সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন শ্রীহট্ট জেলার (বর্তমানে সিলেট) করিমগঞ্জে (বর্তমানে ভারতের অন্তর্ভুক্ত)। পিতা–খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দর আলী, মাতা-আমতুল মন্নান খাতুন। পিতা সিকান্দর আলী ডাক বিভাগে ‘পেইড এপ্রেন্টিস’ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতাবলে স্পেশাল সাব রেজিস্ট্রারের পদ লাভ করেন। সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। শৈশব কৈশোর থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী, জেদি আর প্রতিভাদীপ্ত।
শিক্ষাজীবন ও শৈশব:
সৈয়দ মুজতবা আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা শহরের পাঠশালায়। পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে কর্মস্থল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও পরিবর্তিত হতে থাকে। তিনি ১৯১৫ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯১৮ সালে ভর্তি হন সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহবানে ভারতজুড়ে পালিত হয় অসহযোগ আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে সিলেটে। সেই সময় এক ছাত্র ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে সরকারের অন্যায় আচরণে ক্ষুব্ধ কিশোর মুজতবা সরকারি স্কুলে অধ্যয়ন থেকে বিরত থাকেন। তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র, ক্লাসে প্রথম। এরপর কিছুদিন তাকে ঢাকায় অবস্থান করতে হয়, পিতার নির্দেশে।
শান্তিনিকেতন:
১৯১৯ সাল ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনের স্মরণীয় বছর। ওই বছরের মার্চ মাসে গোবিন্দ নারায়ণ সিংহের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) সিলেটে আসেন। রবীন্দ্রনাথকে চাক্ষুস দেখতে পেয়ে ও তাঁর বক্তৃতা শুনে অভিভূত হন কিশোর মুজতবা আলী। রবীন্দ্রনাথ দুই দিনের সফরে বাঙালির ‘সাধনা’ ও ‘আকাক্ষা’ শীর্ষক দুটি বক্তৃতা দেন। মুজতবা আলীর চেতনায় দ্বিতীয় বক্তৃতাটি দারুণভাবে নাড়া দেয়। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তিনি চিঠি লিখেন রবীন্দ্রনাথকে। মুজতবার প্রশ্ন ছিল, আকাক্ষা উচ্চ করতে হলে কী করতে হবে? রবীন্দ্রনাথও চিঠির প্রত্যুত্তর দেন, যা মফস্বলবাসী এক কিশোরের জন্য ছিল অনন্য প্রাপ্তি।
সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে আসমানি রঙের খামে ও কাগজে স্বহস্তলিখিত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানান, আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করার অর্থ স্বার্থসিদ্ধি নয়। দেশের মঙ্গল ও জনসেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ কামনাই মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। এই চিঠি মুজতবার চেতনালোকে দারুণ আলোড়ন তোলে।
১৯২১ সালেই তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় শান্তিনিকেতনে যান; এবং ভর্তি হন শান্তিনিকেতনের স্কুল বিভাগে। বিশ্বভারতী তথনও স্থাপিত হয়নি। ছয় মাস পর বিশ্বভারতীর কলেজ বিভাগ চালু হলে তিনি সেখানে যোগ দেন। মুজতবা আলীর সাহিত্যবোধ গঠনে শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথের ছিল গুরুত্বপূর্ণ । রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য তো বটেই, তাঁর রচনাশৈলীতেও রবীন্দ্রপ্রভাব বিদ্যমান। এমনকি তার হস্তাক্ষরও ছিল রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরের মতো। শান্তিনিকেতনে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করার পর ১৯২৬ সালে সৈয়দ মুজতবা আলী। বিশ্বভারতী থেকে প্রথম স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৭ সালে বিশ্বভারতীর প্রথম সমাবর্তনে আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রনাথের হাত থেকে স্নাতক -ডিগ্রির সনদপত্র গ্রহণ করেন তিনি। কিন্তু ওই সময় জার্মানি ছাড়া বিশ্বভারতীর ডিগ্রি অন্য কোথাও স্বীকৃতি লাভ করেনি, এমনকি ভারতেও না। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে প্রথাগত ম্যাটিক পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা হলে মুজতবা আলী তাতে অংশ গ্রহণ করেন এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
প্রবাস-জীবন:
