সাক্ষাতকারে আহমদ রফিক; একুশ একটি জনবিচ্ছিন্ন অনুষ্ঠান

প্রাবন্ধিক, কবি ও কলামিস্ট হিসেবে খ্যাত আহমদ রফিক (জন্ম- ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯) ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনীতির আকর্ষণে সমভাবে আলোড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। প্রগতিশীল রাজনীতির সংগে সংশ্লিষ্টতার কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। পেশাগতভাবে শিল্পব্যবস্থাপনার সাথে একদা যুক্ত থাকা সত্ত্বেও মননের চর্চাতেই তিনি অধিক সমর্পিত। এখন পুরোপুরি সাহিত্যকর্মে সক্রিয়। তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৯২ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার এবং সাহিত্যেক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে পেয়েছেন ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি। ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের বর্তমান সাক্ষাতকারটি আমি তাঁর সিদ্ধেশ্বরী ঢাকার বাসায় ২০০১ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার ২১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সংখ্যার জন্য গ্রহণ করি।

অনুপ সাদি: বাঙালি চেতনা পৃথিবীর সব বাঙালিদের ভেতরে তেমনভাবে কাজ করছে না। অনেক বাঙালির এই অবাঙালিত্বকে কিভাবে দেখছেন?

আহমদ রফিক: ভালোভাবে দেখছি না স্বভাবতই। কারণ, শুধু যে একুশের ভাষা আন্দোলন তাই নয়, একুশের ভাষা আন্দোলন যেমন পরোক্ষে হলেও বাঙালি জাতীয়তার চেতনা নিয়ে গড়ে উঠেছিল তেমনি পরবর্তীকালে ষাটের দশকে, ’৬৮-তে, ’৬৯-এ এমনকি ’৭১-এ পৌঁছে এই বাঙালি জাতীয়তার বোধটিই স্বদেশ চেতনার ভিত্তি তৈরি করেছিল। আজকে যে বাঙালিরা আন্তর্জাতিকভাবে বাইরে যাচ্ছে, বিদেশে যাচ্ছে, কথা বলছে, চাকরি করছে, পড়াশুনা করছে, এই সুবিধাগুলো কিন্তু স্বদেশভিত্তিক। অর্থাৎ জাতির চেতনাভিত্তিক যে ভাষা-ভূখণ্ড তৈরি তার ভিত্তিতেই কিন্তু আজকে বর্তমান প্রজন্মের কিংবা মধ্য প্রজন্মের লোকদের বিদেশে যাওয়া, আন্তর্জাতিকতার সংগে সম্পর্কিত হওয়া। সেই মূল বিষয়টাকে যদি কেউ অস্বীকার করে তার অর্থ—তার স্বার্থ-অন্বেষা, আত্মজিজ্ঞাসা, শেকড় সন্ধান একেবারেই নেই। ঐতিহ্য বলে যে কথাটি আছে সে ঐতিহ্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্ভবত শূন্যের কোঠায়।

অনুপ সাদি: বিষয়ে-সংস্কৃতিতে জাতীয় জীবনে শুদ্ধ বাঙালি চেতনার আধুনিক প্রকাশ ঘটানোর জন্যে কী করা প্রয়োজন?

