তুমি নতুন গর্জে ওঠা শহরের মাঝখানে আমাদের কিংবদন্তি,
ইতিহাসের অগ্নিগোলকের শক্তিমান উজ্জ্বল ভাস্কর্য,
অসীমের ঘরে জীবন্ত রোমান্টিক স্রোত;
তুমি বিছিয়েছ হা-ঘরেদের জন্য শেষ অস্তিত্বে রাতের শয্যা,
তোমার একটি কথায় নড়ে উঠেছে মহাবিশ্ব,
তোমার কথার পূর্বে পৃথিবীতে ছিল মৃত্যু উপত্যকা,
তোমার কথার পরের পৃথিবী অন্য আলোয় ভরা,
তোমার ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে আসমুদ্রহিমাচল,
তোমার চোখের চাহনি দেখে সোনার ছেলেরা
ফাঁসির রশিতে ফুটিয়েছে রক্তপদ্ম ফুল;
তুমি বলেছ তাই পৃথিবীতে এসেছে অনঢ় শান্তি,
তুমি চেয়েছ তাই আমাদের হাতে হাতে কবিতা,
তুমি চেয়েছ তাই আগ্রাসীরা এখন হিরের টুকরো,
তুমি চেয়েছ তাই এখনো জ্বলে রাজপথে লাল আগুন,
তুমি চেয়েছ তাই সকলে ঝাঁপ দেয় নতুন সাগরে
সাঁতরে বাঁচায় সেসব মানুষ যারা ডুবতো অনায়াসে,
তোমার ছোঁয়ায় পুর্নজীবন পায় পৃথিবীর জীব,
তোমার জন্যই লড়ে চলেছে মহাকাব্যের নায়িকারা,
তোমার জন্যই মঞ্চ কাঁপায় মহানাট্যোর কুশীলবেরা।
তোমার আমার দেখা হবে হয়ত পৃথিবীর অপর প্রান্তে,
টগবগে তুমি বলবে ‘বল তো এমন কেন হলো,
কহাজার বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছিল’,
প্রত্যুত্তরের আশায় না থেকে ব্যস্ত তুমি যাবে তোমার পথে,
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাববো মনে মনে
সে খুব অতীতের কথা নয়
তোমার সঙ্গে ছিলো আমার গভীর প্রণয়,
যে কাজ পারেনি কেউ সে কাজ করেছিলাম আমরা দুজন,
সকলের ভালোবাসা লুট করে হয়েছিলাম আমরা সুজন,
কাঁধে রাইফেল, হাতে হাতবোমা রেখে
আমরা হেঁটেছিলাম হাজার বছর পাশাপাশি,
তবুও তোমাকে আমি কতটুকু চিনতে পেরেছি?
তুমি একদিন সাতরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে
প্রাচীন সভ্যতার পাথুরে ভাস্কর্যের সাথে মিশে গিয়েছিলে,
আর আমি সেইদিন মুক্ত পাখির খোঁজে
মেশিনগান কাঁধে দ্রুত ছুটতে গিয়ে
তোমাকে কিছু মুহুর্তের জন্য পেয়েছিলাম কাছে,
এখন বেশ মনে আছে
ঈশারায় দেখিয়েছিলে তোমার বহুমাত্রিক সুগন্ধি বর্ণালি।
তারপর কত আঁধার কাঁদা জল বন বনান্তর
শ্বাপদসংকুল ব্যাঙ হাঙর কুমির পেরিয়ে
এসেছিলাম আমরা আরক্তিম চিলেকোঠায়,
হাসি ঝরে পড়েছিল তোমার স্বরযন্ত্র হতে;
তারও অনেক বছর পর ভরা নদীতে মাছেদের
বসন্ত উৎসব চৈত্র সংক্রান্তি পৌষের পালাগানের
তার্কিক রাত্রি হেমন্তের সাদা মেঘ ছাড়িয়ে
তুমি এখন খাট পালংক আর বিনোদনকলে
সাজিয়েছ পরিচ্ছন্ন তারাদের মতো বৈঠকখানা
আর মোহন গন্ধ ছড়িয়েছ প্রাসাদের চারধারে;
উদ্যানের মাঝখানের হ্রদের সুখী মাছরাঙাদের ভিড়ে,
অনন্যা, তুমিও কি সময়ের নবীন মাছ শিকারি পাখি;
আমি তোমাকে ওইরূপে দেখতে চাইনি,
চোখ বন্ধ করে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলাম,
দেখেছিলাম সেইরূপ স্বপ্নে দুঃস্বপ্নে বারবার
কন্ঠে তোমার দ্রোহের গান, ছান্দসিক বক্তৃতা,
মুগ্ধ তোমার ডাকে জনগণের ভিড়ে
নিঃসঙ্গ আমি হয়েছিলাম তোমার সহচর;
