মৌল এবং অমৌল গুণ বা প্রাথমিক বা দ্বিতীয় পর্যায়িক স্বাতন্ত্র্য (ইংরেজি: Primary/secondary quality distinction) হচ্ছে বাস্তবের প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞানতত্ত্ব এবং অধিবিদ্যার একটি ধারণাগত পার্থক্য। বস্তুর গুণ কোনটি মৌল এবং কোনটি অমৌল, এই পার্থক্য বিশেষ করে ইংরেজ দার্শনিক জন লকের (১৬৩২-১৭০৪) রচনায় দেখা যায়। মানব উপলব্ধি সম্পর্কিত লকের রচনায় এটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, তবে গ্যালিলিও ও ডেকার্টসের মতো আগের চিন্তাবিদরাও একই রকম পার্থক্য তৈরি করেছিলেন।
লকের মতে আমরা বস্তুকে শক্ত, নরম, ছোট, বড়, নিরেট, শূন্য, লাল, নীল, গরম, ঠান্ডা, সুস্বাদযুক্ত, বিস্বাদযুক্ত বলে অভিহিত করি। এরূপ বর্ণনায় সব গুণকেই বস্তুর মধ্যে অস্তিত্বমান বলে মনে করা হয়। কিন্তু বস্তুর উপর আরোপিত সব গুণকে বস্তুর মধ্যে ব্যক্তির ইন্দ্রিয় নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বময় বিবেচনা করা যায় না।
লকের মতে যখন আমরা বস্তুকে শক্ত বা নিরেট বা গতিময় বা বিশেষ আকারবিশিষ্ট বলি তখন যথার্থই বস্তুর মধ্যে এই সমস্ত গুণের অস্তিত্ব দেখা যায়। কারণ এই সমস্ত গুণ ব্যক্তির দেখা না দেখার উপর নির্ভর করে না । এই সমস্ত গুণ ব্যক্তির প্রধান বা মৌল গুণ। কিন্তু একটি বস্তুকে যখন লাল বা সবুজ, সুস্বাদযুক্ত, সুগন্ধিযুক্ত প্রভৃতি বলা হয় তখন এই গুণগুলি বস্তুর মধ্যে অস্তিত্বময় থাকে না। এই গুণগুলির অস্তিত্ব নির্ভর করে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়াদির উপর। এ কারণে ব্যক্তির এরূপ ইন্দ্রিয় বা মননির্ভর গুণ হচ্ছে বস্তুর অমৌল গুণ।
লকের পূর্বে গেলিলিও, দেকার্ত, হবস প্রভৃতি দার্শনিকদের রচনাতেও বস্তুর গুণের মধ্যে এই রকম মৌল এবং অমৌল কিংবা প্রধান এবং অপ্রধানরূপ পার্থক্য নিরূপণের প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে বস্তুর গুণের মধ্যে এরূপ পৃথকীকরণ সম্ভব নয়। বস্তুর শক্তত্ব বস্তুর মধ্যে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বময় বলেও যেমন সেই গুণকে মানুষের অনুভব করতে হয়, তেমনি বস্তুটি লাল বললেও ‘লাল’ গুণ কেবল মনের সৃষ্টি নয়। বস্তুর সঙ্গে দেহের ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক এবং মনের অনুভবের মাধ্যমেই গুণের সৃষ্টি।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বস্তুর গুণের মধ্যে গঠনগত পার্থক্য স্বীকার করলেও এরূপ মৌল অমৌলরূপ কৃত্রিম পার্থক্যকে স্বীকার করে না। প্রকৃতপক্ষে লকের এই পার্থক্যকরণে যে দুর্বলতা ছিল তার ভিত্তিতে ভাববাদী দার্শনিক বার্কলে এবং অজ্ঞেয়বাদী হিউম লকের মৌল, অমৌল সকল গুণকেই মানসিক ভাব মাত্র বলে বর্ণনা করেছেন।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩১৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।