পুঁজিপতি বামনদের কালে অমৃতের বিশ্বকে তৈরির ডাক দিয়ে যাই

অনেক, অজস্র, অগণন মানুষ দেখি; সড়কে, অভারব্রিজে, ফুটপাথে, হাটে, বন্দরে, ঘাটে; লঞ্চে-বাসে-ট্রেনে। শুধু মানুষ মানুষ আর মানুষ। অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশের বুর্জোয়া আর ক্ষুদে বুর্জোয়া মালিকদের কাছে মানুষ হলো পণ্য উৎপাদনের যন্ত্র আর পণ্য ক্রয়ের প্রাণী। এই বুর্জোয়া আর ক্ষুদে বুর্জোয়ারা কোনো নিয়ম নীতি শৃঙ্খলা মানে না; তারা সমস্ত আইনকেই ৪২০ বা ফোরটুয়েন্টি ধারায় ফেলে হাজারো অপরাধে সর্বোচ্চ দু’চার মাস জেলের শাস্তি ভোগ করে বীরের বেশে বেরিয়ে পড়ে। এই অনুন্নত পুঁজিবাদের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ নেতাদের কালে আমরা জন্মেছিলাম। এবং তার ফল হিসেবে দেখেছিলাম বামনদের মহামানব হিসেবে উপস্থাপনের নোংরা ব্যাধি।

কিন্তু এই কাপুরুষদের কালেও কিছু মানুষ জন্মেছিলেন যারা প্রাণপণে লড়াই করে এই রাষ্ট্রটিকে সমাজতন্ত্রসাম্যবাদের দিকে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। মনুষ্যসৃষ্ট সকল বৈষম্য দূর করার জন্য শুধু লড়াই চালাননি, প্রাচ্য স্বৈরাচার আর গণশত্রুদের অত্যাচারে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। সেসব মহানদের জন্য জীবনানন্দ দাশ ‘অনেক মৃত বিপ্লবী স্মরণে’ কবিতায় লিখেছিলেন,

পুড়ছে বাস, পুড়ছে মানুষ

“গভীর-গভীরতর তবুও জীবন _

নিজেদের দীনাত্মা ব্যক্তির মত মনে ক’রে ওরা

সকলের জন্যে সময়ের

সুন্দর, সীমিত আলো সঞ্চারিত ক’রে দিতে গিয়ে

প্রাণ দিয়েছিল।”[১]

এই জটিল সময়ে আমরা গাছে-নদীতে-আকাশে বিপ্লবীদের নাম লিখতে গিয়ে দেখেছি লড়াই, সংগ্রাম, যুদ্ধ এবং শ্রেণিযুদ্ধের বাইরে আর কোনো আলো নেই। প্রতিদিনই অপুষ্টি আর দারিদ্র্যের কবলে পড়ে কিছু গরীব মারা যায়। কিছু শ্রমিক কৃষক মারা যান প্রতিবাদ করতে গিয়ে। আরো কিছু মারা যান জাতিগত নিপীড়নে। তবুও কিছু মৃত্যু মনে দাগ কেটে যায়।

গত কয়েক বছরের ইতিহাসের দিকে একটু তাকাই। রানা প্লাজায় ধ্বস হয়েছিল, আগুন লেগেছিল তাজরিন গার্মেন্টসে। লাশ হয়েছিলেন হাজার হাজার। ২ মে, ২০১৩ তারিখে মাত্র একদিনের হরতাল দিয়েছিলেন, কিছু গণতন্ত্রী, সমাজ-গণতন্ত্রী, বামপন্থী, সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টরা। সাথে সাথেই প্রতিক্রিয়াশীল লিগ-বিএনপির সমর্থকেরা সেই হরতালের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছিল। আর সেই হরতালটি স্থগিত করেছিলেন সেই দলগুলোর নেতৃবৃন্দ। সেই হরতাল আর তারা ডাকলেন না। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ও ১৬ জানুয়ারি ২০১৩তে মোট ২টি হরতাল করেছিলেন গণতন্ত্রী, সমাজ-গণতন্ত্রী, বামপন্থী, সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টরা। সেই হরতাল দুটির বিরুদ্ধেও প্রতিক্রিয়াশীল লিগ-বিএনপি খুব চেঁচিয়েছিল। সময় গড়িয়ে গেল।

