নারকেলের বোটানিকাল নাম Cocos nucifera Linn., ফ্যামিলি Palmae.বাংলাদেশে একটি পরিচিত ও সহজলভ্য গাছ নারকেল বা ডাব। নিচে নারকেলের সতেরোটি ভেষজ গুণ ও ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।
নারকেলের উপকারিতা ও ব্যবহার
আয়ুর্বেদিক কোনো প্রাচীন গ্রন্থে দৈহিক ও মানসিক রোগের ক্ষেত্রে নারকেল তেলের আভ্যন্তর (Internal application) প্রয়োগের নজির দেখা যায় না; এর কারণ হচ্ছে—এর দ্বারা অগ্ন্যাশয় ও পাকাশয়ে ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকাতেই একে আভ্যন্তর প্রয়োগের জন্য গ্রহণ করা হয়নি; কিন্তু লোকায়তিক মুষ্টিযোগগুলিতে দেখা যাচ্ছে যে, এই গাছের বিভিন্নাংশকে নানাপ্রকার রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে; তবে এটা ঠিক যে, নারকেল ফলের শাঁসের বা জলের যোগগুলি রক্তবহ স্রোতে কোনো প্রতিক্রিয়া করে না।
১. কিমিতে: এসব ক্রিমি মলদ্বারে উৎপাত করে না আর নাকের ডগাও চুলকোয় না এবং মুখ দিয়েও জল ওঠে না। এটা সৃষ্টি হয় আমাশয়ে। যদি কয়েকদিন সম্যক পরিপাক না হয়,তাহলে রসবহ স্রোতের উৎস আমাশয়ে এক প্রকার কিমি (ব্যাকটিরিয়া) সৃষ্টি হয়, তার কাজ পেটে বায়ু সৃষ্টি করা এবং উদরকে স্তম্ভিত করে রাখা, এই যে ক্ষেত্র এখানে কচি ডাবের জল অর্থাৎ যে জলের স্বাদ কষায় ও লবণাক্ত, সেই রকম কচি ডাবের জল আহারের পর খেতে হয়, এর দ্বারা ঐ ব্যাকটিরিয়াগুলির ধংস হয়। তবে জল মিষ্টি হয়ে গেলে সেই জল খেলে আরও ক্ষতিই ক’রবে।
২. গ্রন্থি মলে: মল নিঃসরণ হচ্ছে বটে, তবে তার নিরবচ্ছিন্নতা থাকছে না অর্থাৎ একটা বুলেট বেরিয়ে গেল, আবার আর একটা এলো, তার উপর এর গায়ে পাকা পাকা আম জড়ানো এই রকম যে ক্ষেত্র—সেখানে প্রত্যহ ঝুনা নারকেল মিহি করে কুরে অথবা ঐ কোরা নারকেল অল্প জলে গুলে ন্যাকড়ায় ছেকে ঐ দুধটা খেতে হবে, আধখানা অর্থাৎ একমালা নারকেল হলেই চলবে, তবে ৪ থেকে ৫ দিন প্রতিদিন খেতে হবে, এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।
৩. মূত্রকৃচ্ছতায়: অজীর্ণজনিত কারণে, অত্যধিক রৌদ্রে ঘোরায়, অত্যধিক পরিশ্রমে অথবা একনাগাড়ে এক আসনে চেপে বসে থাকায় যে প্রস্রাবের কৃচ্ছতা আসে, সেক্ষেত্রে একটা বা দুটো কচি ডাবের জল খেলে সাময়িক ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।
৪. কোষ্ঠবদ্ধতায়: পিত্ত-শ্নেমার ধাতু, বায়ুর জন্য দাস্ত পরিষ্কার হয় না; এক্ষেত্রে ঝুনা নারকেলের জল প্রত্যহ খালি পেটে এক বা দুই কাপ করে খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।
