আমলাতন্ত্র (Bureaucracy) শুরু থেকেই গণতন্ত্রের বিরোধী। আমলারা কখনোই গণতন্ত্র চায় না। আমলাতন্ত্র জনগণকে জিম্মি করে, জনগণকে শোষণ ও নির্যাতন করে, জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করে সুবিধাভোগী শ্রেণিতে পরিণত হয়। গরিব দেশগুলোর আমলারা জনগণকে পরাধীন করে রাখে, জনগণের শ্রমফল ভোগ করে, জনগণকে বিপদে ফেলে দুর্নীতি করে, দেশীয় সম্পদ বিদেশে পাচার করে। সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত পশ্চাৎপদ গরিব দেশগুলোতে গণতন্ত্রের শত্রুদের ভেতরে ক্রিয়াশীল রয়েছে পুঁজিবাদ, মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও অবশ্যই আমলাতন্ত্র। আর পশ্চাৎপদ গরিব দেশই হয় আমলানির্ভর। যে দেশ যত পিছিয়ে পড়া, সেদেশে আমলার সংখ্যা ও ক্ষমতা তত বেশি থাকে। যেখানে মানুষ যত অজ্ঞ ও স্বায়ত্তশাসনে অনভিজ্ঞ সেখানে তত আমলাদের দোর্দণ্ড প্রতাপ ক্ষমতা। পশ্চাৎপদ গরিব দেশগুলোতে আমলারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে, জনগণের হাতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের বিরোধিতা করে, নিজেদের সুযোগসুবিধা ও বেতন বাড়ানোর তালে থাকে, বিন্দুমাত্র উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে না আর রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে চায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সামরিক-বেসামরিক আমলারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে, জনসম্পদ লুট করেছে, গরিবকে নির্যাতন করেছে, আরো গরিব বাড়িয়েছে, আমলাগিরি শেষ করে অনেকে রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে এবং দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেছে।
জনগণকে আমলাদের কাছে যেতে হয়; কারণ পশ্চাৎপদ দেশে জনগণ ভোট কিংবা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলেও তারা জানে না কীভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়। তাই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দরিদ্র জনগণ পশ্চাৎপদ নতুন রাষ্ট্রগুলোতে শাসনকার্যের অনভিজ্ঞতার কারণে আমলানির্ভর হয়ে পড়ে। আর এসব আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খায়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ব্যর্থতার ইতিহাস হচ্ছে আমলাতন্ত্রের শক্তিশালী হওয়ার ইতিহাস।
আমাদের গণতন্ত্র সর্বদাই শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের গণতন্ত্র। সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত আধা সামন্তবাদী দেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্র সফল হবে না, কেননা সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আমরা পুঁজিবাদী বুর্জোয়া লুটেরা ধনিদের গণতন্ত্রের বিরোধী, নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার জন্য সংগ্রামে বলিয়ান।
পুঁজিবাদী দেশগুলোতে আমলাদের শক্তি পশ্চাৎপদ দেশগুলোর চেয়ে কম হলেও পুঁজিবাদী দেশের আমলারা অনেক ক্ষমতার অধিকারি। এই আমলারাই রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করে; যুদ্ধ বাঁধায়; গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে ব্যর্থ বা হত্যা করে; দরিদ্র দেশসমূহকে দখলে প্ররোচনা দেয় আর সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দরিদ্র দেশগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে সেই দেশগুলোকে ঋণে জর্জরিত করে।
কিন্তু শ্রমিক-কৃষকশ্রেণির গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাদের অবস্থান কী হবে? এ প্রসঙ্গে উৎপল দত্ত তার ‘প্রতিবিপ্লব’ গ্রন্থে ভি. আই. লেনিনের আমলাতন্ত্র সম্পর্কিত চিন্তাধারা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন,