শান্তিনিকেতনের পর আলীগড়ে আই.এ. শ্রেণিতে ভর্তি হন সৈয়দ মুজতবা আলী। সেখানে তাঁর মন টেকেনি। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে কাবুলের আমির আমানুল্লা শিক্ষাসংস্কারের উদ্দেশে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করলে মুজতবা ১৯২৭ সালে কাবুলের শিক্ষাদপ্তরে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু প্রগতিশীল রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে কাবুলের ধর্মধ্বজী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি। ১৯২৯-এ বাচ্চাই সেকাও কাবুলের সিংহাসন দখল করে। প্রতিকূল পরিবেশে মুজতবা দেশে ফিরে আসেন। ওই বছরেই মুজতবা আলী ‘হুমলট’ বৃত্তি পেয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য জার্মানিতে যান। সেখানে তিনি প্রথমে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে, পড়ে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯২৯-৩০,১৯৩০-৩১) অধ্যয়ন করেন। ১৯৩১ সালে বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিলো ‘The origin of the khojahs and their religious life Today’। ওই বছরই তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৩৪ সালে যান ইউরোপ সফরে। দেশে ফেরার পথে মিশরে নেমে যান। ১৯৩৪-১৯৩৫ সালে তিনি মিশরের কায়রো শহরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।
কর্মজীবন:
১৯৩৫ সালে বরোদার বিদ্যোৎসাহী ও প্রগতিশীল মহারাজা সয়াজি রাওয়ের আমন্ত্রণে দেশে ফিরে মুজতবা আলী বরোদা কলেজে যোগ দেন। ১৯৩৫- ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যাপনা করেন তিনি। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে মুজতবা আলী তার নিজ জন্মভূমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৪৭ সালে সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সংসদ আয়োজিত আলোচনা সভায় পূর্বপাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক বক্তৃতায় সুস্পষ্টভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৮ সালে কলকাতার চতুরঙ্গ পত্রিকায় এই বক্তৃতা নিবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়।
১৯৪৯ সালে তিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু মুসলিম লীগপন্থীদের বৈরী আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তার অবস্থানের কারণে সরকার কৈফিয়ত তলব করলে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দেন। স্বল্প সময়ের জন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এরপর ‘অলইন্ডিয়া রেডিও’র স্টেশন ডাইরেক্টর (এসডি) হিসেবে যোগ দেন (১৯৫৩)। পরবর্তীকালে ইসলামি সংস্কৃতির প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন বিশ্বভারতীতে। কর্মসূত্রে মুজতবা আলী এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি বহুভাষা জানতেন। ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত, গুজরাটি, মারাঠিসহ প্রাচ্যপ্রতীচ্যের প্রায় পনেরেটি ভাষায় দখল ছিল তাঁর।
সাহিত্যসাধনা:
ছাত্রজীবনেই মুজতবার সাহিত্যপ্রীতির উন্মেষ ঘটে। শৈশবাবস্থায় অগ্রজ সৈয়দ মুর্তজা আলীর সঙ্গে তিনি যৌথভাবে বের করেন হাতে-লেখা পত্রিকা কুইনিন। পারিবারিক পরিসরও ছিল সাহিত্যচর্চার উপযোগী। এক্ষেত্রে অন্যতম প্রণোদনা যুগিয়েছেন তাঁর পিতামহ সৈয়দ মোস্তফা আলী। অবশ্য প্রকৃত অর্থে মুজতবার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নকালেই ১৯২৩ সালে বিশ্বভারতীর দেয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নেড়ে’ গল্পটির মাধ্যমে গদ্যশিল্পী মুজতবার দীপ্র আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর তিনি লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধসহ বিভিন্ন আঙ্গিকের গদ্যসাহিত্য। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি পরিচিতি ও সিদ্ধি অর্জন করেন ভ্রমণসাহিত্যিক হিসেবে।
তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণগ্রন্থ দেশে বিদেশে প্রকাশিত হয় ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে। পঞ্চতত্র (১৩৫৯) তাঁর প্রবন্ধ-গল্পসংকলন। তাঁর গল্পগ্রন্থ প্রধানত তিনটি: চাচা-কাহিনি (১৩৫৯), দ্বন্দ্বমধুর (রঞ্জন-এর সঙ্গে যুগ্মভাবে, ১৩৬৫) এবং শ্রেষ্ঠগল্প (১৩৬৮)। এছাড়াও তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ময়ূরকণ্ঠী (১৩৫৯), অবিশ্বাস্য (১৩৬১), জলে ডাঙ্গায় (১৩৬১), ধূপছায়া (১৩৬৪), চতুরঙ্গ (১৩৬৭), শবনম (১৩৬৭), ভবঘুরে ও অন্যান্য (১৩৬৯), বহুবিচিত্র (১৩৬৯), টুনিমেম (১৩৭০), বড়বাবু (১৩৭২), দু-হারা (১৩৭২), হাস্য মধুর (১৩৭৩), পছন্দসই (১৩৭৪), রাজা উজীর (১৩৭৬), লহর ইয়ার (১৩৭৬), হিটলার (১৩৭৭), মুসাফির (১৩৭৮), তুলনাহীনা (১৯৭৪) ইত্যাদি। ১৯৮৯ সালে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নরসিংহদাস সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
মৃত্যু:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তিনি কলকাতায় অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তাঁর পরিবার-স্বজন বাংলাদেশে অবস্থান করায় তিনি দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন। ১৯৭২ সালে ঢাকায় আসে। ১৯৭৪ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানে স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত হন।
তথ্যসূত্র:
১. ভাষাপ্রকাশ নির্বাচিত শ্রেষ্ট গল্পমালা , সৈয়দ মুস্ততবা আলী, শ্রেষ্ট গল্প; ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬; পৃ: ২৩৭-২৪০।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।