বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার

যে স্লোগানগুলি রাজনৈতিক অনিষ্টগুলিকে ‘অস্বীকার’ করে বা নিন্দা করে আর যেগুলি অর্থনৈতিক অনিষ্টগুলিকে নিন্দা করে পি কিয়েভস্কি তাদের মধ্যে তফাত বুঝতে পারেননি। তফাতটা হলো এই যে কতকগুলি অর্থনৈতিক অনিষ্ট পুঁজিবাদের মজ্জাগত, তা রাজনৈতিক কাঠামো যাই হোক না কেন, অর্থাৎ পুঁজিবাদের অবসান ছাড়া এই অর্থনৈতিক অনিষ্টগুলির অবসান অসম্ভব, এবং এই রকম অনিষ্ট দূর করা হয়েছে এমন একটিও উদাহরণ পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে রাজনৈতিক অনিষ্টগুলি গণতন্ত্রের বিচ্যুতি, যা কিনা অর্থনৈতিকভাবে বর্তমান ব্যবস্থার ভিত্তিতে বেশ সম্ভব। অর্থাৎ পুঁজিবাদের সময় এবং যা কিনা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে খণ্ড খণ্ডভাবে কার্যকরী করা হয়। যেমন একটি রাষ্ট্রে একটা অংশে কার্যকরী করা হলো আবার অপর একটি রাষ্ট্রে আর একটি অংশ কার্যকরী করা হলো। যে সাধারণ অবস্থায় গণতন্ত্র সাধারণভাবে সম্ভব লেখক আবার তা বুঝতে অক্ষম হয়েছেন।

বিবাহ বিচ্ছেদের প্রশ্নে ঐ একই কথা খাটে। পাঠককে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জাতীয় সমস্যার আলোচনার সময় এই একই প্রশ্ন প্রথম তুলেছিলেন রোজা লুক্সেমবার্গ। রাষ্ট্রের মধ্যে (প্রদেশে বা অঞ্চল ইত্যাদিতে) স্বায়ত্তশাসনের পক্ষ সমর্থনের সময় রোজা লুক্সেমবার্গ ঠিকই বলেছিলেন যে, আমরা সোস্যাল ডেমোক্রাটরা কেন্দ্রীকরণের পক্ষপাতী হিসাবে নিশ্চয়ই চাই যে, রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি (যার মধ্যে তিনি বিবাহ-বিচ্ছেদের আইন অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন), কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের দ্বারা, কেন্দ্রীয় লোকসভার দ্বারা নির্ধারিত হবে। বিবাহ বিচ্ছেদের প্রশ্নই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। যদি কেউ এই মুহুর্তেই বিবাহ বিচ্ছেদের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে তবে সে ডেমোক্রাট বা সোস্যালিস্ট নয়। এই স্বাধীনতা না থাকার মানেই হলো নির্যাতিত সম্প্রদায়—মেয়েদের উপর আরও একটি বোঝা চাপানো। যদিও এ কথা বোঝা মোটেই শক্ত নয় যে, স্ত্রীদের পক্ষে তাদের স্বামীদের পরিত্যাগ করবার অধিকারের স্বীকৃতি মানেই এ নয় যে, সব স্ত্রীদেরই স্বামী ত্যাগ করতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।

এ বিষয়ের পি কিয়েভস্কি ‘জবাব দিয়েছেন’: “এই অধিকারের (বিবাহ বিচ্ছেদের) কিই বা মূল্য যদি স্ত্রী এইসব ক্ষেত্রে (যখন স্ত্রী চায় তার স্বামীকে পরিত্যাগ করতে) তা কাজে না লাগাতে পারে ? অথবা এই অধিকার কাজে লাগানো যদি নির্ভর করে তৃতীয় ব্যক্তিদের ইচ্ছার উপর, বা তারা ও চেয়ে ক্ষতিকর, যদি তা নির্ভর করে ঐ স্ত্রীর ভাবী পাণিপ্রার্থীদের উপর ? আমরা কি তবে এইরকম অধিকার ঘোষণার জন্য পীড়াপীড়ি করবো ? কখনই না?”

