গোল মরিচের পরিচিতি: গোল মরিচ পিপারাসি পরিবারের পিপার গণের বহুবর্ষজীবী আরোহী। এরা ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা, শাখাসমূহ স্ফীত পর্ববিশিষ্ট, বীরুৎ, শাখাসমূহ স্ফীত পর্ববিশিষ্ট, আরোহী সহায়কের সহিত দৃঢ় সংলগ্ন হওয়ার জন্য পর্ব থেকে অস্থানিক মূল গজায়। পাতা সরল, একান্তর, ডিম্বাকার-ভল্লাকার, মসৃণ, চর্মবৎ, ৮-১০ X ৪-১২ সেমি, অখন্ড, পাদদেশ তির্যক থেকে গোলাকার, অগ্রভাগ দীর্ঘাগ্র, উপরের পৃষ্ঠ উজ্জ্বল গাঢ় সবুজ, নিমপৃষ্ঠ ফ্যাকাশে এবং ঘন গ্রন্থিল বিন্দুবিশিষ্ট, ৫-৯ শিরাল, পত্রবৃন্ত ২-৫ সেমি লম্বা।
পুষ্পমঞ্জরী স্পাইক, তির্যক বা আনুভুমিক শাখার পত্রের প্রতিমুখ প্রতীয়মান, ৩-১৫ সেমি লম্বা এবং ৫০-১৫০টি পুষ্পবিশিষ্ট। পুষ্পপুট অনুপস্থিত। পুং স্পাইক সরু এবং ২-৪টি পুংকেশরবিশিষ্ট, পুংদন্ড সরু, পরাগধানী দ্বি-কোষী। স্ত্রী স্পাইক বেলনাকার, গর্ভাশয় অধিগর্ভ, গর্ভদন্ড খাটো, গর্ভমুণ্ড ৩-৫টি, ডিম্বক একক, খাড়া। ফল। গোলকাকার ড্রুপ, ৪-৫ মিমি ব্যাসবিশিষ্ট, পরিপক্ক অবস্থায় লাল। বীজ গোলকাকার, ৩-৪ মিমি ব্যাসবিশিষ্ট। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে আগষ্ট-ডিসেম্বর মাসে।[[১]
এই গোলমরিচ লতানো গাছ হলেও অন্য গাছের আশ্রয় ভিন্ন এরা বাড়ে না। এই গণের লতাজাতীয় কয়েকটি গাছের পূর্বে শিকড় বেরোয় এবং ঐ শিকড়গুলি গাছকে আকড়ে ধরে রাখে। এই লতাগাছ ৫ থেকে ৭ বৎসরের হলেও বড়জোর আঙ্গুলের মতো মোটা হয়। পাতা আকারে প্রায় মিঠে পানের মতো। এর ফুল ফল সম্পর্কে একটি বিশেষ বক্তব্য আছে-
পটল গাছের (Trichosanthes dioica) মতো এই (piper) গণের গাছে কোনোটিতে পুংপুষ্প থাকে, কোনোটিতে স্ত্রীপুষ্প থাকে; কদাচিৎ এই লতায় দুই রকম ফল দেখতে পাওয়া যায়। বায়ুর দ্বারা এদের মিলনকার্য সাধিত হয়, এইজন্য এদের পুষ্পিত ঋতুতে (season) সাধারণত যেদিকে বায়ু প্রবাহিত হয়, তারই অনুকূলে বা সেই পাশে এই রাঁড়া লতা অর্থাৎ পুংপুষ্পর লতা গাছকে লাগানো হয়। যেমন এক একটা বাগানভরা পিপুল গাছ কিন্তু কোনো গাছে একটিও পিপুল নেই; আবার এইভাবে মিশ্র পুংপুষ্প ও স্ত্রীপুষ্প লতাগাছ একত্রে যেখানে আছে, সেখানে অজস্র পিপুল জন্মে ; তেমনি গোলমরিচের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা।[২]
ক্রোমোসোম সংখ্যা: 2n = ৩৬, ৪৮, ৫২, ৬০, ৬৫, ৭৮, ১০৪, ১২৮ (Kumar and Subramaniam, 1986).
