বাদাবন বা প্যারাবন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশের বনাঞ্চল

প্যারাবন বা বাদাবন মূলত বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশের বনাঞ্চলকে বলা হয়। এটি দক্ষিণ পশ্চিম অংশে সমুদ্রের কোল ঘেঁসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত। স্থানীয়রা একে বাদাবন বা বাদা বলে। এই অঞ্চল ঝড়ঝঞ্ঝা আর জলোচ্ছ্বাসকে প্রতিরোধ করে। এই অঞ্চলের গাছগুলো একটানা ২০ দিন নোনাপানির মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে। সমুদ্রের লবণাক্ততার মাত্রা  কতো তা আমাদের জানা। বর্তমান বিজ্ঞানীরা এসব গাছের বংশসার (Gene) থেকে নোনা সহ্য করার বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রয়োগ করছেন ধান ও অন্যান্য ফসলের জাতে। তাই সেসব প্রজাতি হয়ে উঠছে লবণ আর বন্যা সহিষ্ণু। বাদাবনের গাছের মতো হাওরের করচ (Millettia pinnata) ও ছোট হিজল (Barringtonia racemosa) দীর্ঘদিন জলাবদ্ধতায় টিকে থাকতে পারে। এ দুটো আসলে গৌণবাদা (Mangrove Associate) গাছ। অর্থাৎএরা লবণও সহ্য করতে পারে। সুতরাং ফসলের বন্যা সহিষ্ণু জাত তৈরিতে এদের বংশসার ভূমিকা পালন করে।

বাদাবন বা প্যারাবনের প্রাকৃতিক সম্পদ

যে গাছ জলাবদ্ধতায় ও লবণাক্ততায় বাঁচতে পারে কিন্তু বাদাবনের বাইরে জন্মায় সেই গাছগুলো  গৌণবাদা। আর যে গাছ বাদাবনের ভেতরেরই জন্মায় সেখানেই বংশবিস্তার করে সেই গাছগুলোই মুখ্যবাদা গাছ। সাধারণত ম্যানগ্রোভ বনে গাছপালার প্রজাতি সীমিত থাকে। এর প্রধানতম কারন এই অঞ্চলের পানির লবণাক্ততা। সমুদ্রের নোনাপানির জোয়ার ভাঁটার সাথে খাপ খাইয়ে যেসব প্রজাতি টিকে থাকতে সক্ষম তারাই এই বনে বসবাসের জন্য নির্ধারিত।

এই বনের গাছগুলো নদী বা সাগরের কিনারা ঘেঁসে থাকে। তাতে মাছের পোনা, কাঁকড়া,ব্যাঙ, চিংড়ি, শামুক-ঝিনুক, শৈবাল, সাপ ইত্যাদি আশ্রয় নেয়। এই গাছেরা উপকূল রক্ষা, চিংড়ি বা মাছের উৎপাদন, বাণিজ্যিক বা গৃহস্থালির কাঠ সরবরাহ ইত্যাদি কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের উপকূলীয় সামুদ্রিক পানি পৃথিবীর মধ্যে মৎস্য চাষের জন্য সমৃদ্ধ। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী এই চারটি নদীর পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে; এই নদীগুলো প্রচুর পুষ্টিকর দ্রব্য বহন করে যা উপকূলীয় অঞ্চলকে উর্বর করে।[১] এই বনে প্রতিদিন দুইবার জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়। এতে ছয় ইঞ্চি থেকে এক ফুট বা একটু বেশি প্লাবিত হয়। জোয়ারের পানির সাথে জৈব-অজৈব পদার্থের সাথে বয়ে আসে নানা ময়লা, পরিত্যাক্ত কোট, পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি। তারপর পানি নেমে গেলে মাটির উপর পড়ে থাকে পচা পাতা আর পচন-অপচনশীল জিনিসপত্র। পানি এখানে জমে থাকে না, কিন্তু প্রশ্ন হতে পারে গাছে তাহলে ঠেশমূল কেনো? নোনাপানি আর এইসব ময়লা যতোদূর ওঠে তার ওপর থেকে অক্সিজেনটা নেয়া তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ঝড় বাদলায় কাদাময় মাটি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য উর্ধ্বমূখী শেকড় আছে যাকে বলে শ্বাসমূল। বাদার লোকেরা একে বলে শুলো। এইসব মূলে এক ধরনের ছাঁকনির মতো হয়। এতে বর্জ্য, পাতা,ফল, ফলের খোসা, মৃত প্রাণী, ডালপালা ইত্যাদি আটকায়। পানিতে সেসব পচে মাটি ও মূল কালো হয়ে যায় তাই এ গাছকে কালো বাদা (Black Mangrove)বলে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ানরা ধূসর বাদাও (Grey Mangrove) বলে থাকে। এদের ফলগুলোর অনেকটা আমের আকৃতির মতো, তবে আকারে ভিন্ন।

