মোগল সাম্রাজ্য দক্ষিণ এশিয়ার সামন্তবাদী জনবিরোধী প্রাচীন সাম্রাজ্য

মুঘল সাম্রাজ্য বা মোগল সাম্রাজ্য (ইংরেজি: Mughal Empire) ছিলো দক্ষিণ এশিয়ার সামন্তবাদনির্ভর এক জনবিরোধী প্রাচীন সাম্রাজ্য। দিল্লীতে সুলতানশাহীর অস্তিত্ব, মুসলিম সামন্ত-ভূস্বামীদের এক শাসক সম্প্রদায়ের উদ্ভব, হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের দীর্ঘকালীন সহ-অবস্থিতি এবং এই দুই সম্প্রদায়ের ওপর পারস্পরিক প্রভাবএই সবকিছুই উত্তর ভারতে এক নতুন ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপনের পথ প্রশস্ত করে। যদিও এই উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চলগুলি যেমন, মালাবার, গুজরাট, করমণ্ডল ও বঙ্গ দীর্ঘকাল ধরে আরব-দেশগুলি, পারস্য, মালয় ও মক্কাদ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে সমুদ্রপথে মশলা ও বস্ত্রের ব্যবসায় প্রবলভাবে চালিয়ে যাওয়ার ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিকতর উন্নত হয়ে উঠেছিল, তবু, ওই অঞ্চলগুলি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কলহে ছিল ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং ইউরোপীয় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলি সমুদ্রপথের বাণিজ্য থেকে ভারতীয়দের ক্রমশ হটিয়ে দিয়ে ওইসব অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে থাকায় অঞ্চলগুলির শক্তি-সামর্থেও ক্রমশ ভাঁটা পড়ছিল। এই ঘটনাগুলি থেকে বোঝা শক্ত নয় কেনো সপ্তদশ শতাব্দীতে সামন্তবাদী কেন্দ্রীভূত কাঠামো নিয়ে মোগল সাম্রাজ্য সকল বিরোধিতা দমনে সমর্থ হয়েছিল এবং দক্ষিণ ভারতের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ জয় করে নিয়েছিল।

উত্তর-ভারতে এই নতুন রাজ্যটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তৈমুর-বংশীয় জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবর (১৫২৬ থেকে ১৫৩০ খ্রীস্টাব্দ)। ইনি প্রথমে ছিলেন ফেরগনার অধিপতি, পরে সাইবেরিয়া থেকে আগত উজবেকরা একে মধ্য-এশিয়া থেকে বিতাড়িত করেন। মহম্মদ বাবরকে সাহায্য করেন ও সমর্থন যোগন তাঁর এক আত্মীয়, হিরাটের তৈমুর-বংশীয় শাসক। বাবর অতঃপর আফগান ভূখণ্ডগুলি দখল করেন এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন কাবুলে। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন ভারত-জয়ের, মনে করেন একমাত্র ভারত জয় করতে পারলেই সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী এক রাজ্যের অধিপতি হতে পারবেন১৫১৮ ও ১৫২৪ খ্রীস্টাব্দে বাবর একাধিকবার পঞ্জাব আক্রমণ করেন। অতঃপর ১৫২৫ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আবার একবার ভারত আক্রমণ করলেন তিনি। এবার সঙ্গে নিয়ে এলেন মধ্য-এশিয়ার যোদ্ধরা ও সেইসঙ্গে আফগান ও গাব্বার যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত এক প্রবল শক্তিশালী সেনাবাহিনী। মোঙ্গলদের ব্যবহৃত যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করেঅর্থাৎ, অশ্বারোহী-বাহিনীগুলিকে দিয়ে আচমকা ঝটিকা-আক্রমণ করিয়ে এবং দড়ি-দিয়ে-পরপর-বাঁধা সারি সারি গাড়ির পেছনে পদাতিক সৈন্যদলকে অগ্রসর করিয়েবাবর শেষপর্যন্ত দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিম শাহ লোদীর সৈন্যদলকে পদস্ত করতে সমর্থ হলেন ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে, পানিপথের যুদ্ধে। এর একবছর পরে ফতেপুর সিক্রির যুদ্ধে চিতোরের রাজা ও অভিজ্ঞ যুদ্ধবিশারদ রাণা সঙ্গের নেতৃত্বে পরিচালিত রাজপুত-বাহিনীকে পরাস্ত করলেন। এর ফলে একদিকে যেমন সমগ্র রাজপুতানার ভূখণ্ডকে নিজের শাসনাধীনে ঐক্যবদ্ধ করার যে-বাসনা রাণা সঙ্গ পোষণ করছিলেন তা ধুলিসাৎ হয়ে গেল, তেমনই পানিপথে ও ফতেপুর সিক্রিতে পরপর এই দুটি যুদ্ধজয় উত্তর ভারতে বাবরের শাসনকে সুনিশ্চিত ও দৃঢ়বদ্ধ করে তুলল। এর পরে বাবর সফল হন প্রায় সমগ্র গঙ্গা-উপত্যকাই অধিকার করে নিতে।