“লেনিন তাঁর ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থে শ্রমিক রাষ্ট্রে আমলা ও শাসকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার যে পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন, তা ছিল এইঃ (১) সব কর্মচারী জনতার ভোটে নির্বাচিত হবেন; এবং যে কোনো সময়ে তাকে ভোট দিয়ে বরখাস্ত করা চলবে; (২) একজন সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে বেশি মজুরি কেউই পাবেন না; (৩) সমগ্র জনতাই সরকারি ক্ষমতার অংশীদার হবেন; অর্থাৎ সবাই আমলার কাজ করবেন, ফলে কোনো আমলাই আর থাকবে না।
এবং লেনিন চেয়েছিলেন বিপ্লবের পরমুহূর্তে যে সরকার গঠিত হবে তাকেই এভাবে গড়ে তুলতে হবে। ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থা করা যাবে, এ রকম মনোভাব বিপদ ডেকে আনবে, কেননা লেনিন জানতেন একবার আমলাদের বাড়বার সুযোগ দিলে তারা দ্রুত নিজেদের সংগঠিত করে এমন দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলবে, এমনভাবে সুযোগসুবিধা বিলিয়ে এত মানুষকে স্বপক্ষে টেনে আনবে যে আরেকটা রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ব্যতীত এদের ক্ষমতাচ্যুত করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বিশ্ববিপ্লবের দুর্ভাগ্য যে সোভিয়েত সরকারকে লেনিনীয় মডেলে গড়া যায়নি। নির্বাচিত শাসকমণ্ডলী গড়ার কাজ শুরুই করা যায়নি।”[১]
এই ভ্রান্ত গণবিরোধি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চিনে শুরু হয়েছিল মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব। চিনসহ বিভিন্ন দেশেই দেখা যায় অনেক আমলাই হয়ে থাকে বিশেষজ্ঞ এবং একই সাথে আমলাও। চিনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অন্যান্য অনেক লক্ষ্যের সাথে এই লক্ষ্যও ছিলো যে আমলাদের চিন্তার সংস্কার, প্রশাসনে গতিশীলতা ও গণতন্ত্রকে কার্যকর করা হবে। চিনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় ম্যানেজার ও প্রযুক্তিবিদদের ক্ষমতাকে কমিয়ে দিয়ে ক্রমশ সেখানে যৌথ পরিচালনা সংস্থা হিসেবে বিপ্লবী কমিটি গঠনের উদ্যোগ। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ষোড়শ কংগ্রেসেও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সেখানেও জনগণের অংশগ্রহণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাস্তবে কিন্তু উভয় দেশের অভিজ্ঞতাতে বেশিদূর এগোনো যায়নি।[২]
আমলাতান্ত্রিক মনোভাব প্রশাসন থেকে পার্টিতেও দেখা যায়। মাও সেতুং সে সম্পর্কে সপ্তম কংগ্রেসের দ্বিতীয় প্লেনারি সম্মেলনে বলেন, বিজয়লাভের সংগে সংগে কিছু মনোভাব পার্টির ভেতরে মাথাচাড়া দিতে পারে যেমন ঔদ্ধত্য, স্বারোপিত বীরত্বের আবহাওয়া, অলসতা, এগিয়ে চলতে অনাগ্রহ, সুখের প্রতি আসক্তি প্রভৃতি।[৩]
আমলাতন্ত্র শ্রেণিসমাজের দীর্ঘদিনের সৃষ্টি। একে শক্তিশালী করেছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা বিশেষজ্ঞদের গুরুত্বকে ভীষণভাবে বৃদ্ধি করেছে। ভাববাদীরা এই আমলাতন্ত্রকে প্রয়োজনীয় পাপ বলে মনে করেছেন। এই ভাববাদীরা ভাবতে চাননি যে আমলাতন্ত্র ছাড়াও রাষ্ট্র ও প্রশাসনব্যবস্থা সম্ভব। লেনিনের মত এমন ছিলো যে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘কর্মকর্তা ছাড়া আমরা চলতে পারি না পুঁজিবাদের আমলে, বুর্জোয়ার আধিপত্যের আমলে’ এবং তিনি উল্লেখ করেছেন যে সমাজতন্ত্রে প্রশাসক বা আমলা বিলুপ্ত হবে।[৪] মাও সেতুং সারা জীবন নানাভাবে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালান সেটির নানা রকম প্রায় বিশটি চিত্র তুলে ধরেন। মাও সেতুং ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমলাতন্ত্রের ২০ ধরণের প্রকাশ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেন। আমলাতান্ত্রিক আচরণ সম্পর্কে মাও সেতুং লিখেছেন,