আহমদ রফিক: শুদ্ধ বাঙালি চেতনার আধুনিক প্রকাশ ঘটাতে হলে তো ঐ বাঙালিত্বের বোধটাকেই যথাযথভাবে বিকশিত করে তুলতে হবে এবং সেটা করতে চাইলে আমাদের সাধারণভাবে দেশ এবং জাতি ভাষা ভূখণ্ড—এগুলোর প্রতি মমত্ববোধ এবং দরদ থাকা দরকার। অর্থাৎ আমি বাঙালি এ বোধটুকু, স্বাদেশিকতার বোধ, স্বজাত্যাভিমান, যদিও আমরা অনেক সময় জাত্যাভিমানকে খারাপই বলি, তবুও এই জাত্যাভিমানের বোধটুকু আমাদের থাকা দরকার। তা না থাকলে একটি জাতির সদস্য হিসেবে, একটি জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে আমাদের কোনো অবস্থান থাকবে না। এমনকি বিদেশে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মর্যাদা পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এই বোধটুকু যদি আমাদের মধ্যে না আসে তাহলে এই জাতীয়তার চেতনা বিকশিত হতে পারে না। আর একটি দিক হলো যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, তার বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাস আছে, সেই দূতাবাসগুলোর কিন্তু এটা দায়িত্ব ও কর্তব্য যে বাঙলা ভাষা, বাঙলা সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতির সাথে বিদেশিদের পরিচিতি করানো। এ কাজটি কিন্তু কোনো সরকারের আমলেই দূতাবাসগুলো করেনি। এটিকে আমি একটি অপরাধ বলে মনে করি।

অনুপ সাদি: বাঙালির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো বাঙলা ভাষা। এ ভাষা টিকে থাকা যদি প্রশ্নের সম্মুখীন হয় তা হলে ভবিষ্যতে ‘বাঙালি’ বলে তো কোনো জাতি থাকবে না। বাঙলা ভাষাকে রক্ষা করা না গেলে তো বাঙালিরই মরণ ঘটবে।

আহমদ রফিক: সেটা তো বটেই, সে বিষয়ে তো সন্দেহের কোনো কারণ নেই। এখন কেউ যদি মনে করে যে আমি বাঙালি থাকবো না; ভালো কথা তারা থাকবে না। কিন্তু কথাটা হলো যে এ ভাষাকে ভিত্তি করে, আমরা বরাবরই কথাটা বলে থাকি যে ভাষা থেকে ভূখণ্ড, এ ভাষাকে ভিত্তি করে এ ভূখণ্ডের ভিত্তিতে এ জনগোষ্ঠীর এখানে অধিবাস এবং সে হিসেবে তাদের পরিচয়। কেউ যদি তার বংশ পরিচয়, জাতি পরিচয় ঘুচিয়ে ফেলতে চায়, সেখানে তো বলার কিছু থাকে না। কিন্তু এই কথাটি শুধু মনে রাখা দরকার যে একটি জনগোষ্ঠীর সদস্যের তার জাতিত্বের পরিচয় দিয়েই কিন্তু বিদেশে তার মর্যাদা। আজকে আমরা এই যে কথাটা বারবার বলি যে বিদেশে বাঙালি বা অন্যান্য দেশের লোকজন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত, বা সেভাবেই তাদের দেখা হয়;—এই সব জিনিসগুলোই কিন্তু নির্ভর করছে জাতির সদস্য হিসেবে তার মর্যাদা যে একটি জাতিসত্তা কতটুকু শক্তিমান হয়ে, কতটুকু সমৃদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই এগুলোকে অস্বীকার করারও যেমন প্রশ্ন আসে না, আর এগুলোকে অস্বীকার করা মানে নিজেকে অস্বীকার করা, আর সেই সঙ্গে এগুলোকে অস্বীকার করবার প্রেক্ষিতে বিদেশে গিয়ে, বাইরে গিয়েও কোনো মর্যাদার সংগে সম্মানের সংগে বসবাস করা চলবে না, চলে না।

আরো পড়ুন:  সাম্যবাদী নেতা ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন জীবন ও যুদ্ধে ছিলেন জনগণের প্রেরণা

অনুপ সাদি: বাঙলা ভাষার জন্য একুশ শতকের নতুন চ্যালেঞ্জ কী কী এবং সেগুলোকে মোকাবিলা করা যায় কিভাবে?