আরো পড়ুন:  আইন অমান্য আন্দোলন প্রসঙ্গে

অতঃপর কিছু কিছু আফগান-বাহিনী লুষ্ঠিত দ্রব্যসামগ্রীতে ক্যারাভান ভারাক্রান্ত করে ঘরে ফিরে গেল। আর যে-সব যোদ্ধা রয়ে গেলেন ভারতে বাবর তাঁদের (রাজসেবার বিনিময়ে) জমি দান করলেন। এই ভূসম্পত্তিগুলিই পরে পরিচিত হয় জায়গির নামে। এই ধরনের সকল তালুকের দেখাশোনা, তদবিরতদারক করতেন যে সমস্ত রাজকর্মচারি তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন হিন্দু। এই হিন্দু, কর্মচারিরা দেশের রীতিনীতি জানতেন আর জানতেন কী পরিমাণে রাজস্ব ধার্য করলে কৃষকরা তা দিতে পারবেন।

বাবর ভারত শাসন করেন মাত্র তিন বছর। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুশিক্ষিত এবং পর্যবেক্ষণশীল মানুষ, শিল্পকলা সম্বন্ধে সক্ষম বিচারবোধসম্পন্ন কবিও ছিলেন তিনি। তিনি যে স্মৃতিকথাগুলি লিখে রেখে গেছেন তার ভাষা যেমন সরল তেমনই যথাযথ। হিন্দুদের অবশ্য তিনি বিধর্মী বলেই গণ্য করতেন এবং হেয়জ্ঞান করতেন তাঁদের, তবে তাঁদের ওপর উৎপীড়ন চালাতেন না।

মৃত্যুর আগে বাবর তাঁর অধিকৃত রাজ্য ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেন। তবে রাজ্যের প্রধান অংশ দিয়ে যান বড় ছেলে হুমায়নকে এবং অন্য তিন ছেলে, যাঁরা পঞ্জাব, কাবুল ও কান্দাহারের রাজ্যাংশ পেয়েছিলেন, তাঁদের নির্দেশ দিয়ে যান হুমায়নের আধিপত্য মেনে নিতে।

হুমায়ুন তাঁর রাজ্যের সীমানা পরিবর্ধনের চেষ্টা করেন গুজরাট, রাজপুতানার অংশ ও বিহার জয় করে। গোড়ার দিকে সাফল্য সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদের জন্যে তাঁর এই জয়লাভকে সংহত ও সুদঢ় করে তুলতে অসমর্থ হন তিনি। তাঁর ভাইয়েরা তাঁর আধিপত্য থেকে মুক্ত হবার আশায় দিল্লী অধিকার করে নিতে সচেষ্ট হন। হুমায়নের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অবশ্য ছিলেন বিহার ও বঙ্গে আফগান সামন্ত-রাজন্যদের প্রধান শের খাঁ সুর। বিহারে শের খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে হুমায়ন শেষ পর্যন্ত সিন্ধুদেশে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি স্থানীয় মুসলিম সেনাধ্যক্ষের চৌদ্দ বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেন এবং ১৫৪২ খ্রীস্টাব্দে এই স্ত্রীর গর্ভে তাঁর একটি পুত্রসন্তান জন্মায়। এই পুত্রই হলেন আকবর। এর অল্প কিছুদিন পরেই একাধিক ভাই তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে এগিয়ে আসতে থাকায় হুমায়নকে দেশ ছেড়ে আরও দূরে পালিয়ে যেতে হয়এবার তাঁকে পালাতে হয় পারস্যে। এই সময়ে শিশু আকবরের তত্ত্বাবধানের ভার গ্রহণ করেন কাবুলের শাসনকর্তা হুমায়নের ভাই কামরান।

আরো পড়ুন:  বাংলার জনগণের দিল্লি বিরোধিতা হচ্ছে এক হাজার বছরের শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস

হুমায়ুন ছিলেন ফারসি-সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসী সেনাধ্যক্ষও বটে, তবে তাঁর আফিমে আসক্তি তাঁর বিচারশক্তিকে প্রায়ই অক্রিয় করে তুলত। দিল্লীতে থাকতে তাঁর রাজত্বকালে হুমায়ন সাম্রাজ্যে এক নতুন শাসনব্যবস্থা প্রচলনে প্রয়াসী হন, তবে এই শাসন-ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত নীতিগুলি ছিল কৃত্রিম, বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন। তিনি তাঁর দরবারের অমাত্যদের তিনটি গোষ্ঠীতে ভাগ করেন : যথা, মন্ত্রীমণ্ডলী, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও শিল্পিগোষ্ঠী (কবি, নর্তকী, ইত্যাদি)। এছাড়া তিনি চারটি সরকারি দপ্তরও স্থাপন করেন: যথা, অগ্নিকাণ্ড-বিষয়ক দপ্তর সামরিক ব্যাপারের দায়িত্ব ছিল এই দপ্তরের ওপর ন্যস্ত; জল-দপ্তর-এই দপ্তর জমিতে জলসেচের ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করত এবং রাজকীয় মদ্য-ভাণ্ডারেরও ভারপ্রাপ্ত ছিল; ভূমি-সংক্রান্ত দপ্তরএই দপ্তর ছিল রাজস্ব আদায়, খালিসা জমির তত্ত্বাবধান ও নানা নির্মাণকর্মের ভারপ্রাপ্ত; এছাড়া ছিল বায়বীয় দপ্তর ধমীয় নেতৃবৃন্দ, কবিকুল ও ইতিহাসবেত্তাদের কাজকর্মসম্পর্কিত ব্যাপার ও তাঁদের বৃত্তি ও ভাতাদানের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিল এই দপ্তরটি। এই ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো, যা একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌণ গুরুত্বের ব্যাপারগুলিকে মেলাতে চেষ্টা করছিল, তা স্বভাবতই স্থায়ী হতে পারল এবং শের খাঁ সিংহাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গেই তা পরিত্যক্ত হলো।

