পান পাতার নানাবিধ ভেষজ গুনাগুণ, উপকারিতা ও ব্যবহার

পান হচ্ছে পিপারাসি পরিবারের পিপার গণের একটি লতানো উদ্ভিদ। এরা গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার লতাজাতীয় গাছের পাতা। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Piper betle. পানের নানান জাত আছে। সাধারণত দু ধরনের পান বাজারে পাওয়া যায় কপুরি ও মলবারি। কপুরি পান আকারে ছোট আর স্বাদে মৃদু। বাংলা পানের আকার বড় হয় ও স্বাদে তীক্ষ্ণ। বাংলা পানের রস তীক্ষ্ণ, মলনিঃসারক, পিত্ত উৎপাদন করে, গরম এবং কফ হরণ করে। পাকা সাদা পাতলা ও ছোট আকারের পানই সবচেয়ে ভাল গুণের দিক থেকেও শ্রেষ্ঠ। কাঁচা সবুজ পানের চেয়ে পাকা সাদা পানেরই স্বাদ ও গুণ বেশি।[২]

পান স্বচ্ছ, রুচি উৎপাদক, তীক্ষ্ণ, উষ্ণ, কায়, মল পরিষ্কার করে, কটু, ক্ষারযুক্ত, রক্ত এবং পিত্তকারক, হালকা, বলপ্রদ, কফ, মুখের দুর্গন্ধ, বায়ু নাশক এবং শ্রম দূর করে। পান কামোদ্দীপক, রুচি বৃদ্ধি করে এবং বস্তিকর অর্থাৎ চেহারা সুন্দর করে।

বলা হয় পানের সরু ডগায় আয়ুষ্য, মধ্যে লক্ষ্মী আর মূলে যশের আবাস। সেইজন্যে পান সাজবার সময় এই সব অংশ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। নিম্নে রোগ প্রতিকারে পানের ভেষজ গুনাগুণ উল্লেখ করা হলো। পান পাতা সম্পর্কে জানতে বিস্তারিত পড়ুন

পান পিপার গণের ঔষধি অর্থকরী লতা

১. শ্লেমাপ্রধান রোগ: পানের রোগ-নাশিনী শক্তি সম্পর্কে সর্বাগ্রে মনে রাখতে হবে যেখানে শ্লেমাপ্রধান রোগ, সেখানেই তার প্রভাব বেশি; তাই রসতাত্ত্বিক আয়ুর্বেদগণ ঔষধের সহপানে পানের রস বেশি ব্যবহার করেন।[১]

২. মাড়ির ক্ষতে: দাঁতের মাড়ির দুষিত ক্ষতে পুঁজ জমতে থাকলে পানের রসের সঙ্গে অল্প জল মিশিয়ে কুলকুচি করলে ওখানে আর পুজ জমে না; মুখের ক্ষত শুকিয়ে যায়। আবার, পানের রসে তীক্ষ্ণতায় আছে জীবাণুনাশক গুণ। সেইজন্যে পরিমিতভাবে পান খাওয়া দাঁত ও মুখের পক্ষে ভাল। পানে একটি বিশেষ ধরনের তৈল পদার্থ আছে- সেইজন্যে পান মুখশুদ্ধি করায়, দাঁতের পচে যাওয়া রোধ করে। পানের স্বাদ তীক্ষ্ণ, কিছু সুগন্ধযুক্ত, পান খেলে মুখের বিস্বাদ দূর হয়ে যায়, অরুচি ও মুখের দুর্গন্ধও দূর হয়।

খাওয়া-দাওয়ার পরে একটা করে পান খাওয়া ভাল। ভোজনের পরে যদি মুখের ভেতরে তেলতেলে ভাব উৎপন্ন হয়, যদি দাঁতের মধ্যে খাবারের ফলা আটকে গিয়ে থাকে আর যদি দাঁতের গোড়ায় পোকা ধরে গিয়ে থাকে তাহলে পান খেলে সে সব দোষ নষ্ট হয় এবং মুখ সুগন্ধি হয়।