আহমদ রফিক: চ্যালেঞ্জ বলতে যেগুলো আসে তার মধ্যে প্রধানত কথা হলো যে বাঙলা ভাষায় আমরা বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, প্রযুক্তি ইত্যাদির ব্যবস্থা করিনি। অথচ ’৭২ সালে স্বাধীন দেশে একটি দায়িত্ব ছিল শাসক শ্রেণির এবং জনশ্রেণিরও অর্থাৎ নাগরিক সমাজেরও, বুদ্ধিজীবি সমাজেরও যে বাঙলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, প্রযুক্তি শিক্ষার বিকাশ ঘটানো। এই জিনিসগুলো যদি করা হতো তাহলে কিন্তু আজকের এই চ্যালেঞ্জ আমাদের কাছে কিন্তু চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসতো না। কম্পিউটার থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি জিনিসের বাঙলা ভাষার ট্রান্সফরমেশন সহজ হতো। কিন্তু সে কাজটি আমরা করিনি কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন তেমনি মেডিকেল শিক্ষা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও। কোনো শিক্ষার ক্ষেত্রেই আমরা বাঙলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বসাইনি। তার ফলে হয়েছে কি, এখন আমাদের কাছে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু দেশের বিশালসংখ্যক লোক অশিক্ষিত, শিক্ষিত নয়, কাজেই সেই দিক থেকে বিদেশি ভাষার মাধ্যমে যদি সবকিছু শিখতে হয় তাহলে সেটাতো একটা মস্ত বড়ো চ্যালেঞ্জ। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাই।

অর্থাৎ আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিকে যদি বিদেশের সাথে পরিচিত করাতে হয়, সাহিত্যকে অন্য ভাষায় রূপান্তর করতে হয়, রূপান্তর করা বা অনুবাদ করা প্রয়োজনও বিদেশে পরিচিত করতে, তাহলে রূপান্তরের কাজগুলো অবশ্যই করতে হয়। কিন্তু এই ভাষান্তরিত করার কাজটিতে আমরা হাত দিইনি, এটাকে গুরুত্বও দেইনি এবং এ দিকটাই কোনো মনোযোগ দেইনি। ফলে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে; এখন এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা নতুন করে গোড়া থেকেই মোকাবেলা করতে হবে। ………. অর্থাৎ আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে হবে বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিক্ষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভাষাকে বাঙলায় রূপান্তর করতে হবে এবং বিদেশের সংগে অনুবাদের মাধ্যমে ভাষিক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।

অনুপ সাদি: ভাষার বিকাশের প্রয়োজনীয়তা ছিলো উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে। সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রেও ভাষার ব্যাপারটি আসে। বাঙলা ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা মোটেও কঠিন ছিল না। তার জন্য দরকার ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও বিনিয়োগের। প্রয়োজন ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন বই লেখার ও বাইরে লিখিত বইয়ের অনুবাদ করার। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ত্রিশ বছরেও তা করা গেল না। কেন? এক্ষেত্রে বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রতো পাকিস্থানের চেয়েও “নির্মম ও নিষ্ঠুর” ভূমিকা পালন করেছে?

