মার্কসবাদ লেনিনবাদবিরোধী বাসদ এবং কমিউনিস্টদের জন্য তার ঐতিহাসিক শিক্ষা

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, বা সংক্ষেপে বাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের জন্য তার ঐতিহাসিক শিক্ষা রেখে গেছে। এই বাসদ গঠিত হয় ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর মহান রুশ বিপ্লব দিবসে। শুরুর দিন থেকেই এই সংগঠনটি নিজেদেরকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছে। তারপর প্রায় চার দশক অতিক্রান্ত হতে চলল। বাসদের ব্যবচ্ছেদ করার সময় এসেছে এবং এই সংগঠনটি সম্পর্কে আমাদের ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও একটি মূল্যায়ন দাঁড় করানো প্রয়োজন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রলেতারিয়েত শ্রেণির মুক্তির স্বার্থেই। কেননা গত চার দশকে এই সংগঠনটিতে বেশ কিছু ছাত্র-তরুণ-পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবী তাদের মূল্যবান সময় চিন্তা ও মেধা ব্যয় করেছেন। তাদের সেই পরিশ্রম কী মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পক্ষে থেকে প্রলেতারিয়েতের সেবায় লেগেছে নাকি জনগণের বিপক্ষ শক্তির পক্ষে গেছে।

প্রথমেই বলে নেয়া যাক মার্কসবাদ বলতে আমরা কী বুঝবো? মার্কসবাদ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চালিত প্রলেতারিয়েতের মুক্তির মতবাদ। আর লেনিনবাদ হচ্ছে একটি বিপ্লবী অগ্রবর্তী পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাভিত্তিক সংগঠনের জন্য এবং এটি সমাজতন্ত্রপ্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েমের রাজনৈতিক তত্ত্ব।

এই লেখায় মূলত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের আলোকে এবং সেসব নেতাদের কিছু উদ্ধৃতির মাধ্যমে বাসদের নেতা খালেকুজ্জামানের কিছু উদ্ধৃতির মূল্যায়ন করা হবে এই উদ্দেশ্যে যে তার সংগঠনটি এখন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অবস্থান থেকে কোথায় অবস্থান করছে। যেমন, বাসদের খালেকুজ্জামান অক্টোবর ৯, ২০১৩ তারিখে বলেছিলেন

“সিপিবি-বাসদ মিলে সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক শক্তির প্রতি একটা ডাক দিয়েছিলাম- আমাদের এই দুই দলের বাইরে একটা কিছু আমাদের প্রয়োজন”।[১]

এই দুই দল বলতে তিনি বুঝাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এবং এই দুই দলের বাইরে একটা কিছু করা প্রয়োজন বলছেন; কিন্তু এই বের্নস্তাইন ও মিলেরাঁপন্থি ব্যক্তিটি বলছেন না সাম্রাজ্যবাদের এই দালাল বুর্জোয়াদের উৎখাত করে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েম করার কথা। এভাবেই চলছে শুরু থেকেই, ফলে ১৯৮০ সাল থেকেই এই সংগঠনটির কোনো দৃশ্যমান শ্রেণিসংগ্রামের কর্মসূচি নেই।

বাসদ ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যেতে চায়, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলে, বাজেটে শিক্ষা-কৃষিখাতে বাজেট বাড়ানোর তদবির করে। এসব অর্থনীতিবাদী আন্দোলনই শুধু নয়, তারা নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের কথাও বলে। যেমন সিপিবির সভাপতি বলেন “‘নির্বাচনব্যবস্থার আমূল সংস্কারের জন্য আন্দোলন করছি” [২]। “নির্বাচন হয়ে উঠছে প্রহসন, প্রয়োজন আমূল সংস্কার” [৩] শীর্ষক এক সেমিনারে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য সিপিবি ও বাসদ দশ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করে ২২ মার্চ, ২০১৪তে। এছাড়াও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ২৪ ডিসেম্বর ১৩-তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, “গণতান্ত্রিক সংস্কার ছাড়া সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়”।[৪] এইসব সংস্কারবাদী কথাবার্তা উপস্থাপন করে মূলত বাসদের কাজ হয়ে পড়েছে অনবরত সংস্কারের পক্ষে কথা বলা।

