রাজনৈতিক দলে নেতৃত্ব নির্বাচনের সমস্যাবলী প্রসঙ্গে

রাজনৈতিক দলে (Political party), রাজনীতির বিভিন্ন সংগঠনে বা অন্য যে কোনো প্রকার সংঘ ও সংগঠনে নেতা নির্বাচন করা সামাজিক কাজ হিসেবে মানুষের জন্য একটি জটিল কাজ। রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের বিভিন্ন পদ নিয়ে দলীয় নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে। এ দ্বন্দ্বকে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বলা হয়। রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব মতামতকেন্দ্রিক, স্বার্থকেন্দ্রিক, আদর্শকেন্দ্রিক বা শ্রেণিকেন্দ্রিক হতে পারে। যেমন, কোনো একটি রাজনৈতিক দলে দুজন ব্যক্তি দলীয় প্রধান হতে চান। ফলে তাদের মধ্যে মতের ভিন্নতা তৈরি হবে; তাদের কর্মপদ্ধতি, কর্মপ্রক্রিয়া ও যোগাযোগের প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে, একজন অপরজনের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেন। এমনকি একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ কুৎসা ইত্যাদি জানাতে পারেন। এসবের ফলে রাজনৈতিক দলটির শক্তিক্ষয় ঘটতে পারে। জনগণ দুজন নেতারই পক্ষে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হতে পারে। নেতৃত্বের এই সমস্যার ক্রমাগত সমাধান করতে হয় মূলত পার্টির ঐক্যের স্বার্থে। এই প্রসঙ্গে ভি আই লেনিন বলেছেন,

“কর্মসূচি ও রণকৌশলের প্রশ্নে ঐক্য অবশ্য প্রয়োজনীয় কিন্তু পার্টি ঐক্য ও পার্টি কাজকর্মের কেন্দ্রীকরণের জন্য তা যথেষ্ট নয়। … … তার জন্য এছাড়াও  সংগঠনের ঐক্য দরকার; পারিবারিক চক্রের চেয়ে খানিকটা বড়ো হয়ে উঠেছে এমন পার্টির মধ্যে আনুষ্ঠানিক নিয়ম ছাড়া, সংখ্যাগুরুর কাছে সংখ্যালঘুর, এবং সমগ্রের কাছে অংশের অধীনতা স্বীকার করা ছাড়া এ ঐক্য কল্পনা করা যায় না। কর্মসূচি ও রণকৌশলের মৌলিক প্রশ্নে যতদিন পর্যন্ত আমাদের মতৈক্য ছিলো না ততদিন পর্যন্ত আমরা খোলাখুলিই একথা স্বীকার করেছি যে, আমরা অনৈক্য এবং বিভিন্ন চক্রের আমলে বাস করছি। আমরা একথাও স্পষ্ট ঘোষণা করেছি যে, মিলিত হওয়ার আগে পারস্পরিক পার্থক্যের সীমারেখা টানতে হবে।”[১]

রাজনৈতিক নেতারাও সামাজিক মানুষ। জনগণের আচার-আচরণ বৈশিষ্ট্য তাদের চরিত্রেও প্রতিফলিত হয়। জনগণ যদি একই সংগঠনের দুজন নেতার পক্ষে দ্বিধাবিভক্ত থাকে তবে সেই দুজন নেতাও পরস্পর প্রতিপক্ষ হয়ে থাকে। আমাদের দেশে নেতৃত্বের মধ্যে এধরনের বিভক্তি প্রচুর দেখা যায়। যেমন মুজিব-মোশতাক, মুজিব-তাজউদ্দিন, ভাসানি-মুজিবের বিভক্তি এধরনের। এছাড়াও দেশের ছোট দলগুলোতে এধরনের বিভক্তি অতীতে প্রচুর ছিল এবং এখনও আছে। যেমন—জাসদে রব-ইনু, বাসদে খালেক-মাহবুব, ওয়ার্কার্স পার্টিতে মেনন-মানিক প্রমুখের এই ধরনের দ্বিধাবিভক্তি ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলোতে একের পর এক বিভক্তি ঘটে নেতৃত্বের এধরনের দ্বন্দ্ব থেকে। এই বিভক্তির কারণ রয়েছে মূলত নৈরাজ্যবাদী বা ‘অরাজকতাবাদী আচরণের মধ্যে, অরাজকতাবাদী বুলিবিলাসে, পার্টি সম্পাদকমণ্ডলীর স্থলে একটা চক্রের’[২], অরাজকতাবাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্রী মতধারার আবির্ভাব পুনরাবির্ভাবে।  

আরো পড়ুন:  গণতন্ত্র সরকারে নাগরিকদের অংশগ্রহণ সমেত রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রূপ

