সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে মোগল সাম্রাজ্যে জাহাঙ্গীরের মোগল-সিংহাসনে আরোহণ আকবরের ঘোষিত ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি থেকে কিছু-পরিমাণে বিচ্যুতির সুচক। এর ফলে হিন্দু, জায়গিরদার’দের অধিকাংশের মধ্যে এবং মুসলিমদের কিছু-কিছু অংশের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দেয়। এর অল্প কিছুদিন পরে জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠপুত্র খুসরো পাঞ্জাবে পালিয়ে যান ও সেখানে এক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। শিখদের পঞ্চম গুরু অর্জুন আর্থিক সাহায্য যোগান তাঁকে। তৎসত্ত্বেও মোগল-বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে খুসরোর সেনাবাহিনী পর্যুদস্তু হয়, মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তাঁর সমর্থকদের এবং তাঁকে অন্ধ করে দেয়া হয়। অর্জুন দেবের ওপর জাহাঙ্গীর বরাদ্দ করে দেন মোটা একটা অর্থদণ্ডের এবং অর্জুন তা দিতে অস্বীকার করলে জাহাঙ্গীর তাঁকেও হত্যা করেন। এর পর থেকেই মোগলদের বিরদ্ধে সক্রিয় শত্রুতার সূত্রপাত ঘটে শিখদের মধ্যে।
অতঃপর মোগল সাম্রাজ্যে জাহাঙ্গীর ভারতের সেই সমস্ত অঞ্চল দখল করতে উদ্যোগী হন যে অঞ্চলগুলি তাঁর পিতা জয় করতে অক্ষম হয়েছিলেন। ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে মেবারের রাজপুতরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন মোগল-সেনাবাহিনীর কাছে। মেবারের রাজার ছেলেকে এরপর আনানো হলো জাহাঙ্গীরের দরবারে এবং তাঁর প্রতি সদয় ব্যবহার করে ও তাঁকে প্রচুর উপহার-দ্রব্য দিয়ে জাহাঙ্গীর চাইলেন এই কৌশলে অন্যান্য স্বাধীন রাজারাজড়াদেরও তাঁর পক্ষে আনতে।
মোগল-বাহিনীর আসাম-অভিযানের কিন্তু পরিসমাপ্তি ঘটল ওই বাহিনীর গুরুতর পরাজয়ে এবং বহু সৈন্যক্ষয়ে। এই যুদ্ধে মোগল-সাম্রাজ্যের নদীবাহিত নৌ-বাহিনীও ধংস হয়ে গেল। অতঃপর কাঙড়ায় অবস্থিত পাঞ্জাবের দুর্গটির অবরোধ শুরু হলো ১৬১৫ খ্রীস্টাব্দে। এর পাঁচ বছর পরে এই দুর্গের হিন্দু অধিপতি আত্মসমর্পণ করলেন। অতীতে আকবরের সৈন্যদল এই দুর্গ অধিকারের চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত সে-চেষ্টা থেকে বিরত হতে বাধ্য হয়, তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই সাফল্যকে উদযাপন করেন বিপুলে এক বিজয়োৎসবের মধ্যে দিয়ে এবং হকুম দেন ওই দুর্গের অভ্যন্তরে একটি মসজিদ নির্মাণের।
উত্তর-ভারতে জাহাঙ্গীরের শেষ বিজয়-অভিযান পরিচালিত হয় ১৬২২ খ্রীস্টাব্দে, কাশ্মীরের ছোট একটি রাজ্য কিসতওয়ার জয় করার মধ্যে দিয়ে।
বারবার জাহাঙ্গীরকে পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষে আসতে হয়েছিল, কেননা পর্তুগিজরা অনবরত মোগল-নৌবহরগুলিকে আক্রমণ করতেন। ফলে মোগল ‘পাতসাহ’ পর্তুগিজদের প্রতিদন্দ্বী ব্রিটিশ ও ওলন্দাজদের পষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করে দিলেন। ওই সময়ে ব্রিটিশ ও ওলন্দাজরা সবেমাত্র ভারত-মহাসাগরে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ওলন্দাজ ও ব্রিটিশ বণিকরা পর্তুগিজদের মতো শুধু ভারতের সমুদ্রোপকূলবর্তী এলাকায় বাণিজ্য সীমাবদ্ধ রাখলেন না, তাঁরা দেশের অভ্যন্তরেও অনুপ্রবেশে সচেষ্ট হলেন এবং আগ্রা, ঢাকা, পাটনা ও দেশের অন্যান্য কারুশিল্প উৎপাদনকেন্দ্রগুলিতেও বাণিজ্য-কুঠির গড়ে তুললেন। হংল্যাণ্ডের তৎকালীন রাজা প্রথম জেমস এমন কি মোগল-দরবারেও টমাস রো নামে একজন প্রতিনিধিকে পাঠিয়ে দিলেন ভারতস্থিত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের পক্ষে নানা সুযোগ সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে। এই টমাস রো জাহাঙ্গীরের দরবারে তিন বছর (১৬১৫ থেকে ১৬১৮ খ্রীস্টাব্দ) পর্যন্ত অবস্থান করেন। ভারতে তাঁর এই তিন বছরের জীবনযাত্রার যে-সব খুটিনাটি তিনি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেন তা পরবতী ইতিহাসবেত্তাদের কাজে লেগেছে।
তথ্যসূত্র:
১. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৩৩৪-৩৩৫।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।