৫. উরঃক্ষতে: সর্দি-কাসিতে প্রতি বৎসর বিশেষ কষ্ট দেয়, বিশেষতঃ শীতকালটায়। এদের পিতৃ বা মাতৃকুলে কারও না কারও সর্দিকাসির দোষ থাকা অসম্ভবও নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে থাকেও। অল্প ঠাণ্ডা লাগলেই বুকটা ভার বোধ এবং দুই দিককার পাঁজরায় ব্যথা। এদের যে রক্ত উঠছে তাও নয়, এই যে ক্ষেত্র—এখানে একটা ঝুনা নারকেল কুরে নিয়ে, জলে গুলে, ছে’কে, সেই জলটা আগুনে চড়িয়ে পাক করে তেলটা বের করে নিতে হবে, এই তেল সকালের দিকে এক চা-চামচ ও বিকালের দিকে এক চা-চামচ খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।
৬. প্রোস্টেট গ্রশ্মির স্ফীতিতে: লাগলে ধরে রাখার ক্ষমতাও অনেকের থাকে , আবার কারও কারও লাগলেও একসঙ্গে বেরোয় না—ফোঁটা ফোঁটা ঝরতে থাকে, এক্ষেত্রে নারকেল গাছের কচি শিকড় ছেচে রস করে সকালের দিকে এক চা-চামচ ও বিকালের দিকে এক চা-চামচ একট, দুধ মিশিয়ে খেলে ৭ থেকে ৮ দিনের মধ্যেই উল্লেখ যোগ্য উপকার পাওয়া যায়।
৭. অম্ল ও অজীর্ণে: এই প্রক্রিয়ার মুষ্টিযোগটা একটু, গোলমেলে, তবে এটা কোনো বৈদ্যের দ্বারা যদি তৈরী করিয়ে নিতে পারেন তো ভাল হয়; একটা ঝুনা নারকেলের (বড় সাইজের) মুখের দিকে ছ্যাঁদা করে, জল ফেলে দিয়ে তার মধ্যে শুক আকন্দপাতা ২৫ গ্রাম কুচি কুচি করে পুরে দিতে হবে, তারপর বাখারি চূর্ণ (শামুক বা ঝিনুক পুড়িয়ে যে চূর্ণ হয়) ১০ গ্রাম আর যোয়ান ২৫ গ্রাম ঐ নারকেলের খোলের মধ্যে পরে গায়ে মাটি-ন্যাকড়া জড়িয়ে, লেপে শুকিয়ে ঘুটের আগুনে পোড়াতে হবে; এমনভাবে পোড়াতে হবে—যেন নারকেলের খোলটা পুড়ে গিয়ে ভিতরকার শাঁস ও অন্যান্য জিনিসগুলি পুড়ে যায়। তারপর নারকেলের উপরকার পোড় খোলা অর্থাৎ মালাটাকে বাদ দিয়ে সেই পোড়া শাঁস সমেত অন্যান্য জিনিসগুলিকে একসঙ্গে গুড়া করে, ছেকে রাখতে হবে; এই চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম মাত্রায় মধ্যাহ্নে ও রাত্রে দুইবেলা আহারের পর জলসহ খেতে হবে। এর দ্বারা অম্ল-অজীর্ণের দোষ নিশ্চয়ই কমবে, এমন-কি যাঁদের শুল ব্যথা ধরে—তাঁরাও এটা খেলে রেহাই পাবেন, তবে পথ্যাশী হওয়া দরকার অর্থাৎ খাওয়াদাওয়ার নিয়ম মেনে চলতে হবে।
৮. ফিতে ক্রিমিতে: এটা অবশ্য পশুর পেটেই বেশি হয় সত্যি, কিন্তু মানুষের পেটেও হয়। এক্ষেত্রে শুষ্ক নারকেল (এগুলি মেওয়ার দোকানে পাওয়া যায়) যতটা, তার সিকিভাগ সৈন্ধবলবণ মিশিয়ে থেতো করে রাখতে হবে, সেই চূর্ণ সকালের দিকে খালি পেটে ২ গ্রাম মাত্রায় ও বিকালের দিকে ২ গ্রাম মাত্রায় জলসহ কিছুদিন খেতে হবে। কিছুদিন খেলে ঐ ক্রিমি টুকরো টুকরো হয়ে মলত্যাগের সময় মলের সঙ্গে বেরিয়ে যাবে।
