নিরীক্ষকের পরামর্শ

এই পঙক্তিগুলি লিখছি ৮ অক্টোবর, সামান্যই আশা আছে যে তা ৯ তারিখে পেত্রগ্রাদের কমরেডদের হাতে পৌছবে। সম্ভবত বিলম্ব হবে, কেননা উত্তরাঞ্চলের সোভিয়েতগুলির কংগ্রেস নির্ধারিত হয়েছে ১০ অক্টোবর। তাহলেও আমার ‘নিরীক্ষকের পরামর্শ’[Advice of an Onlooker] পেশ করতে চেষ্টা করছি এই ঘটনাচক্রের জন্য যে পেত্রগ্রাদ ও গোটা অঞ্চলের শ্রমিক ও সৈনিকদের সম্ভাব্য অভিযান অচিরেই শুরু হবে, কিন্তু এখনো হয় নি।

সমস্ত ক্ষমতা যে সোভিয়েতগুলির হাতে আনতে হবে তা স্পষ্ট। তেমনি প্রত্যেক বলশেভিকের কাছে এটাও তর্কাতীত হওয়া উচিত যে সাধারণভাবে সারা বিশ্বের এবং বিশেষত যুধ্যমান দেশগুলির মেহনতী ও শোষিতদের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে রুশ-কৃষকদের পক্ষ থেকে বৈপ্লবিক-প্রলেতারীয় (অথবা বলশেভিক — এটা এখন একই ব্যাপার) ক্ষমতার প্রতি বিপুলতম সহানুভূতি এবং নিঃস্বাথ সমর্থন সুনিশ্চিত। এইসব বড়বেশি সুবিদিত এবং বহু আগেই প্রমাণিত সত্যগুলি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই।

আলোচনা করা দরকার সেটা যা সমস্ত কমরেডদের কাছে বড় একটা পুরো পরিষ্কার নয়, যথা: সোভিয়েতগুলির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরণ হলো এখন কার্যত সশস্ত্র অভ্যুত্থানেরই নামান্তর। মনে হবে এটা তো স্বতঃস্পষ্ট, কিন্তু এ-নিয়ে সবাই ভালভাবে ভাবেও নি এবং ভাবছেও না। এখন সশস্ত্র অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হবে বলশেভিকবাদের প্রধান স্লোগান (সমস্ত ক্ষমতা চাই সোভিয়েতগুলির হাতে) এবং সাধারণভাবে সমস্ত বৈপ্লবিক-প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রত্যাখ্যানের সামিল।

কিন্তু সশস্ত্র অভ্যুত্থান হলো রাজনৈতিক সংগ্রামের একটা বিশেষ প্রকারভেদ, বিশেষ নিয়মাদির তা অধীন, তা নিয়ে মন দিয়ে ভাবা দরকার। সশস্ত্র ‘অভ্যুত্থান যুদ্ধের মতোই একটা শিল্পকলা’ এই কথা লিখে কাল মার্কস এই সত্যটাকে আর্শ্চয স্পষ্টতায় প্রকাশ করেছেন।

এই বিদ্যার প্রধান নিয়মগুলির মধ্য থেকে মার্কস তুলে ধরেছেন:

১) অভ্যুত্থান নিয়ে কখনো খেলা করা উচিত নয়, সেটা শুরু করলে দৃঢ়ভাবে জেনে রাখা উচিত যে শেষ পর্যন্ত যেতে হবে।

২) নির্ধারক মুহুর্তে, নির্ধারক জায়গাগুলোতে শক্তির বড়ো রকমের ভারাধিক্য সমবেত করতে হবে, কেননা অন্যথায় সেরা প্রস্তুতি ও সংগঠন থাকায় শত্রু অভ্যুত্থানকারীদের নিশ্চিহ্ন করবে।

আরো পড়ুন:  সমাজ বলতে মানুষের তৈরি এমন সংগঠনকে বোঝায় যা যুগ হতে যুগে পরিবর্তিত হয়

৩) একবার অভ্যুত্থান শুরু হলে কাজ চালাতে হবে দৃঢ় সংকল্পে এবং অবশ্য-অবশ্যই, শর্তহীনভাবে চলে যেতে হবে আক্রমণে। ‘প্রতিরক্ষা হলো সশস্ত্ৰ অভ্যুত্থানের মৃত্যু’।

