বিজ্ঞানের ইতিহাস হচ্ছে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানের চর্চা

বিজ্ঞানের ইতিহাস (ইংরেজি: History of Science) হলো প্রাকৃতিক এবং সামাজিক উভয় ধরনের বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিকাশ সংক্রান্ত অনুশীলন ও শিক্ষণ। বিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিশ্ব সম্পর্কে গবেষণামূলক, তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের একটি কলেবর, যা বিজ্ঞানীদের দারা উৎপাদিত। বিজ্ঞানীরা বাস্তব-বিশ্ব ঘটনার পর্যবেক্ষণ, ব্যাখ্যা এবং প্রত্যক্ষণগুলির উপরে জোর দেয়। বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকতা হচ্ছে বিপরীতভাবে, বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদদের মাধ্যমে নিযুক্ত পদ্ধতিগুলির অধ্যয়ন।

মানব সভ্যতায় বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে কোন না কোনভাবে বিজ্ঞানের ব্যবহার চলে আসছে। মানুষের উদ্ভাবনী চিন্তা ও তার প্রয়ােগ যদি বিজ্ঞানের জন্মদাত্রী হয়, তা হলে প্রাগৈতিহাসিক কোনও মানুষ যে দিন প্রথম পাথর ঘষে অস্ত্র বানিয়েছিল বা কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালিয়েছিল, সে দিন থেকেই বিজ্ঞানের সূচনা।[১]

কখনো প্রয়োজন, কখনো অনুসন্ধিৎসা মেটানোর জন্য বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার ঘটেছে; আবার কখনো বা আকস্মিকভাবে ঘটেছে। বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা লাভ করেছি বিশ্বজগৎ সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি এবং পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের বিপুল ক্ষমতা।

গোড়ার সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান

গ্রেকো-রোমান বিশ্ব

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে গ্রিক বিজ্ঞানের উত্থান আয়ােনিয়ায়। এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলে কিছু ভূমি ও নিকটবর্তী কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছিল আয়ােনিয়া (বর্তমান তুরস্ক অঞ্চল)। ওই অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী মিলেটাস শহরে আনুমানিক ৬২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মেছিলেন গ্রিক বিজ্ঞানের প্রথম পুরুষ তথা প্রতিভূ বলে খ্যাত থেলিস। তিনি একাধারে দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ ছিলেন। পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। এক একটি বছরকে ৩৬৫ দিনে ভাগ করেছিলেন থেলিস। ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন তিনি। সেই গ্রহণ ঘটেছিল ওই বছর ২৮ মে।

জ্যামিতির উপর থেলিসের তত্ত্ব পরে ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। সমবাহু ত্রিভুজের দুই বিপরীত কোণ সমান অথবা বৃত্তীয় ত্রিভুজের শীর্ষকোণ ৯০ ডিগ্রি, এটা থেলিসেরই আবিষ্কার। পৃথিবী কী দিয়ে তৈরি, বাকি বিশ্বের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, এই সব প্রশ্ন তােলেন থেলিস ও তার সহযােগীরা। তারা এও বলেন যে, প্রকৃতি কতকগুলি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে, কোনও খেয়ালি ঈশ্বরের ইচ্ছায় নয়। সে দিক থেকে থেলিসদের চিন্তাধারা যথেষ্ট আধুনিক। থেলিসের লেখা কোনও বইয়ের সন্ধান অবশ্য মেলেনি। প্রধানত শিষ্য পরম্পরায় ও লােকমুখেই থেলিসের তত্ত্ব ও মতবাদ প্রচারিত হয়।

প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসে অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মহাবিজ্ঞানী বলে অভিহিত। তিনি অ্যাকাডেমি অফ এথেন্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ প্লেটোর শিষ্য ছিলেন। পাশ্চাত্য জগতে অ্যাকাডেমি অফ এথেন্সই ছিল উচ্চশিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। প্লেটোর ‘ডায়ালগ’ জগদ্বিখ্যাত। প্লেটোর গুরু সক্রেটিস অতি উচ্চ মার্গের দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ ছিলেন। ধর্মবিরােধ এবং যুবসমাজকে বিপথে চালিত করার অভিযােগে বিষ পান করে মৃত্যু বরণের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। প্লেটোর ‘ডায়ালগ’ বস্তুত সক্রেটিসেরই মতবাদ ও তত্ত্বের বিস্তারিত ব্যাখ্যা। সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করেন। 

