বনবন ঘোরা থেকে মাথা বড় কষ্টে
সুস্থির হয় অন্ধকারে, চিন্তার গতিবেগ
শূন্যতায় নেমে যায়, দিনাতিপাতের পরে
আবার বাড়ে এক ফালি হিসেব নিকেশ
দৈনন্দিন হাজিরা ও অনুপস্থিতির গড়;
কবেকার বস্তির দলা পাকানো জঙ্গলে
জন্মেছিলো আমার উৎসাহহীন ভ্রুণ,
তারপর অবিরাম পথচলা রাজপথ অলিগলি
জংলি ইট কাঠ রড টিন সিমেন্ট মেলায়;
উদ্যান চোখেও দেখেনি কারো দাদা,
আমি জানি না কে আমার বাবা,
বাগান তখন ছিল নববধু দাদিদের বিলাসিতা।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোনো কোনো দিন
শহুরে সুন্দরিদের পেয়েছি বাহুতে নাগাল,
হৃদয়ের ঘুন পোকাকে সিলপাটায় ভেঙে ভেঙে
দুহাতে খাইয়েছি যাকে তাকে যেথায় সেথায়;
ব্যবসার ময়দানে অনভিজ্ঞ অমার্জিত নিক্তিতে
বেচেছি ছাই ও হাতুড়ির বাট, পানের খিলি,
গোবরের ঢিবি, আমের আঁটি আর আনন্দের কাঁটা।
দুইখানা দা ছিলো দাদার আমলের
তাই দিয়ে সিন্দুক রক্ষা ও বিভক্তি ঠেকানো
কেনাবেচার দালালি করে চালিয়েছি টেনে টুনে
বারোখানা হাত আর ছয়খানা কাঁচা পাকা মাথা
যুগিয়েছি শারীরিক ক্ষুধা, বৌয়ের শাড়ির ঘ্রাণ,
লাল লিপস্টিক, পাগল করা পায়ের চটি জুতা,
ইজ্জত ঢেকে রাখা কৈশোরিক ফেলনা গামছা
আর বারবার টানতে থাকা অগণিত বিড়ির পাছা;
সুখি সংসারী কনডম যৌবনে কখনো দেখিনি
ছেলেমেয়েরা ফুঁ দিয়ে বেলুন বানিয়ে ফাটিয়েছে,
জন্মনিরোধক বড়ির গল্পে মজিনি কোনোদিনই,
একটি সন্তান বুঝতাম অগণিত বংশের খনি।
শীতকালের গা গরমে ছিলো প্রচলিত পাড়া ও তার
বদরাগি পাহারাদার সবার মাসিমা,
আমি তো নগন্য এক কাঁচা খরিদ্দার
কবি নই, কমিউনিস্ট নই, ব্যর্থ গোপন প্রেমিক
কুকুরকেও রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দোকানে চা খাই
প্রতিদিনের একই গাঁজা হাতে শোভা পায়;
মাঝখানে হঠাৎ একদিন ঘোড়দৌড়ের ময়দানে
কী হয় আমরা কেউ ঠিকমত বুঝতে পারি না,
হুড়দঙ্গল খুনাখুনি শুরু হয়ে যায় সবখানে
সুশোভিত অপরাজিতার ঘাড়ে বুকে হাত দিয়ে
চলে যায় শক্তিশালি বিজাতীয় সেনাবাহিনী,
মুখে মুখে রটে যায় মিথ্যাচার, কাব্যে শধু শান্তিক্ষয় হয়,
রঙিন লাল কাপড়ের জন্য কিছু লোক মরে যায়
আর ইতিহাসে গাঁয়ের বুড়া বটগাছটা বার বার ডুকরে ডুকরে কাঁদে,
চরম গরমভাবে দেশবাসীর ঘরে ঘরে মঞ্চস্থ হয় অহিংসা পরম ভুল।
খামখেয়ালিপনায় দিন কয়েকের মধ্যে মাথার
খুলিগুলো মরুবালুতে ঢাকা পড়ে সশব্দে চ্যাঁচায়,
আর কয়েকটি স্কুল ফেরত শিশু বারুদের বাগানে
ডাঙ্গুলি খেলে পৃথিবীকে বেচে আমেরিকার কাছে
একটি কিশোরি তার কিশোরের সাথে
গল্প নিয়ে করে কাড়াকাড়ি মাঝরাতে,
ধীরে ধীরে বড় হয়, মিছিলে হাত ওঠায়।
শুরু হয় বিপ্লব বিপ্লব সবুজ বিপ্লব
গ্রামের ছেলে যাও সবুজ ঘরে ফিরে
ভিড় করো নাক আর অদ্ভুত ঢাকা শহরে;
তিনটি পুরুষ প্রাচীন রীতিনীতি নিয়ে গল্প শোনায়,
জনসভার পর হুযুগে বাঙলার ময়দানে
খুলে যায় একতন্ত্র হতে ডাকাততন্ত্রে গমনের পথ,
একনায়ক ট্রাক চেপে মেরে ফেলে সংগ্রামি জড়ভরত,
বুকে পিঠে লেখা থাকে অন্য এক সংগ্রামির
একতন্ত্র হতে অন্যতন্ত্রে যাবার বুলেটি পথ
দুইজন নারী জনসভায় প্রাচিন যাদুবিদ্যা নিয়ে
বকে যায় অনর্গল মুখস্থ পান্ডুলিপি এবং