আরো পড়ুন:  নারী শ্রমিকদের প্রতি

সাধারণভাবে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে যে তফাতটা কি এই যুক্তি তা বুঝবার অক্ষমতা প্রকাশ করে। পুঁজিবাদের আমলে সাধারণত সব সময়ই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নয়—নির্যাতিত শ্রেণীগুলি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ ‘কাজে লাগাতে পারে’ না।

পুঁজিবাদের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার কাজে লাগানো হয় না, কারণ নির্যাতিত সম্প্রদায় অর্থনৈতিকভাবে নিস্পিষ্ট থাকে। রাষ্ট্রব্যবস্থা যতই গণতান্ত্রিক হোক না কেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মেয়েরা থেকে যায় ‘পারিবারিক দাসীই’—শয়নকক্ষের দাসী, আতুড় ঘর এবং রান্নাঘরের দাসী। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমাদের বিচারক নির্বাচনের অধিকার, সরকারী কর্মচারী নির্বাচনের, শিক্ষক ও জুরি ইত্যাদি নির্বাচনের অধিকার কার্যকরী করা যায় না, কারণ শ্রমিক ও কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে পদদলিত থাকে। গণতান্ত্রিক রিপাবলিকের বেলাতেও এ কথা সত্য। আমাদের প্রোগ্রাম রিপাবালিকে জনগণের সার্বভৌমত্ব বলে ঘোষণা করে যদিও প্রত্যেক সোস্যাল ডেমোক্রাট একথা খুব ভালো করেই জানে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সবচেয়ে ডেমোক্রাটিক রিপাবলিকেও দেখা যায় বুর্জোয়ারা শুধু সরকারী কর্মচারীদের ঘুষ দিচেছ এবং সরকারের সঙ্গে ফাটকা বাজারের যোগাযোগ রয়েছে।

কেবলমাত্র যারা চিন্তা করতে একেবারেই অক্ষম অথবা যারা মার্কসবাদের সঙ্গে আদৌ পরিচিত নয় তারাই এই সিদ্ধান্তে আসবে । সুতরাং রিপাবলিক কোনো কাজেরই নয়, বিবাহ বিচ্ছেদের স্বাধীনতা কোনো কাজেরই নয়, গণতন্ত্র কোনো কাজেরই নয়, জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারও কোনো কাজেরই নয়, মার্কসবাদীরা জানে যে, গণতন্ত্রে শ্রেণি শোষণ দূর হয় না, কিন্তু শুধু শ্রেণীসংগ্রাম আরও স্পষ্ট হয়, বিস্তৃত হয়, আরও প্রকাশ্য ও তীব্রভাবে দেখা দেয়। এবং এই-ই আমরা চাই। বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার যত বেশি সম্পূর্ণ হবে মেয়েদের কাছে এ কথা ততো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে তাদের পারিবারিক দাসত্বের মূল ধনতন্ত্রই অধিকারের অভাব নয়। সরকারী কার্যপদ্ধতি যতই বেশি গণতান্ত্রিক হবে, শ্রমিকদের কাছেও একথা ততই বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে,  পুঁজিবাদই যত নষ্টের মূল, অধিকারের অভাব নয়। জাতিগুলির সমান অধিকার যতই সম্পূর্ণ হবে (এবং পৃথক হয়ে যাবার অধিকার ছাড়া তা সম্পূর্ণ হতে পারে না) নির্যাতিত জাতির শ্রমিকদের কাছে একথা স্পষ্টতর হয়ে উঠবে যে, আসলে সমস্যা পুঁজিবাদ, অধিকারের অভাব নয়, ইত্যাদি।

আরো পড়ুন:  কামিনী রায় কবিতায় তুলে এনেছেন ব্যর্থতা ও হতাশার ভেতর জীবনের জয়গান

আমরা আর একবার বলি : বারে বারে মার্কসবাদের অ-আ-ক-খ পুনরাবৃত্তি করা। কিছু সুখপ্রদ নয়, কিন্তু পি. কিয়েভস্কি যদি তা না জানেন তবে আমরা আর কি করতে পারি ?

