৫৬ টি কবিতা নিয়ে কবি দোলন প্রভা’র প্রথম প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থ ‘স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে’ বইটি যুগোপযোগী সময়ের এক অনবদ্য সৃষ্টি। প্রতিটি কবিতাই যেন এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে জেগে ওঠা, বেঁচে থাকা ও নতুন কিছু নির্মাণের আবাসভূমি। যেখানে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় বিজড়িত খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের জীবন চিত্র অঙ্কিত হয়েছে; প্রকৃতির সাথে গেঁথে থাকা আত্মকাহিনীর ভাব-গাম্ভীর্য ফুটে ওঠেছে। আর কবি এখানে তাঁর অন্যন্য সজীব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এক নিজস্ব স্বত্তায় ভাষার গাঁথুনিতে সৃষ্টি করেছেন একেকটি শিল্প কর্ম।
প্রতিটি কবিতার ভাব-ভঙ্গি, উপমা যথেষ্ট সাবলীল। কবিতার পঙক্তিতে প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন রঙে উঠে এসেছে এবং বাস্তবতার সাথে মিশিয়ে গভীর আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ পেয়েছে। এই আকাঙ্ক্ষাই ভবিষ্যতে একটি যৌথ খামার তথা যৌথ সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের চারণভূমি। কবি স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন ইঙ্গিতে, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে সমাজ পাল্টানোদের প্রতি গভীর অনুরক্ত ও অনুভূতির আঙ্গিকে বার বার ডাক দিয়েছেন।
কবিতার বইটির প্রচ্ছদটি বিশিষ্ট চিত্র শিল্পি ভিনসেন্ট ভ্যানগগ এর একটি বিখ্যাত ছবি দিয়ে বাঁধায় করা; যে ছবিটি খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌথতার চর্চার বন্ধনকে দৃঢ় করেছে; আর এ প্রচ্ছদটিও কবিতার বিষয়াবলির ভাব-ভূমির রেখাকে পূর্বাভাসে প্রস্ফুটিত করেছে।
কবিতার ভূমিকায় কবি যদিও বলেছেন, ‘সমাজকে পাল্টাতে যখন প্রয়োজন বিদ্রোহের, কবিতা তখন খুব সামান্য অবদান রাখতে পারে’। কিন্তু এ কথাটি সরল আঙ্গিকে কবি বললেও পৃথিবীর সমাজ পাল্টানোর পথকে প্রসস্থ করতে, বিপ্লবে রূপ দিতে কবিতা গভীর থেকে খোরাক জোগিয়েছে, সমাজ প্রগতির ধারাকে ত্বরাণিত করেছে, সমাজ ও যুগের প্রেক্ষাপটে বহু কবিতাই হয়ে ওঠেছে অনবদ্য।
কবিতা তো তার নিজস্ব আঙ্গিকে বিদ্রোহের খোরাকের প্রেরণা হয়ে ওঠে, নতুন শক্তিতে সে নব প্রাণে সঞ্চারিত হয়। সেই বিদ্রোহীদের খুঁজতে কবি তাঁর ‘কবিতা জানাতে চায়’ কবিতায় বলছেন,
‘‘কবিতা নিরবে পাড়ি দেয় এক যুগ থেকে অন্য যুগে,
সে ছবি আঁকে, সিন্দুকে বন্দি থাকা ইতিহাসের কষ্ট নিয়ে,
সে প্রশ্ন করে, প্রতিবাদ জানায় সময়ের দাবি তুলে ধরে।’’
নতুন যুগের সন্ধানের প্রত্যয় নিয়ে কবি ডাকছেন, খুব আন্তরিকতার ভাবে, প্রাণ দিয়ে আওয়াজ তুলতে, শক্তভাবে দাঁড়িয়ে অধিকারের কথা বলতে- ‘ব্রহ্মশৈলী’ কবিতায়-
‘‘তুই কি থাকবি আমার পাশে?
হাঁটবি আমার সাথে টুকটুকে স্বপ্ন নিয়ে?
