আঙ্গুর বা আঙুর হচ্ছে vitaceae পরিবারের একটি লতানো উদ্ভিদ। ফল এবং পথ্য হিসেবে আঙুর গোটা দুনিয়াতে জনপ্রিয়। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Vitis vinifera Linn. উড়িষ্যাতেও এটি দ্রাক্ষা বা দ্রাক্ষালতা নামেই পরিচিত। আঙুর ফল মিষ্টি বা টক হয় মাটি, জল ও বায়ুর প্রভাবের তারতম্য। ঔষধার্থে ব্যবহার হয় শুকনো ফল বা কিসমিস বা মুনাক্কা, কাঁচা ফল বা আঙ্গুর ও গাছের পাতা। নিচে রোগ প্রতিকারে আঙুরের ব্যবহার পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো।
আঙুর একটি লতানো ঔষধি জনপ্রিয় ফল
প্রথমেই বলে রাখি, ঔষধ হিসেবে যখন প্রয়োগ করা হয়, তখন কিসমিস বা মুনাক্কা ব্যবহার করা ভালো। আঙ্গুর শুকিয়ে কিসমিস বা মুনাক্কা হয়। সত্যি, কিন্তু সুপক্ক না হলে সেগুলিকে শুকানো যায় না, সেইজন্যই রোগের ক্ষেত্রে কিসমিস বা মুনাক্কার ব্যবহার করা হয়।
১. মূত্রকৃচ্ছ্রতায় ও কোষ্ঠকাঠিন্যে: বেশি পরিমাণ তরকারি কম খাওয়ার অভ্যোস অথচ ঘি, দুধ এক ফোঁটা পেটে পড়ে না, তার ওপর বয়েস হয়েছে, এইজন্য পেটে বায়ুও হয় প্রচুর, তাই তার দাস্ত ও প্রস্রাব হতে সমস্যা হয়, এই রকম ক্ষেত্রের মূত্রকৃচ্ছ্রতায় ২০ গ্রাম কিসমিস ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে আন্দাজ তিন পোয়া; এক কাপ আন্দাজ এক পোয়া থাকতে নামিয়ে, চটকে, সিটেগুলি ফেলে দিয়ে সকালে ও বিকালে দুবার ঐ জলটা খেতে হবে। এর দ্বারা ২ থেকে ১ দিনের মধ্যেই ঐ কৃচ্ছ্রতা চলে যাবে।
২. ক্ষীণতায়: খাওয়া দাওয়া ঠিক আছে কিন্তু শরীর শুকিয়ে যায়, হাড় সার অথচ ক্ষিধেও কম নেই, বিশেষ কোনো রোগও নজরে পড়ে না; এ রকম ক্ষেত্রে দুধ এক পোয়া, কিসমিস ১২ গ্রাম, জল আধ সের বা ৫০০ মিলিলিটার একসঙ্গে পাক করে, ঐ দুধের পরিমাণ অর্থাৎ আন্দাজ এক পোয়া থাকতে নামিয়ে ঐ কিসমিসগুলি ওর সঙ্গে চটকে নিয়ে, সিটে ফেলে দিয়ে, ঐটা প্রত্যহ সকালে বা বিকালের দিকে খেতে হবে; তবে সকালের দিকে খেলে ভালো হয়, পেটে বায়ু হওয়ার ভয় থাকে না।
৩. পিপাসায়: গুরুপাক জিনিস কিছু খাওয়া হয়নি, গরমও নেই। অথচ পিপাসা, একবার জল খাওয়ার খানিকক্ষণ পরে আবার পিপাসা, এই রকম যে ক্ষেত্রে সেইটাকে ধরা হয় তৃষ্ণা রোগ, এখানে পলতার পাতা বা পটোলের পাতা ৩ থেকে ৪টি, ঐ পলতার ডাঁটা ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি, কিসমিস ৫ থেকে ৬ গ্রাম একসঙ্গে থেঁতো করে ১ গ্লাস গরম জলে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা, অন্তত ২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে, ওটা ছেঁকে, দুইবারে খেলে ঐ তৃষ্ণা রোগের সেরে যাবে। এই তৃষ্ণা রোগটা বেশি দিন চলতে থাকলে তারা স্বল্পায়ু হয়।
৪. ভ্রম বা ভুলে যাওয়া রোগ: সকালের কথা বিকালে ভুলে যাচ্ছে, এইসব লোকের আর একটা বিশেষ উপসর্গ থাকে, সর্বদা শরীরে দাহ, এক্ষেত্রে কিসমিস ১০ থেকে ১২ গ্রাম ও দুরালভা* (Alhagi pseudalhagi) ৫ থেকে ৬, গ্রাম থেঁতো করে ১ গ্লাস গরম জলে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে, তারপর তাকে ছেঁকে, সকালে অর্ধেকটা ও বিকালে অর্ধেকটা খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ ভ্রম রোগটা সেরে যাবে। তবে এটা বেশ কিছুদিন না খেলে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকার বোঝা যায় না।
৫. নেশাই পেশা: মাদই যাকে খেয়ে ফেলেছে, সেই মদের হাত থেকে রেহাই পেতে গেলে একমাত্র ব্রহ্মাস্ত্র হলো সকালে ও বিকালে দুই বেলাই ১০ থেকে ১২ গ্রাম করে কিসমিস চিবিয়ে খাওয়া, সে ওকে ত্যাগ করবেই; তবে চেলা চামুন্ডার হাত থেকে যদি রেহাই পায় তবেই।