এছাড়াও হত্যা হয়েছে। যেমন ২০১৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসজুড়ে প্রতিদিন শ্রমিক-কৃষকেরা ৮-১০ জন করে মারা যাচ্ছে পুঁজির থাবার নিষ্ঠুর বলি হয়ে, সেই সময়ে ঘৃণার চাকা আর ককটেল আর হাতবোমা-পেট্রোলবোমায় মারা গেছে প্রায় দেড়শ জন।[২] দেশ হরতাল-অবরোধের ভিতর ছিলো। প্রতিক্রিয়াশীলরা খুব অস্বস্তিতে ছিলো। লিগের ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে গেছিল; বিএনপি জনগণ থেকে পুরো বিচ্ছিন্ন ছিলো। তাদের ভাড়াটে গুন্ডা ছাড়া জনগণের একাংশও লিগ-বিএনপির পক্ষে নেই। ফলে এই দ্বি-দলীয় স্বৈরতন্ত্র চালু রাখতে ভাড়াটে খুনি ও পুলিশকে তখন কাজে লাগিয়েছিলো লিগ-বিএনপি।

আরো পড়ুন:  প্রধান শত্রু নির্ণয়ের সমস্যা ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি

সে সময় জনগণের শক্তিগুলোকে ঘুরিয়ে দেয়া দরকার ছিল বুর্জোয়া-স্বৈরাচারী-প্রতিক্রিয়াশীল-গণশত্রু দ্বি-দলীয় লিগ-বিএনপির বুর্জোয়া একনায়কত্বের দিকে। আর সেই সুবিধাবাদী লেজুড়দের দিকে যারা একটু ক্ষমতার জন্য এই প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে মিলেছিল। হু জনগণের শক্তিগুলোকে কাজে লাগানো যায়নি। বিপ্লবীরা জনগণের বোধকে বহুবারই কাজে লাগাতে পারেননি।

শ্রমিক-কৃষক গত সাত দশক ধরে পুড়ছে। লাশ বাড়ছে।  এই মৃত্যুর মিছিলকে ঘুরিয়ে দিন প্রতিক্রিয়াশীল লিগ-বিএনপিকে উৎখাতের দিকে, নতুবা লাশ বাড়তেই থাকবে।

কিন্তু শ্রমিক-কৃষকের সেইরাম কমিউনিস্ট পাট্টি কই যারা ঘোষণা দেবেন শ্রমিক-কৃষকেরা সাম্রাজ্যবাদের পোষা বুর্জোয়া-স্বৈরাচারী-প্রতিক্রিয়াশীল-গণশত্রু দ্বি-দলীয় লিগ-বিএনপির ককটেল আর আগুন আর হাতবোমা-পেট্রোলবোমার খাদ্য হবে না। বরং এই শ্রমিক-কৃষকেরা উৎখাত করবে সেই প্রতিক্রিয়াশীলদের আস্তানাকেই। গড়ে তুলবে সর্বহারার নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব।  আমরা মনে করি স্বৈরাচারকে উৎখাতের সময় এখনো তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু সেই কাজের জন্য চাই ভুল ত্রুটিকে সরানোর গভীর বিশ্লেষণ।

আর জনগণ আগুনে পুড়ছে। … … ১৯৭২ সাল থেকে বৃহত্তর বাম ঐক্য করে কার্যকরী প্রতিরোধ বামপন্থিরা গড়ে না তোলার কারণে দেশে পুরো ৭০ দশকে রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের সামান্যতম ভুলও আবার দেশের জনগণকে রক্তপাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। প্রতিক্রিয়াশীল লিগ-বিএনপি রক্তপাতের ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ক্ষমতায় যেতে ও ক্ষমতায় থাকতে চায়।

