একটি রাষ্ট্রের মধ্যে ভাষা, জাতি বা অঞ্চলগত বৈচিত্র্যকে সমন্বিত করে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করা হয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রবাদ বা সংঘবাদ বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (ইংরেজি: Federalism) বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অভিহিত করা হয়। এই ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে ইউনিটারী বা এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা বলে কথাটি প্রচলিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য এরূপ যে, রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলির কিছুটা স্বকীয় সংগঠন ও ক্ষমতার বিধান থাকে। অঙ্গরাজ্যগুলির কি ক্ষমতা এবং সংগঠন থাকবে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তা সমগ্র রাষ্ট্রের মূল সংবিধানে লিপিবদ্ধ রাখা হয়। এরূপ সংবিধানে অনেক সময়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা, অঙ্গরাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং যৌথ তথা অঙ্গরাজ্য এবং কেন্দ্রের যুক্তক্ষমতা বলে ক্ষমতার তিনটি তালিকারও উল্লেখ থাকে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কোথাও কোথাও যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং অঙ্গরাষ্ট্রীয় নাগরিকতারও বিধান থাকে।
সাধারণত সমগ্র দেশের রক্ষাব্যবস্থা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রবাদ সরকার বা কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত থাকে। অঙ্গরাষ্ট্রীয় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারসমূহের ক্ষমতা প্রয়োগে বিরোধ দেখা দিলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট তার নিষ্পত্তি করে। এবং তার রায়কে সকলের জন্য মান্য বলে বিবেচনা করা হয়। মূল সংবিধানের ব্যাখ্যার দায়িত্বও সুপ্রিম কোর্ট পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এরূপ একটি শর্ত সংবিধানে রাখা হয় যে অঙ্গরাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী তাদের সম্মতি ব্যতিরেকে সংবিধানের সংশোধন করা হবে না।
আধুনিক কালে যুক্তরাষ্ট্রবাদ ব্যবস্থার প্রথম উদ্ভব দেখা যায় আমেরিকাতে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধকালে উত্তর আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশ এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে আপন স্বকীয়তা বা অধিকার বজায় রেখে এক ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’ বা ‘আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র’ নামে তারা স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে আবার দাস সমস্যার মীমাংসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গরাষ্ট্র, বিশেষ করে দাসদের মুক্তির সমর্থক উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দাসব্যবস্থা বজায় রাখার সমর্থক দক্ষিণ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলির আপসহীন মতবিরোধের ফলে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে সশস্ত্র গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অভিন্ন নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পূর্বতন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা। সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটি প্রধান সাংবিধানিক বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, সেখানে অঙ্গরাষ্ট্রগুলির বিচ্ছিন্ন হওয়ার এবং বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা করার সাংবিধানিক অধিকারের স্বীকৃতি ছিল। ফলে ১৯৯০ সালে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাষ্ট্রগুলো এই অধিকারকে ব্যবহার করে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দাবির ভিত্তিতে জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত রিপাবলিক ইউক্রেন এবং বাইলোরুশিয়ার প্রতিনিধিত্বকে স্বীকার করা হয়। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের চরিত্রে অঙ্গরাজ্যের অধিকারের চাইতে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকারের বৈশিষ্ট্যই প্রবল। অবশ্য রাষ্ট্র বিজ্ঞানের গবেষকদের মতে রাষ্ট্রনির্বিশেষে বর্তমান যুগে প্রত্যেকটি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৭০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।