এখন আলোচনা করা যাক এধরনের সমস্যা বাংলা অঞ্চলে কেন ঘটে। বাঙালিদের ভেতরে দেখা যায় কোনো দলে বা সংগঠনে দুজন ব্যক্তি সভাপতি হতে চায়। এর ফলশ্রুতিতে দল বা সংগঠনের নেতাকর্মী সমর্থকরা মোটামুটি দুনেতার পক্ষেই দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সংখ্যা দিয়ে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক। একটি সংগঠনে ‘ক’ ও ‘খ’ দুজন ব্যক্তিই সংগঠনের প্রধান হতে চান। সেই সংগঠনে সদস্য সংখ্যা মোট চল্লিশ জন। দেখা যায়, সদস্যদের ২২ জন ‘ক’ নেতার পক্ষে গেলে ১৮ জন ‘খ’ নেতার পক্ষে যায়। এতে দুজন নেতাই মনে করেন তিনিই অধিক যোগ্য। অথচ যদি ‘খ’ নেতার পক্ষে মাত্র ৫-৬ জন থাকত তাহলে তিনি ভাবতেন তার যোগ্যতা কম। একাধিকবার সংগঠনটির প্রধান নেতা হওয়ার চেষ্টা করে তিনি যদি প্রতিবারই ৫-৭ জনের অধিক সমর্থন না পান তাহলে তিনি সংগঠনের বা দলের প্রধান হওয়ার চেষ্টা বাদ দিতেন এবং মনে করতেন ‘ক’ নেতা তার চেয়ে অধিক শক্তিমান, সমর্থবান ও যোগ্য। ‘খ’ নেতা ৩-৪ বার ব্যর্থ হওয়ার পর মনে করতেন ‘ক’ নেতার অধীনেই তাকে কাজ করে যেতে হবে। এই ঘটনাটি বিপরীতভাবে ‘ক’ নেতার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।

উদাহরণ দিয়ে এবার বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যাক। শেখ মুজিব ও খোন্দকার মোশতাক দুজনই একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন। মোশতাকের সাথে মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল আওয়ামি মুসলিম লিগের সূচনা থেকেই। যখন দুজনই আওয়ামি লিগের যুগ্ম সম্পাদক তখনই কার নাম আগে লেখা হবে এ নিয়ে দুজনের মাঝে ঝগড়া হয়। আওয়ামি লিগের সভাপতি মুজিব হলে মোশতাক মনে করত সেও সেই পদের যোগ্য। মুজিব দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মোশতাক মনে করত সেও প্রেসিডেন্ট পদের যোগ্য। কিন্তু মোশতাক কখনোই পেরে ওঠেনি, কিন্তু আশাও পরিত্যাগ করেনি। শেষ পর্যন্ত মোশতাক ষড়যন্ত্র করে মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে হলেও তিন মাসের জন্য দেশের ও দলের প্রধান হয়েছিল। যদি জনগণ মোশতাককে ভোটে নির্বাচিত না করত, আওয়ামি লিগের একটি বিশাল অংশের নেতাকর্মীরা মোশতাকের পক্ষে না থাকত, যদি নেতাকর্মীরা শুরুতেই মোশতাককে বর্জন করত তাহলে সে দলের ও প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশা পরিত্যাগ করত। মূলত দলের ভেতরে গ্রুপিং চর্চার কারণেই এবং নেতাকর্মীদের বিভক্তির কারণেই মোশতাক ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। মূলত জনগণের ও নেতাকর্মীদের ভুল আচরণের কারণেই মুজিবসহ চার নেতাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।

আরো পড়ুন:  তিনটা ব্যাপকতর গণতন্ত্র

জনগণ ও জুনিয়র নেতৃবৃন্দকে সর্বদাই দুজন বা তিনজন বা ততোধিক নেতার মধ্যে তুলনামূলকভাবে সঠিক, সৎ, যোগ্য, ভাল নেতাকে বেছে নিতে হয়। এটি স্বল্প সময়ের মধ্যেই করতে হয়। তুলনামূলকভাবে যোগ্য নেতৃত্বের পক্ষে জনগণের ও নেতাকর্মীদের অধিকাংশ প্রধান অংশকেই চলে যেতে হয়। এক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্তি দল-সংগঠন বা দেশের পক্ষেও চরম অকল্যাণকর ও ক্ষতির কারণ হতে পারে। আগের উদাহরণে আমরা দেখলাম যেহেতু মোশতাকের পক্ষে বেশকিছু নেতা ও তার এলাকার অধিকাংশ কর্মীই সব সময় ছিল তাই মোশতাকও ভেবেছে সেও প্রেসিডেন্ট পদের যোগ্য। ইউরোপে এরকম সমস্যা দেখা দিলে কর্মী, নেতৃবৃন্দ ও জনগণ স্বল্পতম সময়ে তুলনামূলকভাবে যোগ্য নেতার পক্ষে চলে আসেন। কিন্তু বাংলাদেশে নেতাকর্মীবৃন্দ দুজনের পক্ষেই প্রায় সমভাবে বিভক্ত হয়ে যায় যা খুবই ক্ষতিকর।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক মান বৈপ্লবিক করতে হলে নেতাকর্মী ও জনগণের আচরণের বিভক্তি ও চক্রমূলক অরাজকতাবাদী বৈশিষ্ট্যকে পরিত্যাগ করতে হবে। যদি সংগঠনের অভ্যন্তরে দুজন নেতার মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তবে অবশ্যই গোপন ব্যালটের ভোটের মাধ্যমে সমাধানে যেতে হবে এবং কর্মীরা যেন দ্বিধাবিভক্ত না হয় তা বোঝাতে হবে। যে নেতাকে বর্জন করতে হবে তাকে পরিপূর্ণরূপেই বর্জন করতে হবে পরাজিত নেতার পক্ষে সামান্য সমর্থন বা ভোট কম হলে সে নিজেকে যোগ্য মনে করতে পারে এবং পরিশেষে ষড়যন্ত্র করে হলেও প্রধান নেতা হতে চাইবে। ষড়যন্ত্র রুখতে হলে রাজনৈতিক দলসমূহের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা করতেই হবে। কিন্তু এই গণতন্ত্রকে একইসাথে সুবিধাবাদকে বর্জন করে কেন্দ্রীকতাবাদও মেনে চলতে হবে। এই প্রসঙ্গে লেনিন লিখেছেন,