যদিও তুমি তখন নিরুদ্বিগ্ন,
তোমার পাশে কে এলো কে গেল খেয়ালই করতে না,
তোমার সখিরা খুব ভীত হয়ে পড়েছিল
তোমার সেই মোহময় অগ্নিরূপ দেখে।
তুমি কোলাহলে কখনো হওনি উতলা,
সিদ্ধান্তে ও সংগ্রামে ছিলে ত্রিকালদর্শি,
তোমার দীর্ঘশ্বাস আমরা কখনো দেখিনি।
উত্তেজনাহীন শান্তপদে আমাদের পাশে নিয়ে তুমি
হেঁটে গেছ চলন্ত সিঁড়ি, আকাশের বাড়ি,
গায়ে মেখেছ পৃথিবীর ঘাম,
অল্প ক’দিনের ভাবাবেগে আমি তোমাকে ও অন্যদেরকে
খুব কাছে থেকে চিনলাম,
তোমার ওই হাত দুটোতে সম্মোহনি শক্তির ফোয়ারা আছে,
তা দিয়েই তুমি আমাদের ব্যক্তিগত
সাগরগুলিতে আগুন জ্বালিয়েছিলে,
অশান্ত মহাবিশ্বে উড়িয়েছিলে বিবেকের বোধের বেলুন;
আজ হাজার হাজার বছর পরে আমি কি তোমার সহচর হয়ে
বিশাল ব্যধিগ্রস্ত পাহাড় কেটে ফেলব,
নাকি তুমি হবে আজ আমাদের গাঁয়ের
অথর্ব হাতহীন পাহীন রক্তমাংসহীন কংকালসার ভিখারিনী,
আমি কি আর তোমার দিকে তাকাতে পারবো?
আমার শক্তি নেই তোমার কোনো পরাজয় সহ্য করবার।
আমি হারাতে চাই না আমার স্মৃতিতে তোমার উজ্জ্বল সুখ।
বজ্র বা উল্কাপিন্ডের আঘাতে পুড়ে খাক হয়ে যাক হৃদয়গুলো,
সভ্যতার রক্ত সংবহনতন্ত্র শিরা উপশিরা ধমনি পুস্তক উপপুস্তক,
আমাদের কালের নায়ক ও নায়িকাদের কথা উপকথা,
লাগুক প্লেগ ও মড়ক চারদিকে,
জানবো তুমি নেই এশহরে;—
আমি না হয় একাকি কোনোখানে নিঃসঙ্গ কাটালাম সব কটা দিন,
তুমি কিভাবে সবাইকে ছেড়ে ভিখারিনির বেশে থাকবে বলো?
আজ তোমার চোখের মনি উড়তে উড়তে আকাশের পানে যাক,
ছড়িয়ে দিক অশুভ শক্তির আগমনের সর্তক সংকেত,
ভুলে যেও না আদর্শিক জনগণ আজ টর্নেডো আক্রান্ত গাছের মতো দুলছে,
তারাই এ-শতকের একেকজন অগ্রনায়ক,
তোমার মোহনীয় ক্ষমতায় তারা জেগে উঠবে
সমুদ্র যেমন ফুঁসে উঠে নিস্তব্ধতার পর
শৃঙখলমুক্ত স্বপ্নকে মূর্ত রূপ দেবে বলে।
আমি দেখেছি বহুজনকে এক জীবনে,
কেউ শুধু হাসতে জানে, কেউ জানে বলতে কথা,
কেউ জানে গাছের মতো আজীবন দাঁড়িয়ে থাকতে,
কেউবা জানে বত্তিচেলির সাগরোত্থিতা ভেনাস হতে,
প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম তুমি নও দশজনের মতো,
হিরন্ময়ি কন্ঠ তোমার নতুন ভাবনার মূর্ত রূপ নিয়েছে,
তোমার দুহাত জাপটে ধরেছে ধুমকেতুর পুচ্ছ
তোমার ঠোঁটের রেখা প্রতি মুহুর্তে জানিয়ে দিয়েছে
জঙ্গলার্কীণ মাঠ ঘাট তুমি আমি নির্ভয়ে দিতে পারি পাড়ি;
তোমার হাঁটুর ভঙ্গিমায় ভীত হয়েছে দেবতা সকল,
তোমার মনে পড়ে
তুমি আমি একবার দুজনেই যুদ্ধাহত পরস্পর জড়াজড়ি করে
পার হয়েছিলাম দাসত্বের যুগ
আর আজ পাড়ি দেবো, হাতটি ধরো,
অর্থের আরণ্যক যুগ।
আলোকচিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত আলোকচিত্রটি অজানা আলোকচিত্রীর তোলা। ফটোটিতে আসিয়া অন্তরকে দেখা যাচ্ছে। আসিয়া ছিলেন কুর্দি ওয়াইপিজে গেরিলার এক সদস্য। ছবিতে নভেম্বর ২০১৫তে আসিয়াকে তাঁর সহযোদ্ধাসহ দেখা যাচ্ছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।