৩. চুলকানি: পুরাতন দাদ বা চাপড়া-চুলকানিতে পানের রস ঘষে দিলে কয়েক দিনেই ও অবস্থাটার অবসান হয়।

৪. কানের পুঁজে: এর রস গরম করে ২ থেকে ১ ফোঁটা কানে দেওয়ার বিধি গ্রামাঞ্চলে তো আছেই। পানের গরম রস কানে দিলে কানের ব্যথাও সারে।

৫. হাতে-পায়ে হাজায়: পানের রস অল্প গরম করে রাত্রে লাগিয়ে রাখুন; উপশম হবে তবে এটাও ঠিক যে, হেতুটা বর্জন না করলে সেটা  আবার হবেই।

আরো পড়ুন:  ইশ্বরমূল বা রুদ্রজটা লতার ছয়টি ভেষজ গুণাগুণ

৬. নখকুনির কষ্ট: পানের রস গরম করে দিনে ৩ থেকে ৪ বার নখের কোণে দিলে ব্যথা থেকে রেহাই হয়, তবে নখের ঐ বৃদ্ধিটুকু কাটতেই হয়।

৭. ফোড়ায়: পানের পাতার সোজা পিঠে ঘি (পুরাতন হলে ভাল হয়) মাখিয়ে ফোড়ার উপর বসিয়ে দিলে ফোড় পাকে ও ফাটে; আবার এইভাবে পানের উল্টোপিঠ ফোড়ায় বসালে ওটা পুজ টেনে বার করে শুকিয়ে দেয়; (অবশ্য একটু গরম করে নিতে হয়)। এখানে আর একটা কথা বলে রাখি পানের পাতায় পচন-নিবারক উদবায়ী তৈল আছে, যার জন্য ঐ ফোড়া বিসর্পিত হতে পারে না।

৮. মাথায় উকুন হলে: পানের পাতার রস মাথায় লাগিয়ে দেখুন ওরা সবংশে চলে যাবে। (তবে ঝাল পান হলে ভাল হয়। এ পানের গঠন একটু, মোটা হয়।)

গর্ভনিরোধ: পানের শিকড় বেটে খাওয়ালে ছেলেপুলে হয় না একথা গ্রামাঞ্চলের মধ্যে কানাঘুষা শুনতাম, এখন দেখি বর্তমানের প্রামাণ্য গ্রন্থ Glossary of Indian Medicinal Plants- এ এ-কথা লেখা আছে।

১০. হজমে: পানে একটি বিশেষ ধরনের তৈল পদার্থ আছে। সেইজন্যে পান পেটে পাচক রসকে উত্তেজিত করে খাবার তাড়াতাড়ি হজম করিয়ে দেয়। পান খেলে শরীরের অন্নাশয়িক নালীর (গাস্ট্রিকের) এবং পাচক রসের স্রাব বাড়ে- এইভাবে খাবার হজম হয় তাড়াতাড়ি। যদি গুরুভোজন বা অতিভোজন হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে পান খেলে পেট হাঁসফাস করা থেকে একটু নিস্তার পাওয়া যায় এবং একটু যেন শরীরটা হালকা মনে হয়। পানের রস পাচক, অগ্নিদীপক অর্থাৎ খিদে বাড়ায় এবং বায়ু হরণ করে। সেইজন্যে পানের রস পেট গেলে বায়ু নীচে বসে যায়, তৃপ্তির ঢেকুর ওঠে এবং পেটে একটা শান্তির ভাব অনুভব করা যায়।

১১. কফ, বাত ও পিত্তের প্রকোপে: পানে চুন ও খয়ের থাকে। তার ওপরও এলাচ, ধনের চাল, মৌরি, সুপারি লবঙ্গ প্রতি মশলা দিয়ে পান সাজা হয়। এগুলির আছে নানা গুণ। চুন বাত ও কফ হরণ করে, খয়ের পিত্তের প্রকোপ দূর করে।