এঁদের মধ্যে অ্যারিস্টটলই ছিলেন প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানী। সম্রাট আলেকজান্ডারের শিক্ষক ছিলেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অ্যারিস্টটল চর্চা ও গবেষণা করেছেন নানা বিষয়ে। তার মধ্যে পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিদ্যা, রাজনীতি, কবিতা, তর্কবিদ্যা, সঙ্গীত, নাটক, কী নেই? বিশ্বের গঠন সম্পর্কে তার ধারণা ছিল, ৫৫টি স্ফটিকনির্মিত সমকেন্দ্রিক গােলক, একটির উপরে আর একটি স্থাপিত, ঘুরে চলেছে চিরস্থির পৃথিবীকে কেন্দ্র করে। আর এই সব গোলকের গায়েই আটকে রয়েছে গ্রহ, নক্ষত্র আর সূর্য। গােলকের ঘূর্ণনেই ঘুরে চলেছে তারা। বলা বাহুল্য, এই ধারণার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিন্তু প্রায় দু’ হাজার বছর ধরে তা চলেছিল, এমনই ছিল অ্যারিস্টটলের প্রভাব। তবে প্রাণিবিদ্যায় তার কিছু কিছু ধারণা উনিশ শতকে প্রমাণিত হয়। অ্যারিস্টটল প্রাণীদের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে প্রত্যক্ষভাবে পরীক্ষাও করতেন। মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী বলে প্রাণীদের শ্রেণিবিভাগও করেছিলেন তিনি। যদিও তাদের নাম দিয়েছিলেন যথাক্রমে ‘রক্তময়’ (animals with blood) এবং নীরক্ত’ (animals without blood) প্রাণী বলে। এই সংজ্ঞাও একেবারে ভুল ছিল।

প্রাচীন গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র ছিল এথেন্স, আয়ােনিয়া, সামােস, কো’জ ইত্যাদি অঞ্চল। সামােসের অ্যাসিরস্টারকাস (৩১০-২৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বিশ্ব তথা সৌরমণ্ডল সম্পর্কিত ধারণায় তার সময় থেকে কয়েক হাজার বছর এগিয়ে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন সৌরমণ্ডলের কেন্দ্র পৃথিবী নয়, সূর্য। সূর্যকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী ও গ্রহগুলি আবর্তিত হচ্ছে। আর নিজ অক্ষের উপরেও অবিরাম ঘুরে চলেছে পৃথিবী। এর পরেও গ্রিক-রােমান পর্বের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ টোলেমি (৯০-১৬৮ খ্রিস্টাব্দ) তার ‘আলমাজেস্ট’ গ্রন্থে অ্যারিস্টটলের বিশ্ব-তত্ত্বেরই অনুসরণে পৃথিবী-কেন্দ্রিক সৌরমণ্ডলের চিত্রই তুলে ধরেন। একেবারে পঞ্চদশ শতকে কোপারনিকাস সূর্যকেন্দ্রিক সৌরমণ্ডলের নিশ্চিত প্রমাণভিত্তিক ধারণা পেশ করার আগে পর্যন্ত যার প্রভাব অক্ষুন্ন ছিল।

চিকিৎসাবিদ্যাতেও প্রাচীন গ্রিসের অবদান স্মরণীয়। এ ক্ষেত্রে দুই স্তম্ভ ছিলেন হিপােক্রেটিস ও গ্যালেন। যদিও উভয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান প্রায় ৭০০ বছর। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে হিপােক্রেটিস চিকিৎসা করতেন মানবদেহের অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। জোর দিতেন নিছক অনুমান নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর। হিপােক্রেটিস লিখিত চিকিৎসকের জন্য শপথবাক্যে আজও পাঠ করতে হয় ডাক্তারির ছাত্রদের। গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যার যে ভিত্তি রচনা করেছিলেন হিপােক্রেটিস, তার উপরে ইমারত গড়ে তােলেন গ্যালেন (১৩১-২০১ খ্রিস্টাব্দ)। রােম সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের চিকিৎসক ছিলেন তিনি। পরীক্ষাভিত্তিক শারীরবিদ্যার জনক বলা হয় গ্যালনকে। 