১৯৭৩ সাল থেকে জাসদসহ বাসদের ইতিহাস ধরলে, কেননা জাসদ থেকেই বাসদের উৎপত্তি, সংসদ নির্বাচনের ৯টির ভেতরে তারা ৭টিতেই অংশ নিয়েছে। আর ১৯৮০ সাল থেকে ৭টির ভেতর ৫টিতেই অংশ নিয়েছে। ফলে বাসদ আগাগোড়া একটি নির্বাচনমুখি গোত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। মার্কসবাদি লেনিনবাদি মাওবাদি পার্টিগুলোকে সব রকমের সংগ্রামকে আয়ত্ত্ব করতে হবে। একমাত্র অস্ত্রের মাধ্যমে সংগ্রামটাই শ্রেণিসংগ্রাম নয় তবে যারা চার দশকে একবারো অস্ত্র ধরবে কীনা এই নিয়ে পার্টিতে বিতর্ক করতে পারে না তারা যে পাঁড় সংশোধনবাদি এবং লেনিনবাদ-মাওবাদবিরোধি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেনিনবাদের শিক্ষাটাই এখানে যে ডুমা বা সংসদে অংশ নেয়া, সেটিকে জনমত তৈরিতে বিপ্লবের পথে কাজে লাগানো এবং সেটাকে শুয়োরের খোয়াড় বলে ত্যাগ করা। কিন্তু যারা ঐখানে ঢুকে জীবনব্যাপী শুয়োর বনে যায় এবং নিজেদের নামের আগে কমরেড শব্দটি বাদ দেয় না তারাই সমাজ গণতন্ত্রী। খালেকুজ্জামান মতবাদিক বিতর্ক–৩-এ বলছেন,

“১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল – বাসদ আত্মপ্রকাশের পর গত ৩২ বছরের সংগ্রামে দলটি একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করতে সমর্থ হয়েছে। একটি বিপ্লবী দল হিসেবে আপোষকামীতা এবং হঠকারিতা এই উভয়বিধ পেটিবুর্জোয়া প্রবণতাকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করে একটা ধারাবাহিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় বাসদ সমাজের বিভিন্ন স্তরে-পর্যায়ে এ স্বীকৃতি লাভ করেছে, বিশেষ করে বাম মহলে”।[৫]

সংসদপন্থী খালেকুজ্জামানের ব্যবহৃত শব্দগুলো একটু বোঝার চেষ্টা করলেই দেখা যাবে বাম মহলে তার ভুয়া-সাম্যবাদী দলটি উল্লেখিত সময়ে একটা ‘বিশিষ্ট’ স্থান অধিকার করেছে বলে তিনি জানাচ্ছেন। বাংলাদেশের বাম মহলের এই বিশিষ্ট স্থানটি স্পষ্টত্বই হলো নগরকেন্দ্রীক ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও পেশাজীবিদের মহল। আর বাসদের ক্ষেত্রে এটা আরো সত্য এ কারণে যে, এই দলটির শুধু ছাত্রদের মধ্যে কিছু সমর্থক রয়েছে। বাসদ যে “শিক্ষিত”, “ভদ্রস্থ” পেটি-বুর্জোয়া ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবীদের ভিতরে ঢুকেছে এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কার্যসূচি হাজির করেছে তারও বিশেষ কারণটি আছে এই দলটির দৃঢ় মার্কসবাদবিরোধী অবস্থানের ভেতরে। অথচ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারের ১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস এইসব সমাজতন্ত্রপন্থীদের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন,

“১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্র ছিল বুর্জোয়া আন্দোলন আর কমিউনিজম শ্রমিক শ্রেণির। অন্তত ইউরোপ মহাদেশে সমাজতন্ত্র ছিল “ভদ্রস্থ”, আর কমিউনিজম ছিল ঠিক তার বিপরীত।… … তাই দুই নামের মধ্যে কোনটা আমরা নেব সে সমন্ধে কোনো সংশয় ছিল না। তাছাড়া আজ পর্যন্ত আমরা এ নাম বর্জন করার দিকেও যাইনি”।[৬]

বাসদ যে পার্টির নাম কমিউনিস্ট পার্টি না রেখে লেনিনের তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে সমাজতান্ত্রিক পার্টি রেখেছে তার মূলে রয়েছে এদের লেনিনবাদবিরোধী অবস্থান। নামকরণের দিক থেকেও প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর পার্টিকে যে কমিউনিস্ট পার্টি নাম গ্রহণ করতে হবে সে বিষয়ে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সুস্পষ্ট ঘোষণার উল্লেখ আমরা পাই তার দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্তে, তাতে বলা হয়েছে যে,

“কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে যোগদানেচ্ছু প্রতিটি পার্টিকে নাম নিতে হবে: অমুক দেশের কমিউনিস্ট পার্টি (তৃতীয় আন্তর্জাতিকের শাখা)। নামের প্রশ্নটা নিতান্ত একটা বাহ্যানুষ্ঠানের ব্যাপার নয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন। সমগ্র বুর্জোয়া জগৎ ও সমগ্র পীত সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক পার্টির সঙ্গে চূড়ান্ত সংগ্রাম ঘোষণা করেছে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক। কমিউনিস্ট পার্টি এবং শ্রমিকশ্রেণীর ঝান্ডার প্রতি বেইমান সাবেকী ‘সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক’ বা ‘সোশ্যালিস্ট’ পার্টির মধ্যে তফাৎ কী সেটা প্রতিটি সাধারণ মেহনতীর কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা আবশ্যক।”[৭]  

তাছাড়া এপ্রিল থিসিসের ‘কী হওয়া উচিত আমাদের পার্টির নাম যা হবে বৈজ্ঞানিক বিচারে যথাযথ এবং প্রলেতারিয়েতের চিন্তা রাজনীতিগতভাবে স্পষ্ট করতে সহায়ক’ শিরোনামের ১৯ নং থিসিসে লেনিন বলেছেন,

“এখন আমি আসছি শেষের দিকটায় আমাদের পার্টির নাম। আমাদের নিজেদের অভিহিত করতে হবে কমিউনিস্ট পার্টি বলে-ঠিক যেমন মার্কস এবং এঙ্গেলস অভিহিত করতেন নিজেদের।”[৮]

বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল তথাকথিত বাম মহলে ধর্মব্যবসায়ীদের প্রচুর বকাঝকা করা হয়। এসব বামপন্থীরা ধর্মব্যবসা দেখেন, কিন্তু গণতন্ত্রব্যবসা ও সমাজতন্ত্রব্যবসা দেখেন না। গণতন্ত্রের নাম নিয়ে লীগ-বিএনপি যে গোটা দেশটারে চুইষ্যা খাচ্ছে তার জন্য কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি বাংলাদেশের বাম মহলে খুব সামান্যই আছে, কেননা এই বামপন্থীদের অনেকেই শুধু সমাজতন্ত্রের কথাই বলে না, সাথে নানারকম ব্যবসা যেমন শেয়ারব্যবসা, পরিবহন-ব্যবসা, ফ্ল্যাট ব্যবসা, হাউজিং ব্যবসা, পাহাড়ে জমি কিনে ব্যবসা ছাড়াও আরো নানা ব্যবসা করে; যেই ব্যবসার নাম হতে পারে সমাজতন্ত্রব্যবসা। যারা শুধু ধর্মব্যবসা দেখে; গণতন্ত্রব্যবসা সমাজতন্ত্রব্যবসা দেখে না তারা কেমনে মার্কসবাদী হয় তা আমাদের জানা নেই।

আরো পড়ুন:  জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নৌযান, কার্গো ও চিংড়িঘের মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করছে

বাসদ বারবার বলে তারা প্রাকটিসে আছেন, মাঠে আছেন। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, তত্ত্বহীন অনুশীলন অশ্বডিম্ব দেয়। চার দশক ধরে শুধু “ভ্যানগার্ড” বা “সাম্যবাদ” বেচা আর মাস কালেকশন (চাঁদা আদায়) করা আর অফিস দখল করা, মাসে একটি মিছিলের রিহার্সাল দেয়া, বছরে সমর্থকদের নিয়ে একদিন সমর্থক ফোরামের নামে খাই দাই আর নিজেদেরকে দেশের একমাত্র খাঁটি বিপ্লবী হালাল পার্টি ঘোষণা করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার নাম মার্কসবাদী অনুশীলন হতে পারে না। রানা প্লাজা ধ্বসের পর এক দিনের হরতালটা সুবিধাবাদী সিপিবির কারণে স্থগিত করেছিল বাসদ, সেই হরতাল আর এই সুবিধাবাদীরা দিলো না। কারণ এসব ভুয়া কমিউনিস্টরা এখন Dont Disturb Hasina নীতিতে আছে।

বাসদ এবং অন্যান্য বাম সুবিধাবাদীরা আওয়ামি লিগ-বিএনপিকে ক্ষমতায় রেখেই তারা সব সমস্যার সমাধানের জন্য তাদের দিকেই আহ্বান জানায়। যেমন, বাসদের সাত দফা দাবির প্রথম দফায় তারা দেশীয় ক্ষমতাসীন দল দুটির কাছে দাবি জানায় যে, তারা ‘সব হাতে কাজ চায় এবং সব মুখে ভাত চায়’। ক্ষমতাসীনদের কাছে তাদের কয়েকটি অনুনয়-বিনয় হচ্ছে ‘অনুপার্জিত আয় বাজেয়াপ্ত কর’, ‘শিল্প-কৃষি ধ্বংসের চক্রান্ত বন্ধ কর’। এইভাবে বাসদের সাত দফা দাবির সব কয়টিই লীগ-বিএনপির কাছে তদবির করে জনগণের পরিস্থিতির একটু উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্যে; যা সব রকমের বিপ্লবী চিন্তা ও প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব কায়েমের বিরোধী।