৯. অজীর্ণ রোগে: অবশ্য যদি এটা সাময়িক হয়ে থাকে তবে। ঝুনা নারকেল বেটে জলে গুলে, ছেকে নিয়ে, সেই জল পাক করে টাটকা তেল করে নিতে হবে, সেই তেল ১ চা-চামচ ভাত খাওয়ার সময় প্রথমেই ভাতে মেখে খেতে হবে, ২ থেকে ৪ দিন খেলেই এই সাময়িক অজীর্ণটা সেরে যাবে।
১০. অশ্লপিত্ত রোগে: যদিও এ রোগে চিকিৎসক ঘি ও চিনি খেতে দিতে চান না, তবুও লিখি ঝুনা নারকেল কুরে সেটাকে ঘিয়ে ভেজে নিয়ে আন্দাজ ১০ গ্রাম করে দু’বেলা খেতে হবে।
নিয়ম: এটা তৈরী করতে গেলে ২ চা-চামচ ভালো ঘি কড়ায় চড়িয়ে নিম্ফেন হলে ১ চা-চামচ চিনি ঐ ঘিয়ে ভেজে নিতে হবে, তারপর ২০ গ্রাম আন্দাজ নারকেল কোরা ঐ সঙ্গে ভেজে সকালের দিকে অর্ধেকটা ও বৈকালের দিকে অর্ধেকটা খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ রোগের উপশম হবে।
১১. শুক্র তারল্যে: ঝুনা নারকেলের মুখটা ছ্যাদা করে জলটা ফেলে দিয়ে, অল্প লবণ তার মধ্যে দিতে হবে এক বা দুই দিন মুখটা বন্ধ করে রাখতে হবে, এটার দ্বারা ভিতরকার শাঁসটা নরম হয়ে যাবে, তারপর ওটাকে অল্প জল দিয়ে ধুয়ে নারকেলের শাঁসটাকে চামচ বা ছুরি দিয়ে তুলে নিয়ে, বেটে, সেটাকে ছেকে নিয়ে যে দুধ পাওয়া যাবে—তা থেকে ২ চা-চামচ আধ কাপ গরম দুধের সঙ্গে মিশিয়ে প্রত্যহ এটা কয়েকদিন খেতে হবে। এর দ্বারা শুক্র গাঢ় হবে।
১২. মূত্র শর্করায়: প্রস্রাবের সঙ্গে শকরাবৎ (দেখতে চিনির দানার মতো) একটা জিনিস বেরিয়ে যাচ্ছে, যাকে Crystalluria ও বলা যায়। এক্ষেত্রে নারকেলের ফোঁপল অন্ততঃ ১০ গ্রাম দই দিয়ে বেটে প্রত্যহ সকালে একবার করে খেতে হবে। এত দ্বারা মূত্রের সহিত শর্করা নিগমন বন্ধ হবে।
১৩. পরিণাম শুলে: এই রোগে সাধারণতঃ যাঁরা অল্প পরিমাণ খান, তাঁরাই ভালো থাকেন। জলীয় কোনো খাদ্যের থেকে শুকনো খাদ্যের উপর বেশী ঝোঁক; এদের বমন হয়ে গেলে খানিকটা স্বস্তি। এই শুল পিত্তপ্রধান এক্ষেত্রে ঝুনা নারকেলের শাঁস বেটে, নিংড়ে, সেই দুধ ২/৩ চা-চামচ আধ কাপ গরম জলে মিশিয়ে তার সঙ্গে ২/৩ টিপ পিপুলের গুড়ো মিশিয়ে সকালের দিকে একবার খেতে হবে। কয়েকদিনের মধ্যে এটা উপশম হবে।