এই সন্ত্রাসের রাজত্বের ষড়যন্ত্রকে ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়ায় এখন কমিউনিস্টদের কাজ। আর সে- কাজে প্রধান বাধা দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ। শান্তি, নিরাপত্তা, খাদ্য ও কাজের দাবিতে কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, বামপন্থি, সমাজ-গণতন্ত্রী ও গণতন্ত্রীদের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কর্মসূচি, হরতাল বা তার চেয়েও কঠোর অন্য কোনো কর্মসূচি, দিয়ে তারা জনগণের মধ্যপন্থি অংশকে জয় করে নিতে পারে।

দৃশ্যমান কর্মসূচি কমিউনিস্টরা না দিলেও এ-পরিস্থিতিতে মানুষ মরতেই থাকবে, নিপীড়ন ও নির্যাতন চলমান থাকবে। কমিউনিস্টদের সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচিই প্রতিক্রিয়াশীল লিগ-বিএনপির সকল ষড়যন্ত্রকে রুখতে পারে।

মাঝেমাঝেই বাংলাদেশে ছাত্র সমাজ আন্দোলনে নামে, যেন ঘুম থেকে হটাত জেগে উঠা। এই ছাত্র সমাজ একটি নিপীড়নবিরোধী সাধারণ ছাত্রছাত্রীবৃন্দ ব্যানার নিয়ে আন্দোলন করেছে। মূলত ২০০০ সালের দিক থেকেই আন্দোলনগুলি হচ্ছে নির্যাতন ও নিপীড়নবিরোধী সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ব্যানারে। এই দীর্ঘ সময় আন্দোলন হলেও তাতে নিপীড়ন নির্যাতন শেষ হয়নি। একটা অস্পষ্ট ব্যানার দীর্ঘদিন ধরে চলছে।

আরো পড়ুন:  তদবির কাকে বলে

স্বতস্ফুর্তা যতদুর সম্ভব বাদ দেয়া দরকার। আবার জনগণকেও শিক্ষিত করা দরকার। এই সাধারণ নামীয় ভবদীয় ছাত্রছাত্রিরা আন্দোলনের সময় প্রকৃতপক্ষে সুবিধাবাদী পজিশন নেয়। এই রোগটা জন্মেছে, যতদিন থেকে মধ্যবিত্তরা রাজনীতিকে খারাপ বলছে ততদিন থেকে। মধ্যবিত্তদের বিকাশ মূলত একাত্তর পরবর্তী ঘটনা। এই মধ্যবিত্তরা তাঁদের সন্তানদের শিখিয়েছে রাজনীতি সামগ্রিক এবং সব রাজনীতিই খারাপ। যে মধ্যবিত্ত জন্মেছে শ্রমিক ও কৃষকের রক্তের উপর। সেই মধ্যবিত্ত যে শ্রমিক ও কৃষকের মুক্তির রাজনীতি, সেই কমিউনিস্ট রাজনীতিকেও খারাপ বলেছে তা মূলত তাঁদের দোদুল্যমান শ্রেণিচরিত্রের কারণেই। মূলত ১৯৯০ পরবর্তীকালে এই প্রবণতার জন্ম।

সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা মূলত কেন্দ্রীকতা ও শৃঙ্খলা মানতে চায় না, এখন বিপদে পড়েছে তাই মিছিলে এসেছে। আন্দোলন শেষ হলেই আবার কমিউনিস্ট ও বামদেরকে গালিগালাজ করার সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একটি বিশাল অংশ এসেছে মধ্যবিত্ত ক্ষুদে মালিকানানির্ভর পরজীবী পরিবার থেকে। ফলে তাদের ভেতরে একটি বামবিরোধী মনোভাব আছে। জাতীয় রাজনীতিতে সুশীল এবং ছাত্র রাজনীতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভূমিকার রূপটি একই ধরনের। ২০০০ সালের পর থেকে বিশ্ববিবিদ্যালয়ের সব আন্দোলন বামপন্থিদের নেতৃত্বে হচ্ছে, এইটা সাধারণ ছাত্রছাত্রিদের মেনে নেবার আহ্বান কমিউনিস্টদের বারবার জানানো দরকার।