ধ্রুপদী-উত্তর যুগে বিজ্ঞান

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মাঝামাঝি রােমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে গ্রিক বিজ্ঞানের ওপর যবনিকা নেমে আসে। নিভে আসে প্রাচীন জ্ঞানের দ্বীপ। শুরু হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ। ৩৭৫ থেকে ৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের অভিবাসন কালের পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণে চতুর্থ শতকে ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলে একটি মনীষাগত বুদ্ধিবৃত্তিক পতন ঘটেছিল। বিপরীতে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আগ্রাসিদের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিল এবং শিক্ষাকে সংরক্ষণ ও উন্নত করেছিল। পঞ্চম শতকে বাইজেন্টাইন পন্ডিত জন ফিলোপোনাস এরিস্টটলের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষা এবং এর ত্রুটিগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন।

সামন্তযুগের বিজ্ঞান চলেছিল ১৪৫০ সালে জার্মান বিজ্ঞানী জোহান গুটেনবার্গের চলমান অক্ষরভিত্তিক মুদ্রণ উদ্ভাবনের আগে পর্যন্ত। তবে অন্ধকার মধ্যযুগই আরবীয় বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। এই পর্বেই ইসলাম ধর্মের উত্থান ও দিগ্বিজয়। এ সময়ে বিজ্ঞানের কোনও লক্ষণীয় অগ্রগতি না-ঘটলেও, শাসক খলিফাদের পৃষ্ঠপােষকতায় আল্-খােয়ারিজুমি, আল্-বেরুনি, আবাত্তানি, আল রাজি, আল-কিন্দি, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম প্রমুখ আরব পণ্ডিত ভারতীয় ও গ্রিক গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যাকে বাঁচিয়ে রাখেন প্রধানত আরবি ও ফারসি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে। এবং সেই অনুবাদকর্মই পরে আলাে ছড়ায় পশ্চিমি দুনিয়ায়। যােড়শ শতকে ইউরােপীয় রেনেসাঁর আবির্ভাবে যা রসদ জুগিয়েছিল। কোপারনিকাস, গ্যালিলেও, কেপলার, ভেসালিয়াস প্রমুখের হাত ধরে শুরু হয়েছিল আধুনিক বিজ্ঞানের যুগ।

মধ্যযুগে ইউরােপীয় বিজ্ঞানের অগ্রপথিক ছিলেন রজার বেকন (১২১৪-১২৯৪)। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ওপর জোর দিয়েছিলেন তিনি। আলােকীয় বিজ্ঞানে তার পর্যবেক্ষণ আজকের নিরিখেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। রেনেসাঁ পর্বে দুটি উল্লেখযােগ্য নাম ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) এবং রেনে দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০)। দু জনেই ছিলেন মূলত তাত্ত্বিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী। প্রথম জন ইংরেজ, দ্বিতীয় জন ফরাসি। ফ্রান্সিস বেকন মনে করতেন বিজ্ঞানের একটি বাস্তব লক্ষ্য থাকা উচিত, তা হল মানুষের কল্যাণসাধন। আর দেকার্তে মনে করতেন সমস্ত বিশ্ব পদার্থে পরিপূর্ণ। তিনি বলতেন, যাচাই না করে কোনও কিছুই ধ্রুব বলে মেনে নেওয়া উচিত নয়। সব বিজ্ঞানই গণিতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, দেকার্তের এই ধারণা আজও সমান সত্য।