জগতের স্বাভাবিক সব সুর সঁপে দেব
তোর অঙ্গে যদি হতে চাস নির্মল ধ্বনি।’’
কৃষকের ঘামে জমে ওঠা বিত্তের পাহাড় চলে যায় মহাজনের ঘরে; কৃষক, কৃষকই থাকে; প্রকৃতির আবাহনে ঋতু যায় ঋতু আসে; প্রতি ঋতুতে সে নতুন ফসল ফলায় আর নতুন নতুন ভাবে শোষণের শিকার হয়। জীবন-যুদ্ধে কামারের হাঁপরের মতো সে হাঁপিয়ে ওঠে, তবুও সে স্বপ্ন দেখে, নতুন দিনের, নতুন ভোরের ছায়ায় কোনো প্রান্তরে মুক্ত আকাশের মতই হয়তো একদিন বোপণ হবে তার স্বপ্ন বীজ। ‘আশা’ কবিতায় কবির সে স্বপ্ন বীজের কথা বলা আছে-
‘‘সারা মাঠ ঘুরেছে যে কৃষক
তার রোদে পোড়া পেশীর ঘাম ঝরা শ্রম
একটু একটু করে হারায় মহাজনের ঘরে।
এক ঋতুতে চাষ করে জমি, এক ঋতুতে
আশা বপন, আরেক ঋতুতে টেনে যায় সে
আরো কিছুদিন বাঁচার হাঁপর।…………
এবার একটু সুখে বৃষ্টি নামুক মাটির বুকে,
ক্ষেত কাদায় ভরুক, আরেকটি স্বপ্ন বপন হোক।’’
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে প্রতিদিন কিছু প্রতিবাদ হয়, নির্যাতনের রেখার ইতিহাস অঙ্কিত হয় পৃথিবীর বুকে, মধ্যম শ্রেণির মানসিকতায় নিয়ে আমরা বিবেকহীন হয়ে চেয়ে থাকি, হয়তবা মেকি সুরে গেয়েও উঠি দু’একটি প্রতিবাদের গান বা কবিতার লাইন। কবি এ দৃশ্য দেখে নিরাশ হন, তবুও রাতের আকাশের ‘নির্মল ভাব’ তাঁকে নব দিনের আশার ইঙ্গিত দেয়। ‘কাক ও ঝড়’ কবিতায় তিনি গেয়ে ওঠেন-‘‘রাতের আকাশ আবছা প্রভা ছড়িয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে/ ভূমি বুকে নবজন্মের বীজ বপন করে।’’
এই বইয়ের প্রথম কবিতা ‘নাগমতির সুর’; এ কবিতায় কবি রূপকার্থে নতুন পৃথিবীর কথা বলেন, আজকের এ আধুনিক পৃথিবীতে শোষণ, বঞ্চণা আর বিগ্রহের জায়গা থেকে নাগমতি নদীর বুকে একটি নতুন চর যেন নতুন একটি সভ্য পৃথিবীর ইঙ্গিত। আর পুরনো নাগমতির বুকে বহুকষ্টে মানুষ দিনযাপন করে, তবুও একদিন তারা জোরালো কন্ঠের কলরবে সুর তুলে পাহাড় তথা পৃথিবীকে কাঁপায়। ‘আগমনীর পত্র’-তরুনেরা আনমনে পথ চলে নতুন সুর বাঁধে, পৃথিবীর বুকে বহুদূর ছেঁয়ে যায় তাদের স্বপ্নের পতাকা, তাদের সম্মিলিত সুর পৃথিবীর বুকে আলো বিকিরণ করে, তারা মিট মিটি করে একসাথে জ্বলে ওঠে তারকারাজির আঙ্গিকে।
‘স্মৃতিচারণ’ কবিতায় কবি তার বাল্যকালের কথা বলতে গিয়ে পৃথিবীর পরিবর্তনের রূপ-রেখাকে অঙ্কন করেছেন। হঠাৎ ধনী হয়ে যাওয়া ব্যক্তি যেমন তার পুরনো স্মৃতিকে ভুলে, আপজনদের ভুলে গিয়ে স্বার্থপর হয়ে ওঠে, প্রকৃতি বুকে কৃত্রিম কংক্রিটে গড়ে ওঠে যেমন তেমনি অহমী হয়ে গেছে, তাই সে তার বাল্য বন্ধু কবিকে আর চিনতে পারে না। কিন্তু বাল্যকালের স্মৃতিপটে গেঁথে থাকা প্রকৃতির প্রতি কবির প্রেম অকৃত্রিম। তার প্রতিটি সৌন্দর্য ও রূপ লাবণ্য কবিকে আলিঙ্গন