহ জীববৈচিত্র্যের জন্য আবহমানকাল ধরে পাড়ে পাড়ে স্বাভাবিক ভাবে জন্ম নেয়া লুপ্ত ঝোপ-জঙ্গল বৃক্ষ-তরুলতার জন্মাবার অনুকূল পরিবেশ বিনির্মাণের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ব্রহ্মপুত্র’র গতিধারার পথে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে সচল করবার জন্য নদীবান্ধব বাস্তবিক ভূমিকা জরুরি। সেই সাথে ব্রহ্মপুত্র প্রণালীকে ইতোমধ্যে ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেশের অন্যসব নদী প্রবাহ বা প্রণালীর সাথে সংযোগের উদ্যোগ গ্রহণ । আন্তর্জাতিক নদী হিসাবে আজ ব্রহ্মপুত্র যে সকল প্রতিকূলতার জন্য তার স্বাভাবিক গতিধারা হারিয়ে আজ বিচ্ছিন্নভাবে মরতে বসেছে, সেই কারণগুলির বাস্তবিক অনুসন্ধান, চিহ্নিতকরণ এবং সেই গতিধারা ফিরিয়ে আনার জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক ভূমিকা গ্রহণ জরুরি।

আরো পড়ুন:  জলঢাকা নদী বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী

পৃথিবীতে নদীর মৃত্যু এবং দূষণের মারাত্মক কারণ নদী হন্তারক কারখানা ও শিল্প বর্জ্য বা ক্যামিক্যাল দূষণ । ব্রহ্মপুত্রকে কারখানা প্রযুক্তির ছোবল থেকে বাঁচাতে হলে নদীর আশেপাশে অথাৎ কারখানাজাত ধূয়া বা ক্যামিক্যাল- বর্জ্য যেনো কোনো প্রকারেই পৌছাতে বা মিশতে না পারে। সেই নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। মৎস্য চাষের নিমিত্তে পুকুরের ক্যামিক্যাল, পাড়ের কৃষি জমিতে ব্যবহৃত সার বা ক্যামিক্যাল নদী দূষণের বড় কারণ। সেই বিবেচনায় সজাগ ভূমিকা গ্রহণ জরুরি, যেনো নদীপাড়ের কৃষি জমিতেও কোনো ক্যামিক্যালজাত সার বয় ব্যবহারের উপর রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে । নদী জলের জন্য এ নদীজাত মাছের জন্য মারাত্মক হুমকি হচ্ছে পোড়া তেল মবিল ডিজেল । তাই, নদীতে ডিজেল, ইঞ্জিন চালিত নৌকা এবং পোড়া ডিজেল নিঃসৃত করে এমন যান্ত্রিক সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কঠোর সজাগ ভূমিকা নিতে হবে ।

প্লাস্টিকজাত পণ্যের অধিক ব্যবহারের কারণে প্রাণ-প্রকৃতি-নদী আজ হুমকির মুখে। প্লাস্টিকজাত দূষণ থেকে নদীকে রক্ষা করার যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে ।

দূরুহ এবং কঠিন হলেও ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষার জন্য উল্লেখিত উদ্যোগ, ভূমিকা গ্রহণের এই সামাজিক সাংস্কৃতিক, প্রকৃত প্রস্তাবে নদী রক্ষার একটি সামাজিক বিজ্ঞান ভিত্তিক এই উদ্যোগ নিতে আজ আমরা ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষেরা বাধ্য।

গণশপথ অনুষ্ঠানে উপরোক্ত সব উদ্যোগ ও ভূমিকা কার্যকর করবার জন্য ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষেরা পাড়ে পাড়ে ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা কমিউনিটি গড়ে তুলবার প্রস্তাব করেন। ‘ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন’-এর আবুল কালাম আল আজাদ এই সব প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!