পান রসে তীক্ষ্ণ, কটু, কষায়, উষ্ণবীর্য (কড়া-শরীর গরম করে), পিত্ত-প্রকোপ বাড়িয়ে দেয় এবং বায়ু প্রকোপ কম করে। কিন্তু চুন ও খয়ের সহযোগে খেলে পান ত্রিদোষ (কফ, বাত ও পিত্ত) নাশক হয়ে যায়। ভাতের পরে একটা পান চিবিয়ে খেলে মন তৃপ্ত ও প্রফুল্ল হয়।

পান সকালে খেলে তাতে সুপারি, দুপুরে খেলে তাতে খয়ের আর সন্ধেবেলা খেলে তাতে চুন বেশি দেওয়া উচিত (অবশ্য গাল যেন না পুড়ে যায়)। এই পদ্ধতিতে পান খেলে সকালবেলা কফ, দুপুরবেলা পিত্ত আর সন্ধেবেলা বায়ুর সমতা বজায় থাকে।

পান কফ নাশক বিধায় পানের ভেতরের বিশেষ প্রকারের সুগন্ধিযুক্ত তেল শ্বাসনালীর ভেতরটা যদি কোনো কারণে ফুলে যায় তা সারিয়ে দেয়।

আরো পড়ুন:  ঘোড়া গুলঞ্চ ও পদ্ম গুলঞ্চ লতার ঔষধি গুণাগুণ ও উপকারিতা

১৩. খাবারের পর স্বস্তি আনতে: স্নিগ্ধ, মধুর ও গরিষ্ঠ ভোজনের পর পান খেলে স্বস্তি পাওয়া যায় বিশেষত উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুর দেশে যাঁরা থাকেন এবং যাঁরা ভাত খান তাঁদের ভোজনের পর একটি করে পান খেলে বেশি উপকার হবে।

পানের চুন যাতে শরীরের ক্ষতি না করে সেইজন্যে পানে খয়ের মেশানো হয়। শুধু চুন রক্তে মিশে যেতে পারে না কিন্তু পানের ক্লোরোফিল বা সবুজতার সঙ্গে এক হয়ে গিয়ে সহজে হজম হয়ে যায়। এতে দাঁতের উপকার হয় এবং পেটের পাচক রসও কাজ করে তাড়াতাড়ি।

১৪. গ্যাস আর বদহজমে: পাকা পান আর সজনের ছাল একসঙ্গে নিয়ে রস বের করে তিন দিন নিয়ম করে খেলে অন্ত্রে যদি বায়ু সৃষ্টি হয় তার উপশম হবে।

পানের রসে মধু মিশিয়ে চাটলে আধোবায়ু মুক্ত হয়। ছোটদের গ্যাস আর বদহজমে খুব তাড়াতাড়ি উপশম পাওয়া যায়।

১৪. স্বর ভাঙ্গায়: পানের শিকড় তীক্ষ্ণ, স্বল্পশোধক, কফনাশ করে। যদি কোনো কারণে গলা বসে যায় তো পানের শিকড় (বাজারেও পানের দোকানে পাওয়া যায়) খেলে গলায় স্বর খুলবে।[২]

১৫. সর্দি ও কাশিতে: একটি বা দুটি পান পাতা চিবিয়ে নিলে সর্দিতে উপকার পাওয়া যায়। আবার পানের শিম্বির (পান গাছে যে সিমের মতো ফল হয়) চূর্ণ মধুতে মিশিয়ে চাটলে সর্দির জন্যে যে কাশি হয় তা সেরে যায়।

পান পাতায় রেড়ির তেল লাগিয়ে একটু গরম করে ছোট শিশু বুকের ওপর রেখে কাপড় গরম করে হালকাভাবে সেঁকে দিলে শিশুর বুক ভরা কফ দূর হয়।

১৬. চোখের ব্যথায়: পানের রস চোখে দিলে রাতকানা রোগে উপকার হয় এবং চোখে ব্যথারও উপশম হয়।

১৭. বুকের দুধ বেড়ে গেলে: প্রসূতা স্ত্রীর যদি বুকের দুধ খুব বেড়ে গিয়ে স্তন ফুলে যায় এবং ব্যথা হয় তাহলে পান পাতা গরম করে খেলে অতিরিক্ত দুধ বেরিয়ে গিয়ে ফুলো কমে যায় এবং ব্যথাও কমে যায়।