আমরা দেই আত্মাহুতি সাইরেনদের গীত শুনে,
কিছুদিন পরে এক পাতি নেতা জাতি উদ্ধারের
শোনায় কাহিনী যা তার বাবাও শুনিয়েছিলো
শ্রোতাদের বাবা মা চাচা দাদা নানা নানীদের
আর কিছু প্রচলিত পাখি কা কা রবে
এগিয়ে গেল মার্চপাস্ট করতে করতে,
বাদ্যযন্ত্রে উঠলো বেজে গণআজাদী সুর,
নিয়মতান্ত্রিক বৈশিষ্টসহ বৈদ্যুতিক আলোয়
হাতগুলো হাত তালি দিল ঘনঘন এবং
হাতে পেল কতিপয় চটকানো কড়ি,
আর আমি এক রাতে কাঁধ ব্যাগ হাতে নিয়ে
হেঁটে গেলাম ধীরে ধীরে নরকের সিঁড়ি;
দেখলাম গলা ফোলা ঘ্যাগ নিয়ে কানাঘুঁষা
গেটে বাতে বেওয়াদের চমৎকার কষ্ট পাওয়া,
সমকামিতায় মথিত নারী ও পাইলস রোগি পুরুষের
অর্শ দাদ রক্ত পুঁজ আমাশয়ের ক্বাথে
সন্তানেরা ক্রমে ক্রমে আক্রান্ত ও বিভ্রান্ত;
শুধু স্মৃতিতে সবার উজ্জ্বল উপস্থিতি অতীত ভূতের।
গোখরোর ফনায় সন্ধ্যেবেলা আমি
হাত রেখে খুঁজেছি আমার গোপন প্রিয়াকে,
ঝাঁটাপেটা করেছি তার বাবা ও মামাকে
একদিন বাইশ বছর পর করেছি নাচ গান চিৎকার;
দেখেছি স্বামী স্ত্রী, বেকুব শব্দ চয়ন, চৌকিদারের বাঁশি,
কেষ্টর নাক ডাকা ঘুম, কলিংবেলের ফুঁ, টায়ার ও টিউবের উচ্চচাপ,
মসনদে সেনা আরোহণ, কলতলার কাজিয়া,
রান্নাঘরের প্যানপ্যানানি, বালি মিশ্রিত ভাজা পোড়া,
চীনাবাদামের গণটিপাটিপি, তাড়া খেয়ে পড়ে যাওয়া মন্ত্রির
ভাতের থালা, পুলিশি প্যাদানিতে মরে যাওয়া আমার সন্তান,
নিবেদিতা নাম বদলে রোখসানার গণঘরে
পাজা কোলে করে নিয়ে বিছানায় ফুঁচকা
খাওয়ানো দুই মুখে পরস্পর স্মৃতির ছোবল;
বুড়াকালে মুক্তোর মালা দিয়ে লিমুজিন গাড়িখানা
সাজিয়েও আমি মেরিলিন মনরোর সাথে মিলনের সিঁড়ি
খুঁজে পাইনি; কেননা তার নাকি দুর্বাফুল খুব প্রিয় ছিলো,
কে আর ভাবতো দুর্বাফুল কার ঠোঁটে ফোঁটে?
রক্তশূন্যতায় ভুগে জন্ডিসের জড়ি খেয়ে
দুটো ঈগল হয়ে গেছে সাদা আগাগোড়া;—
দুদিন আগেও তাদের একটির মূর্তি ছিল লাল প্রগতির ফোয়ারা।
অযোগ্য ও প্রাচীন সৎসাহসহীন
আমরা যারা নতুন কালের নই দাবীদার,
তারাই মানে আমিই সদাগরি অফিসের বস,
চাকরি প্রার্থির সাক্ষাতকারে টেবিলের চারপাশে
দেখেছি ফিটফাট শেকসপিয়র অমর সিংহাসনে বসে
আবৃত্তি করছেন মহাব্যবস্থাপনার নীতিবিদ্যা,
টাকার থলেতে তার বহুবিক্রীত নয়া কৃতদাসি,
ডাক্তার প্রকৌশলি মোটা মাইনের পাত্র
চাই পাত্রী অতি সুশ্রী অর্নুধ্ব কচি বিশ
আর চাই রাজধানিতে দুচারটি বাড়ি ও অফিস;
কেন তবে আমি আমার কাব্য প্রেমিকা বন্ধু
দু হাজার তিনের জানুয়ারি মাসে কেন
সহকারাবাস এই উর্বর দেশের মেসে
কেন হাঁপানির মতো হাপিত্যেশ শেষে?
জনতা তো জানে এক ভাতার লোকান্তরে তো কী হয়েছে,
লক্ষ ভাতার ঘরে ঘরে ঘুর ঘুর করছে,
কত ঠোঁট চুমু খায় বহুগামী মোমে,
ঘাড়ে চড়ে হাওয়া খায় গণনির্বাচন
তুমি আমি পরস্পর যোগাযোগের ইলেকশনে আবার খাড়াইব—
এইবার জিতবারও পারি।
১৪.০১.২০০৩
চিত্রের ইতিহাস: কবিতায় ব্যবহৃত অংকিত চিত্রটি হোসে দো রে কারভালহো-এর (১৭৯৮-১৮৯২) আঁকা দম্পতির অগ্রযাত্রা (Casal em viagem)। শিল্পী ছবিটি আঁকেন ১৮৫৯ সালে। এখানে চিত্রটিকে উপরে সামান্য ছেঁটে ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।