কমরেড জোসেফ স্তালিনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও দার্শনিক উদ্ধৃতি

কমরেড জোসেফ স্তালিনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও দর্শন বিষয়ক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছে এই লেখাটি। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মহান শিক্ষক স্তালিনের এই উদ্ধৃতিগুলো আমাদের শিক্ষাকে আশা করি শাণিত করবে। মোট ৮টি উদ্ধৃতি এখানে দেয়া হলো।

১. ইতিহাসের শিক্ষা থেকেই আমরা জানতে পারি যে সমাজে যে শ্রেণি বা গোষ্ঠী উৎপাদনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে, এবং উৎপাদনের প্রধান কাজগুলো করে থাকে, কালে কালে তাদেরই যে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর আধিপত্য স্থাপিত হবে সে কথা অবশ্যম্ভাবী। নৈরাজ্যবাদ অথবা সমাজতন্ত্র, ডিসেম্বর ১৯০৬-জানুয়ারি ১৯০৭

২. সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে কমরেড লেনিন একটি আলোকবর্তিকাস্বরূপ মনে করতেন যা সমস্ত দেশের শ্রমিকশ্রেণির পথকে আলোকিত করছে। আলোচনার উত্তরে, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯২৬

৩. যখন কমিউনিস্টদের কিছু কিছু গ্রুপ নির্বাচনী প্রচারে ‘শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণীর’ স্লোগানের উপযোগিতা অস্বীকার করে (ফ্রান্স), অথবা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে তার নিজের প্রার্থী মনোনয়ননের বিরোধীতা করে (ব্রিটেন), অথবা ‘বামপন্থী’ সোশ্যাল ডেমোক্রাসির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে একটা তীব্র আচরণীয় বিষয় করতে অনিচ্ছুক হয় (জার্মানি) ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে কমিউনিস্ট পার্টিগুলিতে এমন সব লোকজন আছে যারা সাম্যবাদকে সোশাল ডেমোক্রাসির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯২৮

একজন সংস্কারবাদীর কাছে সংস্কারটাই সবকিছু। — স্তালিন

৪. সংস্কারপন্থীর কাছে সংস্কারটাই হলো সবকিছু; বিপ্লবী কাজকর্মটা হলও নেহাত কথার কথা, লোকের চোখে ধুলো দেবার জিনিস। এই কারণেই বুর্জোয়া রাজত্বে সংস্কারপন্থী কৌশল অনুসরণ করার ফলে, সংস্কারটা নিশ্চিন্তভাবে ঐ রাজত্বকে আরো শক্তিশালী করার হাতিয়ারে রূপান্তরিত হয়, বিপ্লবকে বানচাল করা হাতিয়ারে পরিণত হয়। লেনিনবাদের ভিত্তি, এপ্রিল, ১৯২৪

৫. রাষ্ট্র হলো শ্রেণিশত্রুকে দমন করার জন্য শাসকশ্রেণির হাতে যন্ত্রবিশেষ। এই হিসাবে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের সংগে অন্য কোন শ্রেণির একনায়কত্বের তফাত নেই; কারণ শ্রমিকের রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের দমন করার যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য হলো এই যে, ইতিহাসে এ পর্যন্ত যত শ্রেণি-রাষ্ট্র হয়েছে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত জনসাধারণের উপর সংখ্যালঘু শোষকের একনায়কত্ব; আর শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব হলো সংখ্যালঘু শোষকের উপর শোষিত সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব। লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা, এপ্রিল, ১৯২৪

আরো পড়ুন:  ৪ঠা মে’র আন্দোলন

৬. সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত জয়লাভের জন্য, সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সংগঠিত করার জন্য, একটি দেশের চেষ্টা, বিশেষ করে রাশিয়ার মতো একটি কৃষি প্রধান দেশের চেষ্টা যথেষ্ট নয়; তার জন্য কয়েকটি উন্নত দেশের শ্রমিকদের চেষ্টার প্রয়োজন। লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা, এপ্রিল, ১৯২৪

৭. এক দেশে সমাজতন্ত্রের জয়লাভের সম্ভাবনা বলতে আমরা কি বুঝি?

আমরা বুঝি যে, অন্যান্য দেশে শ্রমিক বিপ্লব জয়যুক্ত না হলেও আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তির সাহায্যেই প্রলেতারিয়েত বনাম কৃষকদের মধ্যেকার স্ববিরোধের সমাধান করার সম্ভাবনা আছে, অন্যান্য দেশের প্রলেতারিয়েতের সহানুভূতি আর সমর্থনের সাহায্যে প্রলেতারিয়েতের ক্ষমতা দখলের এবং সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে আমাদের দেশে সম্পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার সম্ভাবনা আছে।