গোল মরিচের চাষের পদ্ধতি:
কর্তিত কান্ডের মাধ্যমে, বীজের মাধ্যমেও বংশবিস্তার করে থাকে। আম, কাঁঠাল, কাজুবাদাম, মাদার, সুপারি প্রভৃতি গাছের তলার মাটিতে মরিচ লতার ডগা শিকড়সহ বসানো হলে। আস্তে আস্তে পাতা গজিয়ে ঐ লতা বেড়ে যেতে থাকে, ঐ পাতার ও লতার পূর্ব থেকে শিকড় বেরিয়ে গাছকে আকড়ে ধরে উঠে যায়। এইভাবে ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্তও উঠতে পারে, তবে ১০ থেকে ১২ ফুটের বেশি উচুতে এদের উঠতে দেওয়া হয় না। ৩ থেকে ৪ বছর পরে এইসব গাছে গোলমরিচ হতে শুরু হয়; তারপর থেকে ৩ থেকে ৪ বছর বেশি পরিমাণ গোলমরিচ জন্মে; ফল হওয়া কমে গেলে ওগুলিকে কেটে ফেলে আবার নতুন গাছ ঐ গাছের তলায় লাগানো হয়।
আহরণ কাল: মরিচ ফল ডাঁসা অবস্থায় বা পাকার পূর্বোবস্থায় সংগ্রহ করা হয়, তারপর তাকে রোদে বা মৃদু উত্তাপে শুকিয়ে নিলেই প্রচলিত গোলমরিচের অবস্থায় এসে যায়। সা মরিচ বা সাদা মরিচ প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে মরিচ ফল পাকলে লাল হয়, সেই পাকা মরিচগুলি জলে র’গড়ে ওপরের খোসাগুলিকে তুলে দেওয়া হয় এবং রোদে শুকানো হয়। অনেক সময় ক্লোরিনের জলে একে ধুয়ে সাদা করা হয়। তবে এটা ঠিক, সাদা মরিচ অপেক্ষাকৃত ঝাল কম।[২] খণিজ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ছায়াযুক্ত স্থান।
বিস্তৃতি: আদিনিবাস ভারতের কেরালা রাজ্যের ওয়েষ্টার্ন ঘাট এবং ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, চীন, জাপান এবং শ্রীলংকায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ইহা সিলেট ও চট্টগ্রাম জেলায় চাষ হয়।[১] পূর্বে বোম্বাই প্রদেশের কানাড়া জেলার জঙ্গলে গোলমরিচ আপনা আপনিই হয়ে থাকতে দেখা গেলেও তার পূর্ব থেকেই ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ঐসব অঞ্চলে চাষ হয়ে আসছে; এ ভিন্ন মাদ্রাজের পশ্চিম উপকূলভাগে আর্দ্র ভূমির অঞ্চলে এর চাষ করা হয়ে থাকে; তাছাড়া মালাবারেও ব্যাপকভাবে একে উৎপন্ন করা হয়[২]
গোল মরিচের অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব
ইহার ফল ঝাঁঝালো স্বাদবিশিষ্ট, পাকস্থলীর বায়ুনাশক, বলকারক, ঋতুস্রাবজনিত অসুস্থতা দমনকারী এবং এক প্রকার কোমল চুলকানি প্রতিরোধী হিসেবে বাহ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয়। ইহার ফল ঠান্ডা, কাশি, এ্যাজমা, গলা ব্যাথা, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, পাকস্থলির শোথ রোগ এবং অ্যানিমিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় এবং গুঁড়া কৃমি দূর করতেও উপকারী। ফল থেকে প্রস্তুত কৃাথ হালকা গলা ব্যাথা এবং গলাভাঙ্গায় এক প্রকার উপকারী গার্গেল (গড়গড় করা) হিসেবে কাজ করে। পানি মিশ্রিত ফলের ক্বাথ দন্তশূল উপশমে বাহ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয় (Ghani, 2003).
জাতিতাত্বিক ব্যবহার: আমাশয় নিরাময়ে শিকড়ের নির্যাস সেবন করা হয় এবং ভারতের জাতাপাস ও খোন্দ আদিবাসীরা বমনকারক হিসেবে গোল মরিচ ব্যবহার করে থাকে। বাগাতাস এবং পোর্জাস আদিবাসীরা শিকড়ের পেষ্ট দন্ত শূলে ব্যবহার করে থাকে। কিন্দা ডোরাস এবং নুকা ডোরাস আদিবাসীরা ইহার পাতার রস ঠান্ডা লাগা এবং কাশিতে ব্যবহার করে থাকে (Rama and Henry, 1996).
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) গোল মরিচে প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে গোল মরিচে সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে অজপাড়া গাঁয়ে ইহার চাষাবাদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।।
তথ্যসূত্র:
১. এম আহসান হাবীব, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৯ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩৯৫-৩৯৬। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
২. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১১৬।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dan Lundberg
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।