নীল টেংরাকাঁটা গুল্ম-এর উদ্ভিতাত্ত্বিক নাম হলো Acanthuas ilicifolius Linn. গোত্র একান্থাসী। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপকূলীয় বৈদ্য সমাজে প্রমেহ রোগের মহৌষধ হিসাবে এর ব্যবহার বেশ প্রাচীন এবং ব্যাপক। প্রমেহ রোগটা মানুষকে কুরে কুরে শেষ করে দেয়, কেননা লোকলজ্জার ভয়ে এ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসকের কাছে যায় না। যখন যায় তখন রোগটা দুরারোগ্য হয়ে যায়। গ্রাম্য বাংলায় একটি কথা বেশ পরিচিত, তা হলো, কোনো কঠিন রোগ থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ হলে বলা হয় ‘হাড় গজিয়েছে’; এই উদ্ভিদের ভেষজ গুণের অবদান ঠিক এমনি।
নীল টেংরাকাঁটা গুল্ম-এর বিবরণ:
নীল টেংরাকাঁটা যূথবদ্ধ, স্বল্প ডালপালাযুক্ত চিরসবুজ গুল্ম। এটি ০.৬ থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। এই গুল্ম কণ্টকপূর্ণ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। গাছের গোড়ার দিক কাষ্ঠল অথবা কাণ্ডের মতো মোটা শিকড়বিশিষ্ট। কাণ্ড কোমল, লোমযুক্ত। পাতা আয়তাকৃতি বা উপবৃত্তাকৃতি, কিনারা দাঁতালো, সূক্ষ্মাগ্র বা ট্রামকেট, আরোমশ, কাটাযুক্ত। ফুল নীল, বিপরীত জোড়ায় অবৃন্তক। ফল ক্যাপসুল আয়তাকৃতি, ২.৫ সে. মি. লম্বা, খয়েরি, বীজ চওড়া-ডিম্বাকৃতি, চ্যাপ্টা। গ্রীষ্মকালে ফুল ও ফল হয়।
বিস্তার:
বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চল, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ভারতের মেঘালয়, গোয়া এবং আন্দামান অর্থাৎ আমাদের এ উপমহাদেশের দেশজ এ উদ্ভিদটি উপকূলীয় অঞ্চলের লোনা পানিবিশিষ্ট নদী ও খালের ধারে অযত্নে প্রচুর জন্মে।
স্বভাব: এ গাছটি লোনা পানির ধারে হয় এবং দীর্ঘকাল লোনা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকলে বা প্রতিদিন জোয়ার-ভাটায় ডুবে এবং জেগে উঠলেও গাছের কোনো ক্ষতি হয় না। সে কারণে অযত্নসম্ভূত এ গাছও মাঝে মধ্যে ভাঙন এড়ানোর জন্য নদী বা খালের ধারে। লাগানো হয়। এর খাদ্যমান (Calorific value) অধিক বলে ফুল ফোটার আগে গাছ থেকে কাঁটা ফেলে দিয়ে গবাদি পশুকে খেতে দেয়া হয়।
প্রাচীন গ্রন্থে:
আমাদের এ উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলে এর উপস্থিতি সুপ্রাচীন কাল থেকে বিদ্যমান থাকলেও প্রাচীন কোন সংহিতা, নিঘন্টু বা কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থে এর বিবরণ বা ব্যবহার-সম্পর্কীয় কোনো উল্লেখ দেখা যায় না। অন্যান্য উপকূলীয় গুরুত্বপূর্ণ ওষধি উদ্ভিদের মতো নীল টেংরাকাঁটা প্রাচীন বৈদিকদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে। চিরঞ্জীব বনৌষধি (১১তম খণ্ড) এবং দ্রব্যগুণ সংহিতায় (২য় খণ্ড) এ উদ্ভিদ সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা হয়েছে।
নীল টেংরাকাঁটা গুল্ম-এর ব্যবহার্য অংশ:
সমগ্র উদ্ভিদ: এটি ক্ষার স্বভাবের। মধুর কষায় রস, শীতবীর্য, অজীর্ণ ও অম্লনাশক, মূত্রকারক হৃদ্য। বাতব্যাধি, স্নায়ুশূল, শ্বাস, কাস, মেহ, মেদ, প্রদর, জ্বর, দুর্বলতা, শুক্রমেহ, ছেলেদের বয়ঃসন্ধিজনিত শুক্রবিকার তথা স্বপ্নদোষ ও ধাতুদৌর্বল্যে ফলপ্রদ।
পাতা: পাতার প্রলেপ বাতব্যাধি ও স্নায়ুশূলে; মূল ও গাছের ক্বাথ হৃদরোগ ও হাঁপানিতে উপকারী। এটি কফকে তরল করে বলে কাসি ও পানিতে কাজ করে। অম্লদুষ্টি বা অম্লপিত্তে ক্বাথ বা স্বরস উপকারী।
মূলের ক্বাথ: মূলের ক্বাথ ঈষদুষ্ণ করে তা দিয়ে কুলকুচা করলে দাঁতের ব্যথা ও মুখের ঘা সারে।
শিকড়: এর শিকড় এবং কাচাহলুদের রস একত্রে খেলে প্রমেহ, পূয়মেহ ও স্বপ্নদোষ প্রশমিত হয়। শরীরের বল এবং বর্ণ প্রসাদিত হয় ও লাবণ্য বৃদ্ধি পায়।
উপরক্ত গুণের কারণে উপকূলীয় বৈদ্যগণ মেহমুদার, শুক্রমাতৃকা এবং বৃহৎ বঙ্গেশ্বর প্রভৃতি বটিকা জাতীয় ওষুধের অনুপান হিসাবে প্রায়ই নীল টেংরাকাঁটা ব্যবহার করেন। পূয়মেহজনিত বাতরোগে (gono-arthritis) বিষ্ণুরস, চিন্তামণিরস বা নগেন্দ্র বটিকার অনুপান হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। জিরা এবং চিনিসহযোগে এ গাছের ক্বাথ অম্ল উদ্গীরণসহ ডিস্পেপশিয়ায় উপকারী। মূত্রকারক হিসাবে এটি শোথ এবং পিত্তস্ফীতিতে উপকারী।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ৪৪-৪৫।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Vengolis
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।