বিধাতার অস্তিত্ব বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব (ইংরেজি: existence of God) হচ্ছে ধর্ম এবং জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক দর্শনে বিতর্কের একটি বিষয়। ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে ও বিপক্ষে বিস্তৃত বিভিন্ন বিতর্ককে আধিবিদ্যক, যৌক্তিক, অভিজ্ঞতাবাদী বা আত্মগত হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। দার্শনিক ভাষায়, ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্ন জ্ঞানতত্ত্বের শাখা (জ্ঞানের প্রকৃতি এবং এলাকা) এবং তত্ত্ববিদ্যা (সত্তা, অস্তিত্ব বা বাস্তবের প্রকৃতির গবেষণা) এবং মূল্যবোধ তত্ত্ব (যেহেতু ঈশ্বরের কতিপয় সংজ্ঞায় “পরিপূর্ণতা” অন্তর্ভুক্ত) – এই তিনটিকে জড়িত করে। ভাববাদী দর্শন বিভিন্ন যুক্তি দ্বারা বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে ধর্ম ও ভাববাদী দর্শন পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
ভাববাদী দর্শন বিধাতার অস্তিত্বের পক্ষে তিনরকম যুক্তিগত প্রমাণ উপস্থিত করার চেষ্টা করেছে। যেমনঃ ১. জগতের মধ্যে জন্ম ও মৃত্যুর প্রমাণ দেখা যায়। সবকিছুর সৃষ্টি এবং লয় আছে। সবকিছুর ক্ষেত্রে জন্ম এবং মৃত্যুর কথা যদি সত্য হয় তা হলেও সমগ্র জগৎ সম্পর্কেও একথা সত্য। অর্থাৎ জগৎকেও এক সময় সৃষ্ট হতে হয়েছে। সৃষ্ট হওয়ার অর্থ হচ্ছে যে-সৃষ্টি, তার সত্তা থেকে পৃথক অপর কোনো সত্তার অস্তিত্ব থাকা। পৃথক সেই সত্তার কারণে অর্থাৎ তাঁর ইচ্ছায় এবং চেষ্টায় সৃষ্টের অস্তিত্ব। বিধাতা হচ্ছেন জগতের বাইরের সেই মূল কারণরূপ সত্তা। এই যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা যে, বিশ্ব-যে কোনো বিশেষ বস্তুর ন্যায়ই সীমাবদ্ধ অর্থাৎ সসীম এক সত্তা। এবং যেহেতু সে সসীম, সে কারণে তার পক্ষে ভিন্নতর কোনো শক্তি ব্যতীত অস্তিত্বময় হওয়া সম্ভব হয় নি। দর্শনের এ প্রমাণে যুক্তির চেয়ে ধর্মের ন্যায় বিশ্বাসকেই প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে। বিশ্বজগৎ যে সসীম এটা ভাববাদী দর্শনের অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসমাত্র। এই যুক্তির প্রকারভেদ প্লেটো, এরিস্টটল এবং লাইবনিজ দর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়।
২. বিশ্বস্রষ্টার দ্বিতীয় দার্শনিক প্রমাণ হচ্ছে ‘উদ্দেশ্যগত’ প্রমাণ। এ প্রমাণের ভিত্তি হচ্ছে এই যুক্তি যে, বিশ্বের সমস্ত ঘটনার মধ্যে উদ্দেশ্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কোনো কিছুই সংঘটিত হয় না। কিন্তু উদ্দেশ্য থাকার অর্থ উদ্দেশ্যের পিছনে এক উদ্দেশ্যদাতা আছে, যার সচেতন চেষ্টাতেই উদ্দেশ্য সাধিত হয়। কাজেই বিশ্ব যখন উদ্দেশ্যহীন নয় তখন বিশ্বের পিছনে অতিজাগতিক এক শক্তি আছে যার ইচ্ছাতে বিশ্ব উদ্দেশ্যময় হয়ে কর্মরত আছে।
৩. তৃতীয় প্রমাণ হচ্ছে : মানুষের মনে আদিকাল হতে বিশ্বস্রষ্টার একটা ভাব বর্তমান আছে। মানুষ মনে করে অসীম শক্তিশালী এবং সম্পূর্ণ এক স্রষ্টা আছে। যদি কোনো সত্তা না থাকে তা হলে মানুষের মনে এরূপ ভাব সৃষ্টি হতে পারতো না। কাজেই এরূপ অসীম শক্তিসম্পন্ন এবং সুসম্পন্ন এক স্রষ্টার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। অর্থাৎ যা মনে আছে তা অবশ্যই অস্তিত্বে আছে। বিধাতার অস্তিত্বের যে কোনো যুক্তির মূল দুর্বলতা হচ্ছে, একটি বিশ্বাসকে একইভাবে একদিকে সব অস্তিত্বের মূল বা কারণ এবং অপরদিকে সব অস্তিত্বকে সেই বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করার চেষ্টা করা। এর মধ্যে প্রতিপাদ্যকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করার অসঙ্গতি বিদ্যমান। বিধাতা সব অস্তিত্বের মূলে আছে। সব অস্তিত্ব বিধাতাই সৃষ্টি করেছেন। আবার সব অস্তিত্বই বিধাতার অস্তিত্বকে প্রমাণ করেছে।
ভাববাদী জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বিধাতার অস্তিত্বকে এরূপভাবে প্রমাণ করার অসারতা উপলব্ধি করে বলেছিলেন যে, বিধাতা হচ্ছেন অভিজ্ঞতা উর্ধ্ব একটা বোধ। তাঁকে বিশুদ্ধ চিন্তা দ্বারা একজন অনুভব করতে পারেন কিন্তু বাস্তব জগতের দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রমাণ করা চলে না। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বিধাতাকে মানুষের কল্পনা বলে মনে করে। মানুষের এরূপ কল্পনার আবশ্যকতা ছিল কিংবা আছে বলা এক কথা, আর সেই প্রয়োজনের কারণে বিধাতাকে অস্তিত্বময় বলা আর এক কথা। বিশ্ব সসীম নয়। বিশ্বের বাইরে অ-বিশ্ব বা অ-বস্তু বলে কিছু কল্পনা করা চলে না। বিশ্ব হচ্ছে বস্তু। আর বস্তু হচ্ছে গতিময়। বস্তুর বৈচিত্র্য, মানুষ, মন সবই গতিময় বস্তুর রূপ।
তথ্যসূত্র
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩২১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।