কোনো দুটি বিষয়, ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে হুবহু সাদৃশ্য বা মিল থাকলে তাদের অভিন্ন বলা হয়। ‘অভিন্নতা’ কথাটি তুলনার ক্ষেত্রে এবং বস্তুর ধারাবাহিকতা বুঝাবার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। ক এবং খ উভয়ের মধ্যে যদি একই গুণের অস্তিত্ব দেখা দেয় তবে ক এবং খ কে অভিন্ন বলা হবে।
কিন্তু বাস্তব জগতে আদৌ অভিন্নতা কল্পনা করা যায় কিনা এটি দর্শনের একটি প্রশ্ন। প্রাচীন গ্রিসের হিরাক্লিটাস এবং অন্যান্য বস্তুবাদী দার্শনিক থেকে শুরু করে আধুনিককালের বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মনে করেন যে, কোনো দুটি স্বতন্ত্র অস্তিত্বই অভিন্ন হতে পারে না। একই নদীতে কেউ দুবার নামতে পারে না, হেরাক্লিটাসের এরূপ উক্তিতে বস্তুজগতের নিয়মিত পরিবর্তনশীল প্রবাহের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কিছুকেই অপর কিছুর সঙ্গে তুলনা করে অভিন্ন বলা চলে না। কারণ ‘ক’ এবং ‘খ’ কে অভিন্ন বলার আগে তাদের উভয়ের চরিত্র পর্যায়ক্রমে পর্য্যবেক্ষণ করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তাদের সাদৃশ্য নিরূপণ করতে হবে।
বিশ্লেষণ করে সাদৃশ্য নিরূপণ এটি একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সমাধান করতে কিছু না কিছু সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু সময়ের ব্যবধান তুলিত বস্তুর মধ্যে নুতন পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। সে কারণে যারা তুলিত এবং যাদের সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত আমরা পরিশেষে গ্রহণ করি তারা একই সত্তা-এরূপ বলা যায় না। কেবল একাধিক বস্তুর মধ্যে অভিন্নতা আরোপের ক্ষেত্রে নয়। নির্দিষ্ট কোনো একটি ব্যক্তি বা বস্তুর উপরও অভিন্নতা আরোপ করা চলে না। সক্রেটিস ৪৬৯ খ্রি.পূ. জন্মগ্রহণ করে ৩৯৯ খৃ.পূ. এ মারা গিয়েছিলেন, এরূপ বলা কখনো সম্ভব নয়। কারণ, এরূপ বিবৃতির তাৎপর্য্য হচ্ছে এই যে, ৪৬৯ খৃ.পূর্বাব্দে যে সক্রেটিস জন্মগ্রহণ করেছিলেন, অভিন্নরূপে সে সক্রেটিস ৩৯৯ খৃস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কিন্তু চরমভাবে দেখতে গেলে ৪৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সক্রেটিস অভিন্নভাবে ৩৯৯ খৃস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন নি। এঁরা দুজন ভিন্ন ব্যক্তি।
পরিবর্তনের এই প্রবাহকে সর্বদা চরমভাবে গ্রহণ করলে, মানুষের পক্ষে পর্য্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত এই পর্যায়ে জ্ঞানের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ কারণে চরম অভিন্নতা যেমন অকল্পনীয়, তেমনি চরম ভিন্নতাও জ্ঞানের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। দর্শনে তাই অভিন্নতার বিধান বলতে চরম অভিন্নতার বদলে আপেক্ষিক অভিন্নতা বুঝায়। আপেক্ষিক অভিন্নতা তুলিত বস্তুর সাদৃশ্যকে সময় ও বিষয় নিরপেক্ষভাবে কল্পনা করে বিশেষ বস্তুর উপর প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে মনে করা হয় যে, ৪৬৯ খৃস্টপূর্বাব্দের সক্রেটিস ৩৯৯ খ্রি.পূর্বাব্দের সক্রেটিসের সঙ্গে চরমভাবে অভিন্ন না হলেও উভয়ের মধ্যে সাধারণ কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা রয়েছে এবং এ কারণে তাঁরা উভয়েই সক্রেটিস এ কথা বলা যায়। এবং এরূপ না বললে মানুষের পক্ষে বস্তুর জ্ঞান অর্জন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তিশাস্ত্রে অভিন্নতার বিধানের (ইংরেজি: Law of Identity) শর্ত হচ্ছে এই যে, একটি নির্দিষ্ট যুক্তির মধ্যে ব্যবহৃত ভাব বা পদকে একই অর্থে ব্যবহার করতে হবে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২১১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।