এই সম্ভাবনা ছাড়া সমাজতন্ত্র গড়ার চেষ্টার অর্থ হলো উদ্দেশ্যহীনভাবে কাজ করা, সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা যাবে কীনা সে সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে কাজ করা। সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে আমরা সক্ষম এ বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে, আমাদের দেশে শিল্প কৌশলের দিক দিয়ে অনুন্নত হওয়া সত্বেও পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার পথে তা অনতিক্রম্য বাধা হবে না_ এ বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে সমাজতন্ত্র গড়ার চেষ্টা অর্থহীন। এই সম্ভাবনা অস্বীকার করার অর্থ হলো, সমাজতন্ত্র গড়ার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, লেনিনবাদকে পরিত্যাগ করা।

অন্যান্য দেশের বিপ্লবের জয়লাভ ছাড়া এক দেশে সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ চূড়ান্ত জয়লাভ অসম্ভব_ একথা বলতে আমরা কী বুঝি?

আমরা বুঝি যে, অন্তত কয়েকটি দেশে বিপ্লব সফল না হলে বিদেশি হস্তক্ষেপের হাত থেকে_ সুতরাং বুর্জোয়া সমাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার হাত থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ হওয়া অসম্ভব। এই অনস্বীকার্য সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করার অর্থ আন্তর্জাতিকতাবাদ বিসর্জন দেয়া, লেনিনবাদকে পরিত্যাগ করা। লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা, এপ্রিল, ১৯২৪

৮. সমতা বলতে মার্কসবাদ ব্যক্তিগত স্বতন্ত্র চাহিদা ও প্রাত্যহিক জীবন সমান করে দেওয়ার কথা বুঝায় নি, বরং যা বুঝিয়েছে তা হলো শ্রেণীর বিলুপ্তি, অর্থাৎ (ক) পুঁজিপতিদের উচ্ছেদ ও অধিকারচ্যুত করার পর শোষণের হাত থেকে সমস্ত মেহনতী মানুষের সমান মুক্তি; (খ) উৎপাদনের সমস্ত উপায়- উপকরণ সমগ্র সমাজের সম্পত্তিতে পরিণত হওয়ার পর তার উপর ব্যক্তিগত মালিকানার সমান বিলুপ্তি; (গ) নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সকলেরই কাজ করবার সমান কর্তব্য, এবং এই নিষ্পন্ন কাজের পরিমাণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক লাভের ক্ষেত্রে সকল মেহনতী মানুষের সমান অধিকার (সমাজতান্ত্রিক সমাজ); (ঘ) সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার ক্ষেত্রে সকলের সমান কর্তব্য আর প্রয়োজন অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্ত মেহনতী মানুষের সম-অধিকার (সাম্যবাদী সমাজ।) অধিকন্তু, মার্কসবাদ এই ধারণাকে স্বীকার করে নিয়েই অগ্রসর হয়েছে যে, সমাজতন্ত্রের কালেই হোক আর সাম্যবাদের কালেই হোক, গুণের আর পরিমাণের দিক থেকে মানুষের রুচি আর প্রয়োজন একই-রূপ নয়, এবং হতেও পারে না। এই হলো সাম্য সম্পর্কে মার্কসবাদী ধারণা। অন্য কোনো রকমের সাম্য মার্কসবাদ কখনোই স্বীকার করেনি, এবং করেও না। এ থেকে যদি এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, সমাজতন্ত্র সবকিছু সমান করে দেয়ার [equalization], সমাজের সভ্যদের চাহিদা-প্রয়োজনকে পিটিয়ে সমান করে দেয়ার, তাদের রুচি আর তাদের ব্যক্তিগত প্রাত্যহিক জীবনকে পিটিয়ে সমান করে দেয়ার প্রস্তাব করে—মার্কসবাদী পরিকল্পনা অনুযায়ী সকলেই এক রকম কাপড় পরবে, এবং একই খাদ্য একই পরিমাণে খাবে—এরূপ সিদ্ধান্ত যদি করা হয়, তাহলে সেটা হবে মার্কসবাদকে চরম স্থূল করে তোলা ও কুৎসা জ্ঞাপন করা। একথা বুঝে নেয়ার সময় যথার্থই উপস্থিত যে, মার্কসবাদ হলো সবকিছু-সমান-করে দেয়ার শত্রু। সেই কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারেই মার্কস ও এঙ্গেলস ‘আদিম স্বপ্নচারী সমাজতন্ত্রের’ নিন্দা করেছেন এবং সেটাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল বলে, কেননা সেটা প্রচার করেছিল, ‘সর্বজনীন ভোগনিবৃত্তির এবং সবচেয়ে স্থূল রূপে সমাজকে পিটিয়ে সমান করে ফেলার’ শিক্ষা। লেনিনবাদের সমস্যা, ১৯২৬

আরো পড়ুন:  এক দেশে সমাজতন্ত্র হচ্ছে লেনিন উদ্ভাবিত তত্ত্ব যা স্তালিন ও ত্রতস্কির বিতর্কে রূপ পায়

Leave a Comment

error: Content is protected !!