পান বেশি খেলে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি

১. পান বেশি খেলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

২. বেশি পান খান যাঁরা তাঁদের রক্তে বিশেষ ধরনের একটি বিষতত্ত্ব প্রবেশ করে। এর ফলে হজমের গোলমাল দেখা দেয়। বেশি খয়ের খেলে ফুসফুসের ক্ষতি হয় এবং অন্ত্রের বিকৃতি ঘটে।

৩. পানের সঙ্গে সুপারি অধিকমাত্রায় খেলে চুলকুনি হয়।

৪. যিনি পান খাচ্ছেন তিনি যদি শোওয়ার আগে মুখ ভাল করে পরিষ্কার করে না নেন অর্থাৎ ধুয়ে না নেন তাহলে দাঁতের ক্ষতি হবে। মাড়ি দুর্বল হয়ে যাবে এবং দাঁত তাড়াতাড়ি পড়ে যাবে। দাঁত লাল হয়ে যায়, দাঁতের গোড়া ঢিলে হয়ে যায়, দাঁত খারাপ হতে আরম্ভ করে। এই লাল-কালো ছোপ ধরা দাঁতের জন্যে হাসির সৌন্দর্য আর থাকে না অতএব মুখশ্রী যতই সুন্দর থাকুক বেশি পান খাওয়া দাঁতের কালিমা সব কিছুকে আড়াল করে দেয়।

আরো পড়ুন:  নোয়ালতা বাংলাদেশে সংরক্ষণ নির্ভর এবং এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার ঔষধি লতা

৫. সারা দিন ধরে পান চিবানো স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়। খাওয়ার পরে মুখশুদ্ধি হিসেবে একটি করে খাওয়া ভাল। বেশি পান খেলে দাঁত খারাপ হয়ে গিয়ে পাইয়োরিয়া রোগের সৃষ্টি হয়। দাঁতের অসুখ, চোখের অসুখ শক্তিক্ষয় আর মুখের রোগ হয়।

৬. পিত্তপ্রকোপ বেড়ে যায়, শরীর বেশি গরম হয়ে যায় এবং ধাতুর উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে শরীরের ক্ষতি হয়।

৭. যেখানে সেখানে পানের পিক ফেলা অতি কু-অভ্যাস। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে বলা হয় পানের প্রথম পিক গিলে ফেললে বুদ্ধিনাশ হয়। দ্বিতীয় পিক গিলে ফেললে মলের বেগ আসে। তৃতীয় পিক এবং তার পরের সব পিকই গিলে ফেলা যেতে পারে। কারণ এই রসকে অমৃতের সমান বা অমৃততুল্য বলে মনে করা হয়।

পানের তেল: পানের আরও উপযোগিতা আছে। এটা থেকে তেল নিষ্কাশন করা হয়। প্রায় ৫০ হাজার পান পাতা থেকে ১ কিলোগ্রাম তেল পাওয়া যায়। এক কিলো তেলের দাম প্রায় ২০ হাজার টাকা। এই তেল দিয়ে তৈরি হয় নানা রকম অ্যালোপ্যাথি ও কবিরাজি ওষুধ। পান গাছের শেকড় থেকে তৈরি হয় উকুন মারা ওষুধ ও কানের অসুখের জন্য ওষুধ বা ড্রপ। পানের তেল বিভিন্ন সুগন্ধি তৈরি করবার কাজেও ব্যবহার করা হয়।

যাদের পান খাওয়া উচিত নয়: (১) রুক্ষ ও দুর্বল ব্যক্তির, (২) মা রোগীর ও যার চোখ উঠেছে, (৩) রক্তপিত্তে, ক্ষয় ও যক্ষা রোগীর, (৪) অতিরিক্ত নেশার পর।

রাসায়নিক গঠন:

(a) Phenolic compounds viz. chavicol, hydroxychavicol. (b) Vitamin viz. ascorbic acid. (c) Enzymes. (d) Essential oil.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১৯৯-২০০।

২. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৬-৫৯।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Lrbinu

Leave a Comment

error: Content is protected !!