১৪. মাসিক ঋতুর দোষে: যাঁদের অনিয়মিত মাসিক হয় এবং স্রাবও ভাল হয় না, তাছাড়া রক্তের রঙও ভাল নয়, এক্ষেত্রে নারকেলের শিকড় ১০ গ্রাম, বাঁশের শিকড় ৭/৮ গ্রাম, বাঁশপাতা ৪/৫টি এবং বেগুন গাছের শিকড় ৫ গ্রাম একসঙ্গে থেতো করে, ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে, সকালের দিকে অর্ধেকটা ও বিকালের দিকে অর্ধেকটা খেতে হবে। তবে এটা খাওয়া উচিত সাধারণতঃ যে সময় (তারিখে) মাসিক হয়ে থাকে তার ৭/৮ দিন পূর্বে থেকে। মাসিক হয়ে গেলে অর্থাৎ চলা কালে এটা খাওয়া বন্ধ থাকবে। আবার পরের মাসেও সেই ৭/৮ দিন পূর্বে থেকেই খেতে হবে। এই রকম পর পর ২/৩ মাস খেলে ঐ অসুবিধেটা চ’লে যাবে। ১৫. আধ-কপালে মাথা ব্যথায়: যাকে আয়ুর্বেদে অর্ধভেদক বলে, এই রোগটির ডাক্তারি নাম Hemicrania. এই রোগে নারকেলের জলে ১০/১২ দানা চিনি মিশিয়ে অল্প অল্প করে নাক দিয়ে টেনে অথবা ড্রপারে করে নাকে ফেলে গলাধঃকরণ করতে হবে, অবশ্য অনভ্যস্ত যাঁরা তাঁদের অসুবিধে হবে বৈকি?
বাহ্য ব্যবহারে:
১৬. দাঁতের মাড়ী ফোলায়: যন্ত্রণা হচ্ছে, এক্ষেত্রে নারকেলের শিকড় পুড়িয়ে কয়লা করে সেটাকে মিহি গুড়ো করে, ছে’কে নিয়ে সেইটা দিয়ে আস্তে আস্তে দাঁত মাজতে হবে। তবে এর সঙ্গে একটু, ফিটকিরি ও কপার মিশিয়ে নিলে আরও ভাল উপকার হয়।
১৭. দাদে (দদ্রু রোগে): যেগুলি শক্ত হয়ে যায় আর গোল হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ঝুনা নারকেলের মালায় আগুন লাগিয়ে একটা পাথর বাটির মধ্যে পুরে একটা চায়ের কাপের ডিস, দিয়ে চাপা দিয়ে ঐ ঘামটা ধরে নিতে হবে, তারপর ঐটা তুলি করে কেবলমাত্র ঐ দাদের জায়গায় লাগাতে হবে। এটা লাগালে বেশ জ্বালাও করবে এবং ঐ জায়গাটা পুড়িয়ে দেবে; তারপর আবার ২/৩ দিন লাগানোর দরকার নেই, শুধু নারকেল তেল লাগাতে হবে; এই রকম হয়তো আর একবার লাগানোর দরকার হতেও পারে, নইলে একবার লাগালেও অনেকের সেরে যায়। তবে এটা একজিমায় লাগানো উচিত নয়।
রাসায়নিক গঠন:
(a) Fatty acids: Caproic acid, caprylic acid, capric, lauric and myristic (high precentage), palmitic, stearic, arachidic acid, oleic, linoleic acid.
(b) Undecanoic and tridecanoic acids.
(c) Mixed glycerides.
(d) Histidine, arginine, lysine, tyrosine, tryptophan, proline, leucine, alanine, phytosterols and squalene.
(e) Vitamins of the B group.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টচার্য: ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা,৩১৭-৩২১।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Diego Torres Silvestre
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।