আহমদ রফিক: পাকিস্থানের চেয়ে নির্মম নিষ্ঠুর না হলেও (হাসতে হাসতে) পাকিস্থানের মতোই বলা চলে এ জন্যেই যে, ……… আমরা ’৭২-এ এটাই মনে করেছিলাম যে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিত্তিতে, কাজেই এটিকে আমরা বরাবরই বলি ভাষিক জাতীয়তা এবং ভাষিক রাষ্ট্র, সেই ভাষিক জাতীয়তার রাষ্ট্রে ভাষাকে প্রাধান্য দেয়া হবে, কিন্তু তা দেয়া যায়নি। ভাষিক জাতীয়তার রাষ্ট্রে ভাষাকে প্রাধান্য দেয়া না গেলে কেমন করে হবে? তো এটার দায়িত্ব পুরোপুরি সব সরকারেরই এবং সেই সঙ্গে আমি মনে করি যে কিছুটা দায়িত্ব বুদ্ধিজীবী শ্রেণির, সংস্কৃতিমনস্ক শ্রেণির, তাদের দরকার ছিল সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে বাঙলা ভাষাকে মূল ভিত্তি করে উচ্চ শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, প্রযুক্তি শিক্ষা দেয়া যায়। যার ফলে শিক্ষা গ্রহণ সহজ হবে এবং বিদেশের সংগেও একটা যোগাযোগের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই, চিন ১৯৪৯ সালে স্বাধীন হয়েছে, আমাদের ক্ষমতা হস্তান্তর হলো ’৪৭-এ, তবে আমরা পাকিস্থানের কথা যদি বাদও দেই, দেখা গেল চিন কিছুদিনের মধ্যেই আণবিক শক্তিতে পরিণত হলো এবং তা বিদেশি ভাষার সাহয্যে নয়, নিজের ভাষায়। তো চিনা একটি প্রাচীন লিপি, চিনা ভাষার মতো একটি প্রাচীন লিপি দিয়ে যদি আণবিক শক্তির বিকাশ ঘটানো চলে, মহাকাশে যাওয়া চলে, তাহলে বাঙলা ভাষায় চলবে না কেন? কাজেই যারা একথা বলেন যে, বাঙলা ভাষায় আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো যাবে না তারা মূর্খের সাগরে বাস করেন আর না হয় ইচ্ছা করে তারা বাঙলাকে পেছনে ফেলে রাখতে চান।

অনুপ সাদি: বাংলাদেশের ত্বক উজ্জল, সুস্বাস্থ্যবান, চকমকে পোশাকওয়ালা উচ্চবিত্ত শ্রেণিটি সব সময় বাঙলা ভাষার সংগে শত্রুতা করেছে। এ ভাষার সংগে শত্রুতা করেছে প্রতিটি শক্তিশালী ব্যক্তি, ক্ষমতাশালী শ্রেণি, প্রতিষ্ঠান, সংঘ, প্রশাসনযন্ত্র, সরকার। বর্তমানে তারা আরও অধিক উৎসাহে বাঙলার শত্রুতা করছে। এ শত্রুতার শেষ কোথায়?

আহমদ রফিক: এর শেষ তো নেই, এ শত্রুতাকে যদি ঠেকাতে হয় তাহলে ’৫২ সালে যেমন সেই সময়ের শিক্ষিত শ্রেণির তরুণ প্রতিনিধিরা অর্থাৎ ছাত্ররা তাদের প্রধান দায়িত্ব হিসেবে ভাষা আন্দোলনের কাজটি হাতে নিয়েছিলেন। আজকেই এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এবং এক্ষেত্রে আমি আপনার বক্তব্যের সংগে পুরোপুরি একমত যে ঐ ঘটনাগুলো ঘটছে এবং একটি বিশেষ শ্রেণিস্বার্থের কারণে এই বাঙলাকে পিছে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যেহেতু বাঙলার মূল কথাটি ছিল একটি সর্বজনীন স্বার্থের বিকাশ। সেই সর্বজনীন স্বার্থটি যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হয় সেই উদ্দেশ্যেই কিন্তু এই শিক্ষিত শ্রেণি, এলিট শ্রেণি, বিত্তবান শ্রেণি বাঙলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রই করছে। এই ষড়যন্ত্রকে রুখে দেয়া তো বয়স্কদের দিয়ে হবে না, প্রবীণদের দিয়ে হবে না; আমার ধারণা এই তরুণ সমাজ, ছাত্র সমাজ, শিক্ষিত প্রতিনিধিরা নতুন করে যদি আবার একটি ভাষা আন্দোলনও করে, তাহলেও করতে হবে আর ভাষা আন্দোলন না করতে চাইলে ভিন্ন ফর্মে ভিন্নরূপে তাদের উচিত ভাষার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসা, আন্দোলন তৈরি করা দরকার, সামাজিকভাবে চাপ তৈরি করা দরকার এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা দরকার, যাতে এই শাসক শ্রেণি, বিত্তবান শ্রেণি, এলিট শ্রেণি, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বাধ্য হয় বাঙলাকে গ্রহণ করতে।

আরো পড়ুন:  আবশ্যিক রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজন আছে কি?