ইউরোপে বিজ্ঞানের প্রভাব

রেনেসাঁর রেশ ধরে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বিজ্ঞান ও তার সঙ্গে বিজ্ঞানের কার্যকর প্রয়ােগ বা প্রযুক্তি ক্রমশই এগিয়ে চলে। তখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানকে বলা হত ‘ন্যাচারাল ফিলােজফি’, প্রাকৃতিক জগতের সুসম্বদ্ধ ব্যাখ্যাই যার মূল লক্ষ্য। তবে একাধিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে এর নানাবিধ প্রয়ােগও ক্রমশ শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকেই যার পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন আর্কিমিডিস। আর সেই ঐতিহ্য বহন করে চলেন গ্যালিলেও, তরিচেল্লি, অটোভন গেরিক, রবার্ট হুক, বয়েল, নিউটন, মাইকেল ফ্যারাডে প্রমুখ কালজয়ী বিজ্ঞানী। ১৬০৮ সালে চশমা নির্মাতা হ্যান্স লিপারশে প্রথম দূরবিন তৈরি করেন, গ্যালিলেও এবং নিউটনের হাতে যার প্রভূত উন্নতি ঘটে। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে রবার্ট হুক প্রথম কম্পাউন্ড মাইক্রোস্কোপ বা যৌগিক অণুবীক্ষণ তৈরি করে চাক্ষুষ করেন উদ্ভিদের কোষ। একই সময়ে ডাচ বিজ্ঞানী আন্তন লিউয়েন হুক নিজের তৈরি অণুবীক্ষণে প্রথম অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চলমান জীব দেখতে পান। এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের বিবরণ দিয়ে লন্ডন রয়্যাল সোসাইটিতে প্রায় চারশােটি চিঠি পাঠান তিনি। ‘ব্যাক্টিরিওলজি’ বা জীবাণুবিদ্যার জনক বলে চিহ্নিত হন লিউয়েন হুক।

পুঁজিবাদী যুগে বিজ্ঞানের বিপ্লব

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ইতিহাস

অষ্টাদশ শতকে জীববিদ্যার ইতিহাসে দুটি উল্লেখযােগ্য নাম কার্ল লিনিয়াস ও জর্জেস বুফোঁ। লিনিয়াস কৃত উদ্ভিদের শ্রেণিবিভাগ কিছু সংশােধন-সহ আজও অনুসৃত হয়। বুফোঁর ৩৬ খণ্ডের ‘হিস্টোরি ন্যাচুরেলি’ মূলত প্রাণিজগতের বিস্তারিত ইতিহাস। বুফোঁর কাজ সে সময়ের দুই নামী জীববিজ্ঞানী ল্যামার্ক ও কুভিয়েরকে বিশেষ প্রভাবিত করে। দুজনেই ছিলেন জীবাশ্ম আবিষ্কারক এবং জীবাশ্মভিত্তিক গবেষণায় অগ্রণী। জীব কর্তৃক অর্জিত গুণ বংশ পরম্পরায় সঞ্চালিত হয়, ল্যামার্কের এই তত্ত্ব তার সময়েই নিন্দিত হলেও, চার্লস ডারউইন তাকে বড় জীববিজ্ঞানী বলে উল্লেখ করেছেন। বস্তুত, ‘বায়ােলজি’ শব্দটি ল্যামার্কেরই অবদান। কুভিয়ের জীবের অবলুপ্তি তত্ত্বের জনক। তার আগে মনে করা হত ‘ঈশ্বর সৃষ্ট’ সমস্ত জীবই কোথাও না কোথাও টিকে আছে। জীবজগতের বিবর্তন তত্ত্বে ল্যামার্ক ও কুভিয়ের নিঃসন্দেহে ডারউইনের পূর্বসূরি। 

ইংরেজ বিজ্ঞানী জেমস ওয়াট উদ্ভাবিত উন্নত বাষ্পীয় ইঞ্জিনের হাত ধরে অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় পদে ইউরােপে শুরু হয় শিল্পবিপ্লব। মানুষের হাতের কাজ চলে যায় যন্ত্রের দখলে। পণ্য উৎপাদনে চালু হয় যন্ত্রভিত্তিক কারখানা। এগিয়ে চলে প্রায়ােগিক বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তির রথ। অষ্টাদশ শতকেই রসায়ন বিজ্ঞানেও পটপরিবর্তন ঘটে। কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন তৈরি করেন জোসেফ প্রিস্টলি ও কার্ল শিলি। আর অক্সিজেনের ধর্ম আবিষ্কার করেন ল্যাভয়জিয়ের।