সুবিধাবাদীরা সকলেই হলেন স্বায়ত্তশাসনবাদ, পার্টি শৃঙ্খলার শিথিলতা ও তাকে শূন্যে নামিয়ে আনার দৃঢ় সমর্থক, সর্বত্রই তাদের ঝোঁকের পরিণতি হলো সংগঠন ভাঙার মধ্যে, গণতান্ত্রিক নীতিকে দোষদুষ্ট করে তাকে নৈরাজ্যবাদে পরিণত করায়।”[৩]  

বাংলাদেশে নেতা নির্বাচনে কোনো দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাবাদের উপলব্ধি ও অনুশীলন দেখা যায়নি। ফলে দলের ঐক্য সুদৃঢ় হয়নি। একের পর এক দলসমূহ ভেঙেছে। ফলে যেসব দল ক্ষমতায় থাকে তারাও গ্রুপিং-এ শক্তিক্ষয় করেছে। এই বিষয়ে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, দলীয় ভাঙন ঘটে মূলত দুই লাইনের সংগ্রাম থেকে। এই বিষয়ে লেনিন লিখেছেন, যে পার্টিতে ‘… … আমরা পাচ্ছি সংগঠনের প্রশ্নে পার্টির সুবিধাবাদী অংশ ও বিপ্লবী অংশের সেই একই সংগ্রাম, স্বায়ত্তশাসনবাদের সংগে কেন্দ্রীকতার, গণতন্ত্রের সংগে আমলাতন্ত্রের, সংগঠন ও শৃঙ্খলার কঠোরতা হ্রাসের সংগে কঠোরতা বৃদ্ধির প্রবণতার, অস্থির বুদ্ধিজীবীর সংগে একনিষ্ঠ সর্বহারার মনোবৃত্তির, বুদ্ধিজীবীসুলভ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সংগে প্রলেতারিয় ঐক্যের মধ্যে সেই একই’[৪] সংগ্রামে।  

আরো পড়ুন:  ভোট গণতন্ত্রবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী নীতি

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন জনগণের শত্রু বুর্জোয়া দলগুলো ক্ষমতা সুসংহত করতে পারেনি, দলীয় সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নিজেদের ভেতরেই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। ক্ষমতা সুসংহত করতে না পারার কারণে দেশের অভ্যন্তরে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বেড়েছে। সাম্রাজ্যবাদের দালাল নেতারাও বিদেশিদের ওপর ভরসা করেছে, বিদেশিদের নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে; আর এসবের ফলে দেশের রাজনীতি দুর্বল হয়েছে, দেশের পরাধীনতা দীর্ঘায়িত হয়েছে। এখানে আলোচিত সমস্যাসমূহ মূলত নেতৃত্বের সমস্যা থেকে উদ্ভূত। ক্রমাগত নেতৃত্বের সমস্যাবলী জানা, নেতৃত্বের সমস্যাবলীর ক্রমাগত যৌক্তিক গণতান্ত্রিক সমাধান ছাড়া কোনো জাতি গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে পারে না। জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যাবলী ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন অপরিসীম।[৫]

তথ্যসূত্র ও টিকা:

১. ভি আই লেনিন, এক কদম আগে, দু’কদম পিছে; ফেব্রুয়ারি-মে ১৯০৪; প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১৯৯

২. ভি আই লেনিন, এক পা আগে দু পা পিছে, ফেব্রুয়ারি-মে ১৯০৪; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০১২, পৃষ্ঠা ১৬২

৩. ভি আই লেনিন, এক পা আগে দু পা পিছে, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৩

৪. ভি আই লেনিন, এক কদম আগে, দু’কদম পিছে; পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১৫

৫. নিবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] সম্পাদিত বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা গ্রন্থের বাঙালির অগণতান্ত্রিকতা প্রবন্ধের অংশবিশেষ। এখানে কিছুটা সম্পাদনা ও সংযোজন করা হয়েছে। বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা বইটি বাংলাদেশে রকমারি ডট কম থেকে কিনুন এই লিংকে গিয়ে

রচনাকাল জুন-জুলাই ২০১০, ২১ অক্টোবর, ২০১৭

Leave a Comment

error: Content is protected !!