ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন গ্রন্থের ভারতীয় সংস্করণের ভূমিকা, অবতরণিকা ও সূচিপত্র

প্রথম ভারতীয় সংস্করণের ভূমিকা

এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে, ঢাকার বিদ্যাপ্রকাশ প্রকাশনা সংস্থার হাত দিয়ে। এর ভারতীয় সংস্করণ যে বের হচ্ছে তার কারণ ‘ভারতী বুক স্টল’-এর বিদ্যোৎসাহী স্বত্বাধিকারী শ্রী অশোক কুমার বারিকের আগ্রহ। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এর আগে তিনি আমার লেখা শেকসপীয়রের মেয়েরা বইটির ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছেন। নতুন সংস্করণে ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজনের বক্তব্যে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, তবে ভাষার কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে লেখার দরুণ প্রথম সংস্করণে কোথাও কোথাও অমনোযোগের চিহ্ন ছিল, আশা করছি এই সংস্করণে তাদের অধিকাংশই অপসারিত হয়েছে। ধ্রুপদী সাহিত্যের যে নায়িকাদের নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে তারা অনেকেই পাঠকদের পরিচিত। বইতে এরা একসঙ্গে উপস্থিত হয়েছে; তবে এরা সকলেই ভিন্ন, কেউ কারো মতো নয়। এই স্বাতন্ত্রের কারণ যে কেবল লেখকদের অনন্যসাধারণ নিজস্বতা তা নয়, কারণ লেখকদের পেছনকার সমাজ এবং সংস্কৃতিও, নায়িকারা যেমন প্রত্যেকেই অনন্য তেমনি তারা আবার সংস্কৃতির প্রতিনিধিও, যে সমাজ-সংস্কৃতিতে তাদের অবস্থান সেই বাস্তবতার। নায়িকার ধারণা একটি সাংস্কৃতিক ধারণা বটে। তাদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সংস্কৃতির কথাটা তাই নানাভাবে এসেছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী 
৬২/১ ধানমণ্ডি আ/এ
সড়ক ১২/এ 
ঢাকা ১২০৯
৭ জুন, ২০০২

সূচীপত্র

১. প্রথম ভারতীয় সংস্করণের ভূমিকা
২. অবতরণিকা
৩. হোমারের হেলেন
৪. প্রতীক্ষমাণা গৃহিণী
৫. রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একাকিনী
৬. প্রেয়সী নয়, মাতাও নয়
৭. সীতার ধিক্কার
৮. অচরিতার্থ দ্রৌপদী
৯. তরুণী বিধবার পীড়িত হৃদয়
১০. শকুন্তলার জয়
১১. আদি স্ত্রীর প্রথম বিচ্যুতি
১২. ত্রিভুজের প্রথম বাহু
১৩. পলাতকা এমা
১৪. আন্না কারেনিনার আত্মহনন
১৫. নোরা, তুমি যাবে কোথায়
১৬. রবীন্দ্রনাথের নায়িকা

অবতরণিকা

সাহিত্য নায়কপ্রধান। সেটাই স্বাভাবিক। কেননা সাহিত্য পুরুষের সৃষ্টি, প্রধানত। তাছাড়া সত্য তো এটাও যে, ঐতিহাসিক যে-কালে সাহিত্য রচিত হয়েছে সে-কালে সমাজে আধিপত্য পুরুষেরই। এ-বইতে আমাদের কাহিনী শুরু হোমারের হেলেনকে দিয়ে, শেষে আছে রবীন্দ্রনাথের নায়িকারা, এই যে প্রায় আড়াই হাজার বছরের সময় কাল, এই সবটা জুড়েই পুরুষ তার প্রাধান্য অক্ষুন্ন রেখেছে, নারী যতই অভিযোগ করুক না কেন। পিতা স্বামী প্রেমিক ভ্রাতা, এরাই আগে আসে; মাতা স্ত্রী প্রেমিকা ও ভগ্নির তুলনায়। দার্শনিক এ্যারিস্টটল বলেছেন, মেয়েরা হচ্ছে পুরুষের হীন সংস্করণ। সে-তত্ত্ব অবশ্যই ভ্রান্ত: মেধা ও যোগ্যতায় মেয়েরা হীন এটা সত্য নয়; সত্য এটা যে, তাদের সুযোগ কম, সুযোগ তাদেরকে দেওয়া হয় নি। নারীর আত্মপ্রকাশকে নানা ভাবে বিঘ্নিত করা হয়েছে। বস্তুগত বাধা তো রয়েছেই, আদর্শিক বাধাটাও কম নয়। যেমন মাতৃত্ব। মাতৃত্বের প্রাকৃতিক বাস্তবতাটাকে আদর্শায়িত করে এমন ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে যে, নারীত্বের চরম উৎকর্ষ ওইখানেই, সন্তানের লালনপালনেই। পুরুষের বৈষয়িক আধিপত্যের দরুনই এমনটি ঘটেছে, বলাই বাহুল্য।

আরো পড়ুন:  বিদেশিরা বাঁচাতে আসে না, মারতেই আসে; বাঁচতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই

প্রাধান্য নায়কের, তবু নায়িকারা রয়েছে। অসাধারণ কয়েকজন নায়িকা নিয়ে আমাদের এই আলোচনা। বিভিন্ন সময় ও সংস্কৃতি থেকে তারা এসেছে। সেদিক থেকে তাদের মধ্যে পার্থক্য স্বাভাবিক, এবং সেটা সামান্য নয়। এরা প্রত্যেকেই অনন্য, সেই সঙ্গে নিজ নিজ সংস্কৃতি ও সময়েরও তারা প্রতিনিধি বটে। কিন্তু নায়িকারা সকলেই পুরুষের সৃষ্টি। মেয়েরা লেখে নি, এমনকি তাদের নিজেদের কাহিনীও তারা লিখতে পারে নি, সামাজিক ও বৈষয়িক চাপে। সঙ্কোচ তাদের আত্মপ্রকাশকে বিঘ্নিত করেছে।