এই অঞ্চলের গাছেরা যে লবণ শুষে নেয় তা সালোকসংশ্লেষণের সময় পাতার তলা দিয়ে বের করে দেয়। তাই বেশির ভাগই রয়ে যায়দেহের মধ্যে। কালো বাদা গাছের পাতার তলা নোনতা থাকে। তবে লাল বাদা থেকে এই প্রক্রিয়া একটু আলাদা।

বাদাবন বা প্যারাবনের ভূ-প্রকৃতি

বাদাবন মুলত অনেকগুলো উপকূলীয় চর বা দ্বীপের সমষ্টি। দ্বীপ যখন হয় তার মাঝখানটা একদম উঁচু; সেই উঁচু জায়গাটায় জোয়ার আসে। প্রতিদিন জোয়ার আসার কারণে পলি জমে না। মাটি তাই বেশ শক্ত থাকে। কোনো কোনো জায়গায় মাটি অনুর্বর হয়ে যায়। এসব ঘটনা এই অঞ্চলের জন্য সাধারণ; প্লাবিতও হওয়ার কারণে মাটিতে লবণ জমে যায় সেকারণে লবণ দূর করতে হয়। এটা সাদাবাদা (White Mangrove) গাছ করতে পারে। লবণাক্ততার কারণে গাছে ভেতর ধীরে ধীরে ফোঁপরা হয়ে যায়, মরে যায় গাছের ডগা। তাই বাদাগাছ তার স্বভাবগুণেই তৈরি করে নেয় শ্বাসমূল। সেই শ্বাসমূল খাটো হয় না। দেখতে অনেকটা ক্ষুদ্র হাতুড়ির মতো। আটা কুটা যন্ত্র হামান-দিস্তার দিস্তাটার মতো বা বলা যেতে পারে হাত বানানো মুঠিপিঠার মতো। কিরপা (Lumnitzera racemosa) বা সুন্দরীর (Heritiera fomes) গাছের দিকে তাকালে, দেখা যাবে তার চারপাশে সুন্দরভাবে সাধারণ গাছের মতোই ছড়িয়ে শ্বাসমূল। এদের ফল চ্যাপ্টা এবং সরু হয়, ওজনে ভীষণ হালকা আর বীজগুলোর ভিতরে শীত, গরম বা পানিতে যাতে নষ্ট হতে না পারে এজন্য অভিযোজন প্রক্রিয়ায় এই গাছ বংশবৃদ্ধি করে।

এই ধরণের বংশবৃদ্ধি ঘটে সাধারণত টিকে থাকার উদ্দেশ্যে। তবে উদ্ভিদ আর প্রাণীর এই ধরণের আচরণগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক কারণে হয় না, বরং এটা এক রকম প্রবৃত্তিমূলক। মনে রাখতে হবে যদি কোনো প্রজাতি টিকে থাকে তাহলে তার সন্তানদের টিকে রাখার নিশ্চিত কোনো উপায় বা কৌশল প্রজাতিটিকে জানতেহবে, তার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং নতুন নতুন এলাকা দখল করতে হবে। তাই অভিযোজন এক আর্শ্চয প্রক্রিয়া।