অনুপ সাদি: বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে একটি বিশেষ শ্রেণি, উচ্চবিত্ত শ্রেণি। তাহলে বাঙলা ভাষার বিকাশে ধনী-গরীবের বৈষম্যটিও খুব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

আহমদ রফিক: হ্যাঁ করছে। এটাতো আমরা বরাবর বলি, আমি আমার লেখায় বারবার বলেছি যে ভাষা আন্দোলনের একটি প্রধান শ্লোগান ছিল সর্বস্তরে বাঙলা চালু করা; অর্থাৎ জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, অফিসে, আদালতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বত্র বাঙলার ব্যবহার। তার ফলে জনসাধারণ এবং নিম্নবর্গীয় শ্রেণিও ভাষার সংগে একসংগে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো, সাম্য, মৈত্রী বাড়তো, কিন্তু সে কাজটি, যে কথা বলা হলো, শ্রেণি স্বার্থের জন্যেই করা হচ্ছে না।

অনুপ সাদি: আপনি বলছেন সর্বস্তরে বাঙলা চালুর জন্য একটি আন্দোলনের প্রয়োজন। ’৫২র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে আমরা দেখি যে একটি রাজনৈতিক ধারা ছিল যা মানুষকে আরো রাজনীতিমুখী করেছিল। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতি করা মানেই নানা অন্যায় অনাচার নিজেদের মধ্যে বৃদ্ধি করে সু-কৌশলে মানুষকে রাজনীতিবিমুখ অরাজনৈতিক প্রাণিতে পরিণত করা। এ থেকে মুক্তির পথ কি?

আহমদ রফিক: আমি আবারো বলবো যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিশেষ উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত হয়েই ছাত্র সমাজে, ছাত্র রাজনীতিতে যে রাজনৈতিক দলীয় প্রভাব তৈরি করছে এটি শুদ্ধ বিকাশের অন্তরায়। এ সমস্যার, যেটির কথা আপনি বললেন, এক্ষেত্রেও আমি পুরানো কথাতেই ফিরে যাবো যে দলীয় অন্ধতামুক্ত রাজনীতি, সুস্থ রাজনীতি, গণতান্ত্রিক চেতনা নির্ভরশীল রাজনীতির বিকাশের মাধ্যমেই এ সমস্যাটির সমাধান সম্ভব এবং সেখানে ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এ প্রসঙ্গে শুধু আমি একটি কথাই বলবো, একুশের ভাষা আন্দোলন সফল হতো না যদি তাতে দলীয় প্রভাব থাকতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতামতের ছাত্ররা একাট্টা হয়ে একসংগে ভাষা আন্দোলন করেছে। সেখানে রাজনৈতিক মতামত কিন্তু কোনো ছায়া ফেলেনি।

অনুপ সাদি: ভাষা আন্দোলনের চেতনা জাতীয়তাবাদের চেতনা, ভাষা আন্দোলনের চেতনা সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার চেতনা। ভাষা আন্দোলনের চেতনা গণতন্ত্রের চেতনা। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ভাষা আন্দোলনের এ চেতনা খুব অল্প পরিমাণেই বাঙলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে বিশেষ করে প্রধান দু’টি দলের মধ্যে ছিলো। এ চেতনাকে বেগবান করতে কারা কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন?