৪) চেষ্টা করতে হবে শত্রুর ওপর অপ্রত্যাশিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার, তার সৈন্য যখন বিক্ষিপ্ত সেই মুহুর্তটাই ধরতে হবে।

৫) যে করেই হোক ‘নৈতিক শ্রেষ্ঠতা’ বজায় রেখে সামান্য করে সাফল্য অর্জন করতে হবে প্রতিদিন (ব্যাপারটা যদি হয় একটা শহর নিয়ে, তাহলে বলা উচিত: প্রতি ঘণ্টায়)।

সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দিক থেকে মার্কস সমস্ত বিপ্লবের শিক্ষাকে এক করে দেখেছেন ‘ইতিহাসে বিপ্লবী রণকৌলের শ্রেষ্ঠতম ওস্তাদ দাঁতোঁ-র এই উক্তির সঙ্গে : স্পর্ধা, স্পর্ধা এবং পুনরপি স্পর্ধা’।

রাশিয়ায় এবং ১৯১৭ সালের অক্টোবরে এটা প্রয়োগের অর্থ: পেত্রগ্রাদের ওপর যুগপৎ, যথাসম্ভব অপ্রত্যাশিত ও ক্ষিপ্র আক্রমণ, অবশ্য-অবশ্যই বাইরে থেকে ও ভেতর থেকে, শ্রমিক পাড়াগুলি থেকে এবং ফিনল্যান্ড, রেভেল, ক্রনস্টাডট, গোটা নৌবাহিনীর অভিযান, আমাদের ‘বুর্জোয়া গার্ড’ বাহিনী (য়ুঙকার) আমাদের ‘ভাঁদে-র সৈন্যদল’ (কসাকদের একাংশ), ইত্যাদির ১৫ থেকে ২০ হাজারের (বেশিও হতে পারে) ওপর শক্তির বিপুল ভারাধিক্য অর্জন।

আমাদের প্রধান তিনটি শক্তি: নৌবহর, শ্রমিক এবং সৈন্যদের বাহিনীগুলি এমনভাবে সমন্বিত করতে হবে যাতে অবশ্য-অবশ্যই দখল করে এবং যে-কোন মূল্যে দখলে রাখে: ক) টেলিফোন, খ) টেলিগ্রাফ, গ) রেলস্টেশনগুলি, ঘ) সর্বাগ্রে সেতুগুলি।

অনতিবৃহৎ বাহিনীগুলির জন্য সবচেয়ে দৃঢ় সংকল্প লোকেদের (আমাদের ‘ঝটিতি সংগ্ৰামী’, এবং শ্রমিক যাবজন তথা সেরা নৌসৈন্যদের) বরাদ্দ করতে হবে সমস্ত গুরুত্বপুর্ণ জায়গা দখল করা এবং সমস্ত স্থানে, সমস্ত জরুরি অভিযানে অংশ নেবার জন্য যেমন:

পেত্রগ্রাদকে ঘেরাও করে বিচ্ছিন্ন করা আর নৌবহর, শ্রমিক এবং সৈন্যবাহিনীগুলির সমন্বিত আক্রমণে তা দখল করা — যে-কাজে প্রয়োজন শিলপকলার এবং তিনগুণ সাহসের।

শত্রুর ‘কেন্দ্রগুলিকে’ (য়ুঙকারদের বিদ্যালয়, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন, ইত্যাদি) আক্রমণ ও ঘেরাও করার জন্য অস্ত্র ও বোমা সহ সেরা শ্রমিকদের বাহিনী গঠন করতে হবে। তাদের জিগির হবে; সবাই মরব কিন্তু শত্রুকে ছাড়ব না।

আরো পড়ুন:  সমাজতান্ত্রিক সমাজের শ্রেণি কাঠামোর প্রকৃতি

আশা করব অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে পরিচালকেরা দাঁতোঁ ও মার্কসের মহান অনুজ্ঞাগুলি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করবেন। রুশ-বিপ্লব ও বিশ্ববিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করছে দুই-তিন দিনের সংগ্রামের ওপর ।

১৯১৭ সালের ৮ (২১) অক্টোবরে লিখিত

৩৪ খণ্ড ৩৮২-৩৮৪ পৃঃ

Leave a Comment

error: Content is protected !!