সাহিত্যের নায়িকারাও পুরুষেরই কল্পনা ও সৃষ্টি। জ্ঞাতে হোক অজ্ঞাতে হোক, পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকেই তাদেরকে দেখা হয়েছে। নরনারীর সম্পর্কের ব্যাপারটি একেবারেই প্রাথমিক। এই সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে প্রেম, বিবাহ এবং বিবাহ-বহির্ভূত যোগাযোগ। এই সম্পর্কগুলো নানাভাবে এসেছে মহাকাব্য, নাটক ও উপন্যাসে।

কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের এই প্রধান লেখকেরা কেবল পুরুষ নন তো, তারা শিল্পীও। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সময়, শ্রেণি ও সংস্কৃতির ছায়া অবশ্যই পড়েছে , তারা যে-পুরুষ এই ব্যাপারটাও অকার্যকর নয়। অবস্থানের বাস্তবতাকে তাদের পক্ষে যে সম্পূর্ণতঃ প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হয়েছে তা নয়। সেটা সম্ভব নয়, স্বাভাবিকও নয়। তবু তাঁরা কেউই ছকের মধ্যে আবদ্ধ থাকেন নি , থাকলে অনুকারক হলেও হতে পারতেন, বড় শিল্পী হতেন না। তারা পুতুল দেখেন নি, মানুষ দেখেছেন এবং মেয়েদের বন্ধন ও অচরিতার্থতার যে বেদনা তার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করতে ভোলেন নি।

এই নায়িকারা একজন অপরজনের মতো নয়। কিন্তু প্রত্যেকেই আবদ্ধ কোনো না কোনো বন্ধনে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে যে, এরা ওই বন্ধন মেনে নিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নেয় নি। না, কয়েকজন ছাড়া তারা বিদ্রোহ করে নি এটা সত্য; কিন্তু তারা অনেকেই নীরবে ধিক্কার দিয়েছে। কেউ কেউ আবার যে পথ খুঁজেছে মুক্তির এটাও মিথ্যা নয়।

সভ্যতা এগিয়েছে। মেয়েদের অবস্থান, আত্মজিজ্ঞাসা, চরিতার্থতার প্রয়োজন এসব বিষয়ে তাদের অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এসেছে, অনিবার্য ভাবে।

আরো পড়ুন:  জর্জ অরওয়েল হচ্ছেন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ফার্মের একগুঁয়ে এক এনিমেল

এই আলোচনায় আমরা অনেক কিছু দেখবো, সব চেয়ে বেশি দেখবো বৈচিত্র্য, এবং পরিচিত হবো কয়েকজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। বর্তমান কাহিনীটিতে শেকসপীয়র নেই, তার কারণ অন্যকিছু নয়, কারণ হচ্ছে এই স্থূল ঘটনা যে, শেকস্পীয়রের মেয়েদেরকে নিয়ে এই লেখক ‘শেকস্পীয়রের মেয়েরা’ ভিন্ন একটি বইতে আলোচনা করেছেন, সে বই এই বইয়ের পরিপূরক বটে।

বর্তমান আলোচনা কেবল নায়িকাদের ব্যক্তি চরিত্র নিয়ে নয়, সেই সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব জগৎ এবং তাদের স্রষ্টা-শিল্পীদের নিজস্বতা নিয়েও। কোথাও কোথাও সরাসরি তুলনা রয়েছে, যে-স্থানে প্রত্যক্ষভাবে নেই সেখানেও অনুক্ত তুলনা চলে এসেছে।

নায়িকাদের মধ্যে চারজন—হেস্টার প্রীন, এমা বৌভারী, আন্না কারেনিনা ও নোরা— উনবিংশ শতাব্দীর সৃষ্টি; তাদের আগের নয়জন প্রাচীনামলের—সময়ের দিক থেকে ওই চারজন আমাদের কাছাকাছি। এরা বাস করে জটিল আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে। সাংস্কৃতিক আধিপত্যও এদের ক্ষেত্রে প্রবল। সে-কারণেই অন্য নায়িকাদের তুলনায় ওই চারজন সম্পর্কে কিছুটা বিস্তৃত আলোচনা করা। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে কয়েকজন নায়িকাকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেটা এইজন্য যে, এদের ভেতর থেকে কোনো একজনকে আলাদাভাবে বেছে নিলে অন্যদের প্রতি অবিচারের আশঙ্কা থাকতো। কুমুদিনীকে হয়তো নেওয়া যেত, কিন্তু তার ওপর আমার একটি ছোট বই আছে, ‘কুমুর বন্ধন’ নামে। লেখকেরও নানা বন্ধন থাকে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন গ্রন্থের এই অবতরণিকাটুকু নেয়া হয়েছে লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উক্ত বইয়ের ১১-১২ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে। বইটি অশোক পুস্তকালয়, এপ্রিল ২০১১, কলকাতা থেকে পুনর্মুদ্রিত।

আবুল মনসুর আহমেদ (১৮৯৮-১৮ মার্চ ১৯৭৯) একজন বাংলাদেশী সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক। তাঁকে নিয়ে আলোচনা করছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

Leave a Comment

error: Content is protected !!