সমাজগণতন্ত্রী ব্যক্তিরা মুখে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের কথা বলেন, কিন্তু নির্বাচন ও ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে অন্য কোনো ধরনের লড়াইয়ের পথে যান না। সমাজগণতন্ত্রী সান্ধ্যকালিন বিপ্লবীরা এবং অলস আমলাতন্ত্রীরা মূলত  শ্রেণিসংগ্রামকে চুলায় ঢুকিয়ে অফিসে থাকতে পছন্দ করে। খালেকুজ্জামান তেমনি ১৯৮০ সালে সুখে-শান্তিতে সেই যে অফিস খুলে আমলাতান্ত্রিক অফিসার সেজে আরামে দিন কাটাতে আরম্ভ করেছিলেন তা চার দশকে আর থামে নাই। অথচ লেনিন কী বলেছিলেন, মাও সেতুং কী বলেছিলেন তা একটু একটু নজরে নিলেই আমরা দেখবো এইসব সমাজগণতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কী তীব্র ঘৃণা ছিলো তাঁদের নীতিতে। মাও সেতুং বলেছেন,

“বিপ্লবের কেন্দ্রীয় কর্তব্য ও সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে সশস্ত্র শক্তির দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, যুদ্ধের দ্বারা সমস্যার সমাধান। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এই বিপ্লবী নীতি সর্বত্রই প্রযোজ্য, তা চীনদেশেই হোক আর বিদেশেই হোক”।[৯]  

কিন্তু সমাজগণতন্ত্রীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে মূলত শান্তিবাদী, গান্ধীবাদী হয়ে যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় এরা প্রতিক্রিয়াশীল খুনি নেহেরুকেও সমাজতন্ত্রী বলা শুরু করে। তাদেরই সুযোগ্য উত্তরসূরি বাসদ ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব লিগেনপি’ নীতিতে থেকে অর্থনীতিবাদী নীতি বাস্তবায়ন করছে এবং লেনিনবাদকে ছুঁড়ে ফেলেছে। শ্রেণিসংগ্রাম, বিদ্রোহ, শ্রেণিযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, হিংসাত্মক দমন ও নির্যাতন কেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিপ্লবের ক্ষেত্রে অনিবার্য তা লেনিন বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন।  

আরো পড়ুন:  গোত্রভিত্তিক বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের ধারাবাহিক কাজের মূল্যায়ন

শিবদাস ঘোষপন্থী বাসদ ও ভারতের গোত্রভিত্তিক এসইউসিআই মাঝেমাঝেই প্রচার করে ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সূর্যসেন এবং ইলা মিত্রের ত্যাগ, আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবী অবদানের কথা; কিন্তু এই সংশোধনবাদী ভুয়া-কমিউনিস্টরা কখনোই ক্ষুদিরাম ও সূর্যসেনদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী সশস্ত্র লড়াইয়ের কথা বলে না। এইভাবে এরা ‘কথা ও কাজের মধ্যে’[১০]  বিরাজমান পার্থক্যরেখাগুলোকে মুছে ফেলেছে।

এইসব দিক বিবেচনা করে এই দুই গোত্রকে সমাজগণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হিসেবে চিহ্নিত করতে কোনো মার্কসবাদীর বেগ পাবার কথা নয়। অর্থাৎ মার্কসবাদ লেনিনবাদকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া ভুয়া-সাম্যবাদীদের এক চক্রের বর্তমান নাম বাসদ। আর এই চক্রে আছে মার্কসবাদবিরোধী সান্ধ্যকালীন ক্লাবের কিছু কেন্দ্রীয় সদস্য। ১৯৮০ সালের পর থেকে এই সংগঠনটির সকলেই এক পর্যায়ে ছোটে না কী হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না, করে নাক ফোঁসফাঁস মারে নাক ঢুশঢাশ মার্কা শান্তির পায়রা ওড়ানো গান্ধিবাদি হয়ে যায় এবং সেই ধারা এখনো চলমান। আমরা আন্তরিক বিপ্লবাকাঙ্ক্ষী বাসদের কর্মীদেরকে চোখ-কান খুলে মার্কসবাদী দুনিয়াকে দেখার আমন্ত্রণ জানাই।