৬. সন্তান লাভে: যাকে চলতি কথায় বলা যায় বাঁজা না নপুংসক। এ সন্দেহটা দুজনের মনেই দোলা খাচ্ছে কার দোষে আমরা নিঃসন্তান ? যাক সে কথা, এখন এর সাধারণ উপায় হলো মূল সমেত বলা গাছ যাকে আমরা চলতি কথায় বেড়েলা গাছ বলি ২০ থেকে ২৫ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ঐ ক্বাথ দিয়ে ৮ থেকে ১০ গ্রাম কিসমিস বেটে সরবতের মতো খাবেন। এটা স্বামী স্ত্রী দুজনকেই পৃথক পৃথক খেতে হবে। এক মাস কোনো দৈহিক সংস্রব রাখবেন না, পরে দুই এক মাসের মধ্যেই আপনাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। তবে একটা কথা বলে রাখি যদি শারীরিক কোনো বৈকল্য থাকে অর্থাৎ যেটায় অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে এটা বিফল হবে। আর একটা ক্ষেত্রে আছে যদি বেশি মেদস্যবী হয়ে থাকেন, তা হলে সেটাকে প্রথমেই মেরামত করে নিতে হবে।
৭. শ্লেষ্মার ধাতে: সে বালক বা বৃদ্ধ যে বয়সেরই হোক না কেনো, একটি পিপল ও ৮ থেকে ১০টি কিসমিস একসঙ্গে বেটে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে; তবে বালকের ক্ষেত্রে পিপল ও কিসমিস সিকি ভাগ নিতে হবে, এটাতে ঐ দোষটা চলে যাবে; তবে একটা কথা বলা দরকার যদি বংশের অর্থাৎ সে পিতার বা মাতার যে কুলেরই হোক তিন পুরুষের মধ্যে কারও হাঁপানি বা একজিমা ছিল, হাতের তালু, বা পায়ের তালু ঘামতো, এর কোনো একটি থাকলে সেটা কিন্তু জন্মসূত্রে পাওয়া, তবে এটাতে প্রকোপটা কমে যাবে, একেবারে নিরাময় হবে না।
৮. উদাবর্তে: বেশি খেলেই বা কি, আর কম খেলেই বা কি পেটটা যেন সর্বদা স্তম্ভিত হয়ে আছে জয়ঢাকের মতো, আর দুই থেকে এক মিনিট অন্তর সশব্দে ঢেকুর ওঠে, অনেক সময় দেখা যায় একটু ঝাল বা লবণ জাতীয় জিনিস খেলেই বমি হয়; এক্ষেত্রে ৮ থেকে ১০টি কিসমিস বেটে সরবত করে বিনা চিনিতে সকালে ও বিকালে দুইবার খেতে হয়। এটাতে ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই উপশম হয়ে থাকে।
৯. শোষ রোগে (Wasting disease): পিপাসা যে লেগেছে তাও নয়, অথচ ঠোঁট, জিভ, গলা শুকিয়ে যায়; সেটা চলতে থাকলে বুঝতে হবে ক্ষীণ রোগ খেলেও শরীরে পন্টি হয় না) ভবিষ্যতে আসছে, এক্ষেত্রে কসমিস ১০/১২ গ্রাম সামান্য লবণজলে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে খেতে হবে, এর দুবারা ঐ শোষরোগের ক্ষয়টা পূরণ হবে।
১০. পিত্তবিকারে: এটাকে বলা যায় ঋতুজ ব্যাধি, এই সময় তিতো বা তিক্ত না খেয়েও সকালের দিকে মুখ তিতা হয়; এক্ষেত্রে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি করে কিসমিস বেটে একটু পানিতে মিশিয়ে খেলে ঐ অনুভূতিটা থাকবে না বটে, তবে প্রকৃতির দান থেকে রেহাই পাওয়া যায় না ।
১১. ক্ষত ক্ষীণ রোগ: রোগটার গোড়াপত্তন হয় কোনো কারণে গুরুতর আঘাত লাগলে। বাইরে থেকে তার প্রকাশ হলো না বটে, কিন্তু ভিতরে কোনো শিরা হয়তো জখম হয়েছে বা ছিড়ে গিয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় সাময়িকভাবে সেটা সেরে গেলেও মাঝে মাঝে সেখানটায় ব্যথা অনুভব হয়, এই থেকে অনেকের একটু জ্বরভাবও হয় এবং রোগা হতে থাকেন; সেইটাই দেখা যায় পরিণামে ক্ষয়রোগে পরিণত হয়েছে। ঠিক এইরকম ক্ষেত্রে প্রত্যহ ৮ থেকে ১০ গ্রাম করে কিসমিসের সরবত খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে, তাহলে ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।
১২. রক্তপিত্তে: এক্ষেত্রে শালপর্ণী এই ক্ষুপ জাতীয় গাছের প্রচলিত নাম শালপাণি আর বোটানিকাল নাম (Desmodium gangeticum) গাছের সমগ্রাংশ ২০ গ্রাম নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে, ঐ ক্বাথে কিসমিস বেটে সরবত করে খেলে ঐ রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে।
১৩. নবজ্বর: কিসমিস লবণজলে ভিজিয়ে সেই কিসমিস কয়েকটি করে খেলে জ্বর চলে যায়।
রাসায়নিক গঠন
(a) Acids, viz., oxalic acid, malic acid, tartaric acid and otiner racemic acids. (b) Sucrose.
* এই দুরালভার গাছে খুব কাঁটা, উটে খেতে খুব ভালবাসে। এলাহাবাদ থেকে আরম্ভ করে পশ্চিমে মরু, অঞ্চল পর্যন্ত যেখানে সেখানে ঝোপ হয়ে আছে। ঐ অঞ্চলে একে বলে ‘যবাসা’, ‘উটকাটারা’। গাছ-গাছড়া বিক্রেতাদের দোকানে পাওয়া যায়। যবস=ঘাস (ঋকবেদ)।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১৭৮-১৮১।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Ivanace1
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।