আহমদ রফিক: আমার তো মনে হয় যে সচেতন বুদ্ধিজীবী লেখক সাংবাদিক সাহিত্যিক এবং ছাত্র সমাজ এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারেন। আর এটাও সত্য দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে যেহেতু তাদের শ্রেণিস্বার্থ খুব বেশি কাজ করছে এবং সেখানে আর তাদের কোনো প্রয়োজন নেই এই বাঙলা ভাষাকে বা বাঙালি চেতনা বা বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর, কাজেই তারা আর এ কাজটি করবে না। এ কাজটি করতে হলে আন্দোলন বলুন, চাপ বলুন সেটা সৃষ্টি করতে হবে। মুখ্যত লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এবং তরুণ সচেতন প্রগতিশীল ছাত্র সমাজের মাধ্যমেই।

অনুপ সাদি: একুশ এখন শুধু জাতীয় মর্যাদার দিন নয়, এটি আন্তর্জাতিক মর্যাদারও। কিন্তু বৃহত্তর জনসাধারণের সংশ্লিষ্টতা ব্যতীত সংস্কৃতির কোনো বিষয়ই জাতীয় বা আন্তর্জাতিক চরিত্র অর্জন করতে পারে না । এক্ষেত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি সম্বন্ধে দেশের নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন জনগণ সম্পুর্ণ অজ্ঞ। তাহলে তো আমরা একুশকে জাতীয় সংস্কৃতিতেই পরিণত করতে পারিনি।

আহমদ রফিক: হ্যাঁ ঠিকই। আমরা একুশকে জাতীয় সংস্কৃতিতেই পরিণত করতে পারিনি; এটা সত্য কথা। আমি এ বিষয় নিয়ে অনেকবার লিখেছিও যে একুশ একটি জনবিচ্ছিন্ন অনুষ্ঠান। ঢাকায় আপনারা যদি একুশের অনুষ্ঠান এই ফেব্রুয়ারি মাস ধরে দেখেন এবং একুশে ফেব্রুয়ারির দিনও দেখেন তাহলে সেখানে নিম্নবর্গীয় শ্রেণির মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, বস্তির মানুষ, ঝুপড়ির মানুষ কাউকে দেখবেন না। উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি, তাদের সাদা র্শাট পরা ছেলেপেলেরা মূল স্রোত তৈরি করেছে। সেজন্যে আমি মনে করি যে, একুশকে বিত্তহীন বা নিম্নবিত্তরা তাদের একুশে বলে মনে করছে না। ……. অথচ ’৫২ সালে যখন আন্দোলন হয়েছিল তারা কিন্তু এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল এবং এই আন্দোলনকে নিজেদের আন্দোলন বলে গ্রহণ করেছিল। আজকে তারা প্রতারিত হয়েই, আমি বলবো, এ আন্দোলনকে এবং একুশকে প্রত্যাখ্যান করেছে, বর্জন করেছে, তারা এটাকে তাদের নিজেদের দিন বলেই মনে করে না। সেজন্যে এই সচেতন শ্রেণিরই উচিত হবে, সংস্কৃতি অংগনের লোকদের উচিত হবে জেলায়, মহকুমায়, থানাসহ গ্রামাঞ্চলে একুশকে পরিচিত করে তোলা, একুশকে তাদের সামনে, তাদের দাওয়ায় তুলে ধরা এবং তার সঙ্গে ওদের শ্রেণির স্বার্থের সম্পর্কটিকে বিসর্জন দিয়ে, সর্বজনীন স্বার্থের সম্পর্কটি… বুঝিয়ে দেয়া। তাহলে আমার মনে হয় সাধারণ মানুষ একুশে সম্পর্কে আগ্রহী হবে এবং এটাকে নিজেদের দিন বলে গ্রহণ করবে।

আরো পড়ুন:  আমরা সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি অর্থের দাপট --- খোন্দকার আশরাফ হোসেন