উদ্ভিদের প্রজাতি

এইভাবে বংশগতিই বাদাবনের গাছগুলোকে স্বাতন্ত্র্য করে দিয়েছে। Avicennia, Bruguiera, Ceriops, Conocarpus, Kandelia, Laguncularia, Lumnitzera, Nypa, RhizophoraSonneratia; এই নয়টি গণের (Genus) কোনো প্রজাতিই বাদাবনের বাইরে জন্মে টিকে থাকতে পারে না। তাদের টিকে থাকার অনুকূল পরিবেশ এই বাদাবনের ভেতর ছাড়া বাইরে নেই। এর মধ্যে Nypa গণের একটা মাত্র প্রজাতি আছে। যাকে আমরা সবাই চিনি তার নাম গোলপাতা। দেখতে গোল না হলেও নামে সে গোল। Conocarpus আর Laguncularia এই দুটি গণের ক্ষেত্রেও তাই। এই গণে যেসব প্রজাতি আছে তাদের পাতা দেখতে পুরোপুরি গোল না হলেও দেখে লম্বা বলা যাবে না। একেক প্রজাতির পাতার আকার দেখতে একেক আকৃতির হলেও বর্ণ সবুজ।

তবে কিছু কিছু গাছ বাদাবন থেকে একটু বিচ্যুত হয়েবাইয়ে জন্মায়। যেমন সুন্দরী (Heritiera fomes)। এই গাছ বাদাবনের গাছ হলেও, বাংলাদেশ ভারতে এর অনেক চাহিদা তেমনি অনেক দাম। বেশ সৌখিন একটি গাছ। তাই এটি সাদাবাদার মধ্যে পড়ে। সুন্দরী গাছের গণের (Genus) নাম Heritiera। এই গণে মোট আঠারো প্রজাতি (species) আছে। সাতটি প্রজাতি শুধুমাত্র বাদাবনে জন্মান। বাকি এগারোটি প্রজাতি উপকূলীয় নোনা পানিতে জন্মান। যে প্রজাতিগুলো বাদাবনের বাইরে জন্মায় তাদের গৌণ বাদার গাছ বলে পরিচিত। নীল টেংরাকাঁটা হচ্ছে এরকম একটি গৌণ বাদাগাছ।

এবার গড়শিঙ্গা কথায় আসা যাক। গড়শিঙ্গা Dolichandrone গণের গাছ। এই গণের তিনটি প্রজাতি উপকূলে জন্মায়। আর শুধুমাত্র গড়শিঙ্গা প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতে পারে বাদাবনের ভেতরে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Dolichandrone spathacea, সুতরাং বাদাগাছের মধ্যে এই প্রজাতির গাছ কম।

এছাড়াও এই সব প্রজাতির বাইরে আরো শত শত গাছ আছে। যারা একটু ঊর্বর জমি আর আলো বাতাস পেয়ে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠছে বাদাবনের মাটিতে। সুন্দরবনেই আছে এমন ৪৩৪ প্রজাতির গাছপালা। যেমন রয়েছে ধুন্দল (Xylocarpus granatum) এবং কেওড়া (Sonneratia apetala)। ঘাস ও গুল্মের মধ্যে Poresiaco aractata, Myriostachya wightiana, শন (Imperata cylindrical)], নল খাগড়া (Phragmites karka) ইত্যাদি।[১]

তথ্যসূত্র:

১. মো: আনোয়ারুল ইসলাম, পরিবেশ প্রসঙ্গ ও বাংলাদেশের পরিবেশ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ১৯৯২, পৃষ্ঠা, ৮১-৮৪।

আরো পড়ুন:  বায়ুরন্ধ্র বা লেন্টিসেল হচ্ছে একটি ঝাঁঝরের মতো টিস্যু যা কোষ দিয়ে গঠিত

Leave a Comment

error: Content is protected !!