এই শতকেই ‘কারেন্ট ইলেকট্রিসিটি’ বা চলবিদ্যুৎ আবিষ্কৃত হয় অ্যালইসিও গ্যালভানি ও আলেসান্দ্রো ভােল্টার পরীক্ষায়। গ্যালভানি যেই মরা ব্যাঙের পায়ে একটি ধাতব দণ্ড ছোঁয়ান, অমনি ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে ব্যাঙের দেহ। গ্যালভানি বললেন, এর কারণ ব্যাঙের দেহে সৃষ্ট বিদ্যুৎ, যার নাম দিলেন ‘অ্যানিম্যাল ইলেকট্রিসিটি’। আর গ্যালভানির নাম হয়ে গেল ব্যাংনাচানাে অধ্যাপক। কীভাবে ওই বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে, তার প্রকৃত ব্যাখ্যা দিলেন ভােল্টা। তিনি বললেন, দুটি ভিন্ন ধাতুর পাত বা দণ্ড সিক্ত কোনও মাধ্যমের সংস্পর্শে এলে ধাতু দুটির মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। ব্যাঙের দেহে গ্যালভানি যে বিদ্যুৎ পেয়েছিলেন, এভাবেই তার জন্ম। ব্যাঙের শরীর থেকে তা সৃষ্ট হয়নি। এই তত্ত্ব থেকেই বিশ্বের প্রথম ‘ইলেকট্রিক ব্যাটারি’ বা বৈদ্যুতিক কোষ তৈরি করেন ভােন্টা, যার নাম ‘ভােল্টাস পাইল’। লবণাক্ত জলে ভেজানাে পিচবাের্ড বা চামড়ার পাতের দু দিকে পর্যায়ক্রমে তামা আর দস্তার পাত বসিয়ে তিনি তৈরি করেন এই ব্যাটারি, যেখানে রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে জাত হয় বিদ্যুৎ। পরবর্তিকালে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত নানা পরীক্ষায় ভােল্টার পাইল ব্যবহৃত হতে থাকে। ভােল্টার এই উদ্ভাবন বিদ্যুৎ-বিজ্ঞানে এক বিরাট পদক্ষেপ।

তড়িৎ সংক্রান্ত গবেষণায় উল্লেখযােগ্য দুই বিজ্ঞানী আন্দ্রে অ্যাম্পিয়ার ও হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়ারস্টেড ভােল্টা ও ফ্যারাডের সমসাময়িক। এই দুই বিজ্ঞানীর নামে রয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ একক– ‘অ্যাম্পিয়ার’ ও ‘ওয়ারস্টেড’। প্রথমটি চলতড়িতের পরিমাণ মাপক, দ্বিতীয়টি চুম্বকীয় ক্ষেত্রের। বিদ্যুৎ সঞ্চালন-পথে ‘রেজিস্ট্যান্স’ বা রােধ-এর ধারণা দেন জার্মান পদার্থবিদ জর্জ ওহম। স্কুলশিক্ষক এই বিজ্ঞানী ভােল্টার পাইল নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন কোনও পরিবাহীর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত তড়িতের পরিমাণ ওই পরিবাহীর দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমে। বিদ্যুৎ চলার পথে তা বাধা বা রােধের সৃষ্টি করে। এরই নাম ওহম-এর নিয়ম। আর রােধের একক হল ওহম। উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গােড়ায় বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্মরণীয় অস্ট্রীয় ইঞ্জিনিয়ার ও উদ্ভাবক নিকোলা টেসলা। অল্টারনেটিং কারেন্ট বা পরবর্তী বিদ্যুৎ উৎপাদক মােটর উদ্ভাবনের পাশাপাশি এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরুর পিছনে রয়েছেন প্রধানত তিনিই।

উনিশ শতকে শুরু হয় বিজ্ঞানের আর এক নবযুগ। যা পরিণতি পায় বিংশ শতাব্দীতে। উনিশ শতকে রসায়নে অগ্রগতি চমকপ্রদ। ফরাসি রসায়নবিদ জোসেফ প্রাউস্ট প্রমাণ কবেন, যে কোনও যৌগিক পদার্থ, প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম, দুই বা ততােধিক নির্দিষ্ট মৌলিক পদার্থের সংযােগে গঠিত। যেখানে মৌলগুলির আনুপাতিক পরিমাণ সব সময়েই একই রকম। যার নাম ‘ল অফ ডেফিনিট প্রোপােরশন’।

ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডাল্টন বললেন, সমস্ত পদার্থই ক্ষুদ্রতম অদৃশ্য কণা দিয়ে তৈরি, যার নাম ‘অ্যাটম’ বা পরমাণু, যাকে আর ভাঙা যায় না। বিশ শতকেই অবশ্য প্রমাণ হয়ে যায় পরমাণু অবিভাজ্য নয়। ইতালীয় বিজ্ঞানী আমেদিও অ্যাভােগার্ডো বললেন, যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হল ‘মলিকিউল’ বা অণু, যা সমজাতীয় বা ভিন্ন জাতীয় একাধিক পরমাণুতে বিশ্লিষ্ট হতে পারে। রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিভ তখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৌলগুলিকে তাদের ধর্ম অনুযায়ী উল্লম্ব ও অনুভূমিক সারিতে বিভক্ত সারণিতে সাজালেন, যার নাম ‘পিরিওডিক টেল’ বা পর্যায় সারণি। এই সারণিতে অনাবিষ্কৃত মৌলগুলির জন্যেও স্থান নির্দিষ্ট করে যান তিনি। পরে সেগুলি আবিষ্কৃত হয়। রসায়ন চর্চায় এই সারণি অপরিহার্য। 

জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রেডারিক অগাস্ট কেকুল ছটি করে কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণুর সংযােগে গঠিত জৈব যৌগ ‘বেঞ্জিন’-এর আণবিক গঠন ভাবতে ভাবতে একদিন স্বপ্নে তার হদিশ পেয়ে গেলেন। তিনি প্রমাণ করলেন বেঞ্জিনের অণুতে কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি ষড়ভুজের আকারে সংযুক্ত। জৈব রসায়নে নতুন মাত্রা এনে দেয় কেকুলের এই আবিষ্কার। প্রতিভাবান জার্মান রসায়নবিদ ফ্রেডরিক ভােলার দুটি অজৈব যৌগ অ্যামােনিয়া ও সায়ানিক অ্যাসিডের সংযােগে তৈরি করেন ইউরিয়া, যা আদতে জৈব পদার্থ। যুগান্তকারী এই আবিষ্কারে প্রমাণ হয়ে যায় অজৈব ও জৈব পদার্থের মধ্যে মূলগত কোনও পার্থক্য নেই। পরমাণুর সঙ্গে পরমাণুর সংযােজন ক্ষমতা অর্থাৎ ‘ভ্যালেন্স’ বা যােজ্যতার ধারণা দেন ইংরেজ বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ফ্র্যাঞ্চল্যান্ড।

ঊনবিংশ শতকে দুই কালজয়ী উদ্ভাবন টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন। তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির কার্যকর প্রয়ােগের দুই অসাধারণ যন্ত্র তথা ব্যবস্থা। প্রথমটির পিছনে ছিলেন স্যামুয়েল মাের্স। দ্বিতীয়টির জন্মদাতা আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। ১৮৪৩ সালে মাের্স প্রথম ওয়াশিংটন থেকে বাল্টিমাের পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন বসান। গ্রাহাম বেলের আগে টেলিফোন উদ্ভাবনের শত চেষ্টা হলেও, তা সফল হয়নি। টানা ৪০ সপ্তাহ ধরে আপ্রাণ চেষ্টার পর সফল হন বেল। তরুণ সহকারী ওয়াটসনের কাছে তাঁর কণ্ঠে প্রথম বার্তা আসে: ‘Mr. Watson, please come here, I want you.’

আলাে যে এক রকমের তরঙ্গ, এই শতকেই তা আবিষ্কার করেন ইংরেজ বিজ্ঞানী টমাস ইয়ং এবং ফরাসি অগাস্টিন ফ্রেসনেল। আলাের গতিবেগ প্রায় নির্ভুলভাবে নির্ণয় করেন লুই ফিজো এবং লিওঁ ফুকো। নক্ষত্রের আলাের বর্ণালি বিশ্লেষণ করে উজ্জ্বলতার মাত্রা অনুযায়ী তাদের শ্রেণিবিন্যাস করেন জোসেফ ভন ফ্রাউনহফার। উনিশ শতকের শেষাশেযি এক্স-রশ্মি ও তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন যথাক্রমে ভিলহেল্ম রন্টজেন ও অ্যান্টনি বেকারেল। পরমাণুর মধ্যে ঋণাত্মক ইলেকট্রন কণার সন্ধান পান জোসেফ থমসন। 