তথ্যসূত্র ও টিকা

১. প্রতিবেদক, নিজস্ব. “গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য প্রয়োজন.” বামপন্থা ডট কম, 9 Oct. 2013, www.bampontha.com/post_id/930. বামপন্থা পত্রিকার প্রশ্নটি ছিলো: “বিএনপির চাওয়া এবং আপনাদের চাওয়ার তফাত কি ? খালেকুজ্জামান জবাবে বলেন: আলাদা করে বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন আসে নাই, আওয়ামী বিরোধী মনোভাবটা বি এন পির পক্ষে গেছে। এর অর্থ এই নয় যে মানুষ বিএনপিকে সমর্থন দেবে। বিএনপি এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। জনগণ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়, কিন্তু তার মানে এই না যে তারা বিএনপির আদর্শের সাথে একাত্ম। বিএনপি ও আওয়ামীলীগ, একজন ক্ষমতা ছাড়বে না আর একজন ক্ষমতায় থাকতে দেবে না, ঠিক যেন একটা চর দখলের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। ফলে এখানে জনসাধারণ গৌণ হয়ে আছে। এভাবে নির্বাচন হলে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটবে না, সেই কারণে আমরা সিপিবি-বাসদ মিলে সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক শক্তির প্রতি একটা ডাক দিয়েছিলাম- আমদের এই দুই দলের বাইরে একটা কিছু আমাদের প্রয়োজন। সেই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে না উঠলে নির্বাচনের পরও দেশে শান্তি আসবে না। এই অবস্থায় মানুষ একটা আতংকের মধ্যে থাকবে। তাই আমরা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার আহবান জানাচ্ছি সবার কাছে।” একই রকম কথা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জুলাই ৪, ২০১২ তে নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, “বর্তমান আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দ্বি-দলীয় রাজনীতির বাইরে জনগণের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলা।” সূত্র: সুইন, নূরনবী সিদ্দিক. “এক হলো সিপিবি-বাসদ.” বাংলা নিউজ ২৪ ডট কম, 4 July 2012, www.banglanews24.com/politics/news/bd/123968.details.

আরো পড়ুন:  ফ্রানয মেহরিং জার্মানির সমাজ-গণতন্ত্রীর বামপন্থি অংশের তাত্ত্বিক ও নেতা

২. দাস, পার্থ সারথি. “রাজনীতির ছক নির্বাচন ঘিরে.” দৈনিক কালের কণ্ঠ, 9 May 2017, www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/05/09/495489.

৩. প্রতিবেদক, নিজস্ব. “নির্বাচন হয়ে উঠছে প্রহসন, প্রয়োজন আমূল সংস্কার.” নিউজ গার্ডেন বিডি, 22 Mar. 2014, newsgardenbd.com/?p=47639.

৪. খালেকুজ্জামান. “গণতান্ত্রিক সংস্কার ছাড়া পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব নয়.” বাংলাদেশ প্রতিদিন, 24 Dec. 2013, www.bd-pratidin.com/home/printnews/33986/2013-12-25.

৫. খালেকুজ্জামান, মতবাদিক বিতর্ক–৩; প্রাককথন, প্রকাশক-বাসদ; ২৯ মে, ২০১৩; পৃষ্ঠা- ৩।

৬. মার্কস ও এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, ১৮৮৮ সালের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকা

৭. তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে অন্তর্ভুক্তির শর্ত, জুলাই ১৯২০, লেনিন, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐক্য প্রসঙ্গে, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ২৮৯-৯০।

৮. ভি আই লেনিন, এপ্রিল থিসিস, এপ্রিল ১৯১৭।  

৯. মাও সেতুং, যুদ্ধ ও রণনীতির সমস্যা, ৬ নভেম্বর, ১৯৩৮, নির্বাচিত রচনাবলী, প্রথম খণ্ড; পৃষ্ঠা, ২৮০।

১০. ভি আই লেনিন উল্লেখ করেছিলেন কোনো লেখা বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি হিসেবে ‘আমাদের অবশ্যই আপাত ও যথার্থের মধ্যে, বাহ্যিক চেহারা ও মর্মবস্তুর মধ্যে, কথা ও কাজের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা চাই’। ভি আই লেনিন, মার্কসবাদের রঙ্গরস ও সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিবাদ, আগস্ট অক্টোবর, ১৯১৬, এখানে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৬৮ থেকে নেয়া হয়েছে।

রচনাকাল ১০ অক্টোবর, ২০১৩

Leave a Comment

error: Content is protected !!