১৫৪০ থেকে ১৫৪৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত শের খাঁ শের শাহ উপাধি নিয়ে দিল্লীতে রাজত্ব করেন। তিনি তাঁর প্রধান কর্তব্য বলে গণ্য করেছিলেন সামন্তভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণে রাখাকে, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণে রাখা বিহার ও বঙ্গের আফগান ভূস্বামীদের। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ক্ষমতা দখলের সময় এই শেষোক্ত ভূস্বামীদের সমর্থনের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছিল শের শাহকে। যাই হোক, এই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার উদ্দেশ্যে তিনি জায়গিরদারদের ওপর কড়া নির্দেশ জারি করলেন যে তাঁদের নির্দিষ্টসংখ্যক অশ্বারোহী যোদ্ধা নিয়ে অশ্বারোহী বাহিনী গঠন করতে হবে (এই অশ্বারোহী সৈন্যের সংখ্যা নির্ভর করবে জায়গির কত বড় তার ওপর)। এই অশ্বারোহী-বাহিনীগুলিই ছিল সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর প্রাণকেন্দ্রস্বরূপ। এ-ব্যাপারে পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখার জন্যে শের শাহ, নিয়ম করলেন যে ঘোড়াগুলির গায়ে বিশেষ-বিশেষ জায়গিরদারএর নিজস্ব সিলমোহরের ছাপ দিতে হবে এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষে তাঁদের সেনাবাহিনীগুলির নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। শের শাহ, এই নিয়মের প্রবর্তন করলেন রাষ্ট্রীয় পরিদর্শনের সময় নিজেদের খুশিমতো লোক ভাড়া করে এনে তাদের অশ্বারোহী সৈন্য হিসেবে দেখিয়ে পরিদর্শন শেষ হওয়ার পর তাদের ফের বিদায় করে দেয়ার যে-অভ্যাস জায়গিরদাররা এর আগে পর্যন্ত প্রচলন করেছিলেন তার অবসানকল্পেই। শের শাহ, রাষ্ট্রের প্রাপ্য ফসলের অংশ নির্দিষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন এবং রাজকোষের স্বার্থেই চেয়েছিলেন কৃষকদের জমির পরিমাণ যথাযথ মাপজোকের সাহায্যে নির্দিষ্ট না করে ও তার ভিত্তিতে ফসলের অংশ দাবি না করে খাজনা-আদায়কারীরা নিজেদের খেয়ালখুশি-মাফিক যেভাবে খাজনা আদায় করতেন তার অবসান ঘটাতে। তিনি নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে তাঁর সৈন্যদের কেবলমাত্র অর্থেই বেতন দিতে হবে এবং যেখানে সম্ভব হয়েছিল সেখানেই তিনি দ্রব্যসামগ্রীর পরিবর্তে অর্থে খাজনা দেয়ার ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন। নিষ্ঠুরভাবে কৃষকদের প্রতিরোধ ও সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করেছিলেন শের শাহ, (যেমন, তিনি দমন করেছিলেন আগ্রা অঞ্চলের অধিবাসী আফগান নিয়াজি উপজাতির বিদ্রোহ)।

আরো পড়ুন:  ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ ছিলো তিন গণশত্রুর পারস্পরিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত

নিজ রাজ্যের সীমানা প্রসারণের চেষ্টায় হুমায়ুনের মতো শের শাহ,ও রাজপুত রাজ্যগুলি জয় করায় মনোনিবেশ করেন ও চেষ্টা করেন ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলি দখল করার। কিন্তু ১৫৪৫ খ্রীস্টাব্দে রাজপুতানার একটি দুর্গ কালিঞ্জর অবরোধের সময় মত্যু ঘটে তাঁর।

ব্যবহৃত ছবি: নিবন্ধে ব্যবহৃত চিত্রটি ১৫২৬ সালে সংঘটিত পানিপথের যুদ্ধের। ছবিটি নেয়া হয়েছে ভারত যুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর, নঊবতখানা, লাল কেল্লা দিল্লি থেকে, আলোকচিত্র: Vssun.

তথ্যসূত্র:

. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৩১১-৩১৪

Leave a Comment

error: Content is protected !!