প্রথম বিমান তৈরিতে অটো লিলিয়েস্থান এবং দুই ভাই উইলবার ও অরােভিল রাইটের ঐতিহাসিক সাফল্যও উনিশ শতকের এক মাইলফলক।

ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল বিচিত্র পথে আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি রচনার কাল। আর বিংশ শতকে গড়ে উঠল তার ইমারত। যার ইতিহাস মােটামুটি আমাদের জানা। যুগান্তকারী কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতাবাদ ছাড়াও এই শতকে কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বিশ্ব সৃষ্টির ‘বিগ ব্যাংগ’ বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব (জর্জ গ্যামাে, রাফ অ্যালফার ও রবার্ট হেরমান), জীবকোষে ডিঅক্সিরিবােনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ-র আণবিক গঠন (ফ্রান্সিস ক্রিক ও জেমস ওয়াটসন), জেনেটিক কোড বা কোষের জিনগত সঙ্কেত (মার্শাল নিরেনবার্গ), পেনিসিলিন (আলেকজান্ডার ফ্লেমিং), ট্রানজিস্টার (জন বার্ডিন, ওয়াল্টার এইচ ব্রাটেন ও উইলিয়ম শলে) ইত্যাদি।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জিনপ্রযুক্তির উদ্ভব ও অগ্রগতিও বিশ শতকেই। এক কথায় যার নাম বায়ােটেকনােলজি বা জীবপ্রযুক্তি। যার পিছনে রয়েছে বহু বিজ্ঞানীর অবদান। বস্তুত, বিশ শতকের অন্তিম পর্বে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন ঘটেছে মূলত সম্মিলিত প্রয়াসে। কম্পিউটার ও মহাকাশ বিজ্ঞানে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি মূলত এই প্রয়াসেরই ফল। 

একবিংশ শতকের প্রথম দশক সবে সমাপ্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নানা চমকপ্রদ আবিষ্কার ও উদ্ভাবন দেখে ফেলেছে এই দশক। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য সম্ভবত মানব-জিনের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র নির্মাণ। বহু বিজ্ঞানীর নিরলস গবেষণা ও পরিশ্রম রয়েছে যার পিছনে। বিজ্ঞজনেরা বলছেন, বিশ শতক যদি পদার্থবিজ্ঞানের অধীন হয়ে থেকে, তা হলে জীবপ্রযুক্তির অবিশ্বাস্য বিস্ফোরণ দেখতে চলেছে এই একবিংশ শতাব্দী। 

সামাজিক বিজ্ঞানের ইতিহাস

সামাজিক বিজ্ঞানের ইতিহাসের উৎস পশ্চিমা দর্শনের সাধারণ ধারণায় এবং বিভিন্ন পূর্বসূরীর ভাবনাকে ভাগ করে নেয়া হয়েছে। তবে এই সামাজিক বিজ্ঞানের ইতিহাস উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিজ্ঞানের দৃষ্টবাদী দর্শনের মধ্য দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইচ্ছাকৃতভাবে শুরু হয়েছিল এবং দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করেছিল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে, “সামাজিক বিজ্ঞান” শব্দটি সাধারণত সমাজবিজ্ঞানের (ইংরেজি: sociology) দিকে নয়, সমাজ ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণকারী সমস্ত শাখাকে আরও সাধারণভাবে উল্লেখ করেছে; নৃবিজ্ঞান থেকে ভাষাবিজ্ঞান হয়ে প্রচারমাধ্যম বিষয় পর্যন্ত।

আলোকচিত্রের ইতিহাস: মহীশুর রকেট নিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে লড়াই করতে মহীশুর সেনাবাহিনীকে একটি চিত্রকর্মে দেখানো হচ্ছে।

তথ্যসূত্র:

১. বিমল বসু, বিজ্ঞানে অগ্রপথিক, অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৩-২১।

আরো পড়ুন:  আদি যুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত এশিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস প্রসঙ্গে

Leave a Comment

error: Content is protected !!