আবার গত ছয়-সাত দশকে মধ্যবিত্তরা যেহেতু অজস্রে সার্টিফিকেটের মালিক হয়েছে, ফলে তারা শ্রমিক কৃষকদের চেয়ে অধিক জ্ঞানী, এরকম একটি ভুল চিন্তার কাদায় আটকে আছে। কিন্তু উৎপাদন সংগ্রাম এবং শ্রেণিসংগ্রাম ছাড়া যে কোনো শিক্ষাই অর্জন করা যায় না এটিও তারা মানতে নারাজ। ফলে শ্রমিক এবং কৃষকগণই যে সবার শিক্ষক এই সত্যও এই পরজীবী মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের একটি বিশাল অংশ মানতে চায় না।

আমরা আশা করি মধ্যবিত্তদের অগ্রগামি অংশটি তাদের বোধকে শাণিত করবে, সত্যকে চিনতে শিখবে। সাধারণদের ভেতর যেই অংশটি মধ্যপন্থী আচরণ করছে, তারা তাদের ভুল শুধরে নেবে। আর কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা ঐ মধ্যপন্থিদেরকে বাম দিকে ঝোঁকাতে তাদের চেষ্টাটা জারি রাখাবে। নিপীড়নবিরোধী সাধারণ ছাত্রছাত্রী নামীয় মধ্যপন্থীদের উদারতাবাদী এই আন্দোলনটিকে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রূপান্তরের জন্য এটির নেতৃত্ব কমিউনিস্টদের কর্তৃত্বে আসা ছাড়া অন্য কোনোভাবে জনগণের মুক্তি সম্ভব নয়।

আরো পড়ুন:  শিবদাস ঘোষ ছিলেন মার্কসবাদ লেনিনবাদ বিকৃতিকারী এক সংশোধনবাদী সংগঠক

আমাদের ভরসা এইখানে যে এখনো আমরা আছি; কেউ না কেউ লড়ছে। লড়াই থেমে থাকে না; যতদিন শ্রেণি আছে, শ্রেণিশোষণ আছে, ততদিন শ্রেণিসংগ্রাম আছে। যত খারাপ সময় হোক না কেন মানুষ গান গাইবেই; “আমরা মানুষ ঢের ক্রুরতর অন্ধকূপ থেকে/ অধিক আয়ত চোখে তবু ঐ অমৃতের বিশ্বকে দেখেছি”।[৩] ঐ সাম্যের বিশ্ব ডাকছে; এ-পৃথিবী শ্রমিকের; তারাই এ-পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। সেই লড়াকু শ্রমিকেরা সবসময় আছেন; আর তাদের সাথে আছেন বিপ্লবীরা। আমরা আশাবাদী, কেননা; “জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে চূর্ণ হবে ভস্ম হবে/ আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে।”[৪]  

তথ্যসূত্র ও টিকাঃ

১. জীবনানন্দ দাশ; ‘অনেক মৃত বিপ্লবী স্মরণে’

২.  তন্ময়, নাহিদ. “পেট্রোল বোমায় আর কত করুণ মৃত্যু!” দৈনিক সমকাল, ২৩ মার্চ, ২০১৫, http://samakal.com/print/1503126396/print.

৩. জীবনানন্দ দাশ;  

৪. সমর সেন।

রচনাকাল নভেম্বর ডিসেম্বর জানুয়ারি ২০১৩-২০১৪

Leave a Comment

error: Content is protected !!