আমার মনে পড়ে ‘প্যারিস গোলোসে’ অর্গানাইজেশন কমিটির একজন বৈদেশিক সেক্রেটারি সেমকোভস্কি ঠিক যেমন যুক্তি দেখিয়েছিলেন, বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয় পি. কিয়েভস্কির যুক্তি ঠিক সেইরকম। তাঁর যুক্তি ছিল: এ কথা ঠিকই যে, বিবাহ বিচ্ছেদ অধিকারের অর্থ সমস্ত স্ত্রীদের স্বামী ত্যাগ করার আমন্ত্রণ জানানো নয়, কিন্তু যদি আমরা একজন স্ত্রীকে, এই বলে বোঝাই যে, তার স্বামীটির চেয়ে আর সমস্ত স্বামীই ভালো, তবে তার অর্থ ঐ একই দাঁড়ায় !

এইভাবে তর্ক করতে করতে সেমকোভস্কি ভুলেই গিয়েছিলেন যে, শুধু খামখেয়ালি হলেই সোস্যালিস্ট ও গণতান্ত্রিক কর্তব্য লঙ্ঘন করা হয় না। সেমকোভস্কি যদি একজন স্ত্রীকে প্ররোচনা দিয়ে বোঝাতেন যে, তার স্বামীর চেয়ে আর সমস্ত স্বামীই ভালো, কেউ তাকে গণতান্ত্রিক কর্তব্য লঙ্ঘন করা বলতো না ; বড়জোর লোকে বলতো যে, প্রত্যেক বড় পার্টিতেই মাথা খারাপ লোক আছে। কিন্তু যদি সেমকোভস্কির মাথায় বিষয়টা সমর্থন করবার কথা ঢোকে এবং যে লোক বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারকে অস্বীকার করে, যেমন সে যদি তাকে পরিত্যাগ করবার কাজ থেকে তার স্ত্রীকে নিরত করবার জন্য আদালতে যায়, পুলিসের কাছে ও গীর্জায় যায়—এমন লোককে একজন ডেমোক্রাট বলে অভিহিত করে, তাহলে আমি নিশ্চয় বলতে পারি না, এমনকি বৈদেশিক সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে সেমকোভস্কির সহকর্মীদের অধিকাংশ তার কথা অস্বীকার করবে—যদিও তারা নিজেরাই বরং দুর্বল সোস্যালিস্ট।

সেমকোভস্কি এবং পি কিয়েভস্কি উভয়েই বিবাহ বিচ্ছেদ সম্বন্ধে ‘বলেছেন’ তাঁদের বুঝবার ত্রুটি প্রকাশ করেছেন, এবং এই প্রশ্নের মূল বিষয় এড়িয়ে গেছেন যে, সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকারের মতো—এর মধ্যে ব্যতিক্রম নেই বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কার্যকরী করা কঠিন, নেহাৎ মামুলি প্রথা বিশেষ সীমাবদ্ধ, আনুষ্ঠানিক এবং সংকীর্ণ। তবুও এই অধিকারকে যে অস্বীকার করে তাকে কোনো সম্মানিত সোস্যাল ডেমোক্র্যাটই ডেমোক্রাট বলে মনে করবে না, সোস্যালিস্টদের কথা তা ছেড়েই দিলাম। এই হলো আসল কথা। ডেমোক্রাসি বলতে যা বোঝায় তা হলো ‘অধিকারের’ ঘোষণা ও তা কাজে লাগানো যা কিনা ধনতন্ত্রের আমলে খুবই কম ও খুবই মামুলিভাবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যতক্ষণ না এই অধিকারগুলি ঘোষিত হচ্ছে যতক্ষণ না আশু অধিকারগুলির জন্য সংগ্রাম শুরু হচ্ছে, যতক্ষণ না এই সংগ্রামের ধারায় জনগণ শিক্ষিত হয়ে উঠছে, ততক্ষণ সমাজতন্ত্র অসম্ভব।[১]  

আরো পড়ুন:  ইউরোপের যুক্তরাষ্ট্র স্লোগান প্রসঙ্গে

লেনিন : ক্যারিকেচার অব মার্কসিজম, ১৯১৬

 টিকা:

১. লেনিনের এই প্রবন্ধটি কনক মুখোপাধ্যায় (সেপ্টেম্বর ২০০৬)। নারী মুক্তির প্রশ্নে, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ১০৩-১০৫ থেকে নেওয়া হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!