“প্রশাসন বা সংগঠনের উচ্চস্তরে থেকে আমলাতান্ত্রিক নেতারা খুব অল্প জ্ঞান রাখে; তারা জনগণের মতামত বোঝে না; তারা অনুসন্ধান করে না এবং পড়ে না; তারা নির্দিষ্ট নীতিসমূহ গ্রহণ করে না; তারা রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত কাজ পরিচালনা করে না; তারা বাস্তবতা থেকে, জনগণ থেকে, পার্টি নেতৃত্ব থেকেও দূরে সরে থাকে; তারা সর্বদা নির্দেশনামা জারি করে এবং সেসব নির্দেশনামা সচরাচর ভুল; তারা দেশ ও জনগণকে নিশ্চিতভাবেই ভুলপথে নিয়ে যায়; এবং অবশেষে তারা পার্টির ধারাবাহিক অবিচল লাইন ও কর্মনীতিতে [policy] প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে; তারা জনগণের নাগাল পায় না।”[৫]
আমলাতন্ত্রের বিশটি বৈশিষ্ট্যের ভেতরে আছে কর্তৃত্বমূলক, রুটিনবাদী, জমিদারী, অসাধু, দায়িত্বজ্ঞানহীন, পিচ্ছিল, মেধাশূন্য, অকর্মা, অলস, দাপ্তরিক, আনুষ্ঠানিকতা, ব্যতিক্রমী, বায়বীয়, অহংকারী, বিবাদমত্ত, অনৈক্যের, চক্রপন্থী, অধঃপতিত এবং প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতন্ত্র। যেমন অসাধু আমলাতন্ত্র সম্পর্কে মাও সেতুং লিখেছেন,
“অসাধু আমলাতন্ত্র অজ্ঞ; তারা কোনো বিষয়ে জানার জন্য প্রশ্ন করতে লজ্জ্বাবোধ করে; তারা অতিরঞ্জিত করে এবং মিথ্যা বলে; তারা নিজেরা ভুলে ভরা কিন্তু তারা সে ভুলের দায় চাপায় জনগণের উপর; তারা সফলতার ভাগ নিজেদের উপর বসাতে আগ বাড়িয়ে থাকে; তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে প্রতারণা করে; তারা তাদের উচ্চস্তরের নেতৃত্বকে ভুল তথ্য দিয়ে প্রতারণা করে এবং এবং তাদের অধস্তনদের বোকা বানায়; তারা তাদের ভুলভ্রান্তিকে গোপন করে এবং ভুলসমূহকে চাকচিক্যময় করে।”[৬]
দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধান থেক এই বিশ ধরনের আমলাতন্ত্রের প্রকাশ বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করেছিলেন মাও সেতুং এবং সেসবের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশের জনগণকে আমলাতন্ত্রের কালো থাবা থেকে রক্ষা করতে হবে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতেই হয়। আমলাতন্ত্রকে পরাজিত করা ছাড়া গণতন্ত্রের সাফল্য অসম্ভব। [৭]
তথ্যসূত্র ও টিকাঃ
১. উৎপল দত্ত; প্রতিবিপ্লব; এম সি সরকার এন্ড সন্স প্রা লি; কলকাতা; দ্বিতীয় সংস্করণ; ভাদ্র-১৪০০; পৃষ্ঠা ৩২-৩৩।
২. দেখুন, সমীরণ মজুমদার; চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব; ঋ্যামন পাবলিসার্স; ফেব্রুয়ারি, ২০১০; পৃষ্ঠা, ১৮১-১৮২।
৩. সমীরণ মজুমদার, পূর্বোক্ত,
৪. ভি আই লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব, আগস্ট-সেপ্টেম্বর, ১৯১৭, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৫।
৪. মাও সেতুং, আমলাতন্ত্রের বিশটি প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০, অনুবাদ অনুপ সাদি, মার্কসবাদী ডট অর্গ, লিংক এখানে।
৫. মাও সেতুং, পূর্বোক্ত।
৬. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] সম্পাদিত ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা গ্রন্থে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রাণকাকলিতে ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত হয়। প্রাণকাকলি ও রোদ্দুরে ডট কমে প্রকাশের সময় পরিবর্ধন করা হয়েছে। রচনাকাল জুন-জুলাই, ২০১০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।