অনুপ সাদি: একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে স্বাধীনতা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাপারে যেসব সিদ্ধান্ত হয় তার বেশিভাগই লন্ডন, ওয়াশিংটন কিংবা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ এডিবি নেয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসব কিছু মেনে নেয় সোৎসাহে। তারা জনগণের কাছে না গিয়ে আমেরিকান, ব্রিটিশ, ফ্রান্স এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের এম্বাসী ও এম্বাসেডরদের সাথে যোগাযোগ করছে; ঠিক ১৭৫৭ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের মীরজাফর ও অন্যান্য প্রশাসকরা যেমন কাসিমবাজার কুঁঠিতে গিয়ে আলোচনা করতো; এই থেকে বোঝা যায় বাঙলাদেশের স্বাধীতনার ব্যাপারে রাজনীতিকদের একতিলও খেয়াল নেই, যেমন ১৭৫৭ পূর্ববতী ও পরবর্তী শাসকদের খেয়াল ছিল না। বর্তমানের বুদ্ধিজীবীরাও বিভিন্ন এম্বাসিতে নানা রকম যোগাযোগ রাখে। প্রধান দু’টি দলই নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপর আস্থা রাখছে। তাদের দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাস নেই। ভাষা আন্দোলনের এই মাসে আপনার কাছ থেকে এ ব্যাপারে কিছু শুনতে চাচ্ছি।

আহমদ রফিক: আমার মনে হয় যে এটার মূল কারণ হল ক্ষমতার লোভ, রাজনৈতিক স্বার্থ; এবং যে-প্রধান দলগুলোর কথা আপনি বললেন, এই সব দলের ব্যাপারেই কথাটা সত্য। এবং যেহেতু আন্তর্জাতিক পরাশক্তি, তাদের বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা, শ্রমিক সংস্থা, আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, যেগুলোর কথা আপনি বললেন, এগুলোর মাধ্যমেই তৃতীয় বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, একই কারণে নিজেদের ক্ষমতার খুঁটি শক্ত করার জন্যে, ক্ষমতায় থাকার জন্যে প্রতিটি দলই তাদের কাছে মাথা নত করছেন, তারা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছেন, তাদের নিজেদের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছেন, যে কারণে আজও আটাশ বছর অতিক্রম হয়ে গেল স্বাধীনতার পর, একটি জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ ঘটলো না। সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ এখনো ঘটেনি। এখনো সেই সামন্ত অবস্থা থেকে শুরু করে কমপ্রেডর বুর্জোয়া শ্রেণি, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণিই কিন্তু সমস্ত রাজনীতি শাসনযন্ত্র সমস্ত কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সেক্ষেত্রে একটি খাঁটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল যদি দাঁড়ায়, তৈরি হয়, ক্ষমতায় আসে তাহলে বোধ হয় এ কাজটি করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমার কাছে খুব হতাশার, হতাশাব্যঞ্জক মনে হয়, যে জন্যে আমাকে অনেকে বলেন, যে আপনি খুব নৈরাশ্যবাদী। হতাশ হওয়ার কারণ আছে বলে আমি মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে। সেইক্ষেত্রে নতুন করে এরকম একটি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক জাতীয় বুর্জোয়ার বিকাশ ঘটানোর পক্ষে একটি রাজনৈতিক দল যদি গড়ে উঠতে পারে এবং উঠে এবং তারা যদি তৃণমূল স্তর পর্যন্ত তাদের হাত প্রসারিত করতে পারে তাহলেই সম্ভব এদেরকে সরিয়ে দিয়ে একটি খাঁটি দেশপ্রেমিক সরকার এদেশে গঠন করা। সেক্ষেত্রে তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই এদেশকে গড়ে তুলতে পারবে। আমি আশা করি যে ভবিষ্যতে হয়তো তেমন কিছু ঘটবে।

অনুপ সাদি: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আহমদ রফিক: আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ বাংলাবাজার পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সবাইকে। পত্রিকার অগণিত পাঠকদের প্রতিও ধন্যবাদ রইল।

প্রকাশকাল: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০১; বিশেষ সংখ্যা; দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, ঢাকা।

Leave a Comment

error: Content is protected !!