করেছে, কিন্তু বর্তমানের ব্যক্তির ভেতর অহমবোধ কবিকে ব্যথাতুর করে তোলে। সেকথায় কবিতাই উঠে আসে- “ধূসর পাথরে পড়ে থাকা শ্যাওলার মতো মলিন হয়েছে/ তোমার প্রতি আমার আজকের প্রেম।” কবি পৃথিবী ঘুরেছেন, সে ব্যথাকে দমিয়ে বড় স্বপ্নের জন্ম দিয়েছেন, বৃহত্তর হৃদয়চিত্তে সমগ্র পৃথিবীকে আপন করে নিয়েছেন নতুন আঙ্গিকে, তাই তিনি গাইছেন- “আমি এখন অনেক দূরে/ শুধু চোখে জীর্ণতা মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে,/ ছন্ন ছাড়া হয়ে বসত করি অনেকের মাঝে, /আমার দেশ নেই, নেই কোনো আধো নগরায়ন।”
যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসনে পথ-প্রান্তর যতই রূপ বদলাক না কেন, যৌথতা ছাড়া সে রূপের লাবণ্যতা এখানে মলিন হয়ে ওঠে; তাই কবির বাল্যবেলার স্বপ্নে গাঁথা চির চেনা ডাঙ্গীপাড়াকেও ৩০ বছর পরে যান্ত্রিক সভ্যতার স্পর্শে মলিন লাগে।
‘ভোরের ডাক’ এ পুরনো দিনের জলাঞ্জলিকে কবর দিয়ে নতুন সোনালী দিনের স্বপ্নকে জাগরিত করেছেন। জীর্ণতা ঝেড়ে পৃথিবী সাজবে তাঁর নতুন সাজে নতুন অভ্যুদয়ে, শতাব্দীর জীর্ণতাগুলো কেটে উঠে আসবে একটি নতুন ভোর। আর এই ভোর থেকেই মুখরিত পরিবেশে শুরু হবে নতুন সৃষ্টির, নতুন দিনের পথ চলা। ‘অপরাজিতা’য় তিনি ভেসে যান প্রশান্তির ছোঁয়ায়, স্বচ্ছ জলরাশির দ্বীপে জেগে ওঠা নবপৃথিবীতে। আশাবাদি কবি তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পান সে পৃথিবীর সৌন্দর্য। কল্পলোকে তিনি হারিয়ে যান সোনালী চাঁদের আলো থেকে নীল পাহাড়ের বুকে।
‘চারণভূমি’, ‘সভ্যতা’, ‘তবু এগিয়ে চলা’, ‘প্রতীক্ষা’ প্রভৃতি কবিতায় কবি একদিকে মহাকালের ভাঙ্গা-গড়ার ইতিহাসকে অঙ্কন করেছেন, আরেকদিকে সভ্যতার নির্মম গ্লানিকে আঘাত করেছেন এবং নতুন সমাজ গড়ার মানসে এগিয়ে চলার গান গেয়ে প্রতীক্ষার কথা বলছেন। নিজেকে সমাজ নির্মাতাদের দলে মিলিয়ে দিয়ে বলছেন-“এখন আমি নতুন দিনের খোঁজে তাদের দলে/ যারা নতুনের গান গেয়ে নতুন স্বপ্ন আনবে বলে/ চলছে নিজের আঁকা দিগন্তে,/ যাদের পদাঘাতে চূর্ণ হয়ে পিছনে পড়ে থাকবে/ পুরনো নীতির আর্বজনা।” আর নতুন দিনের প্রতীক্ষায় স্বপ্ন নিয়ে গাইছেন-“রঙিন শিশির এসে ছুঁয়ে যাবে অর্ধ ফুটন্ত প্রেম,/ শান্ত কোমল হাতগুলো প্রভা ছড়াবে রঙিন কাগজে।” সেই সাথে ‘নিরালা দুপুর’কে যুক্ত করে এ স্বপ্ন রাজ্যকে সাজিয়ে তুলছেন আরও ভিন্ন এক নতুন আঙ্গিকে। এখানে প্রকৃতির সাথে প্রিয় মানুষের সাথে হৃদয়ানুভবের কথাকে ব্যক্ত করছেন; এগিয়ে চলার গতিকে তরান্বিত করতে আশা নিয়ে বলছেন- “এমনি এক নিরালা দুপুরে টুপ টুপ বৃষ্টিতে/ আমরা যাব সবুজ ভূমির বুকে।”
‘ভিন্নকিছুতে’ দেখি কবির আশঙ্কা_ উদ্বিগ্ন কন্ঠে তিনি বলেন “স্বপ্নের ফুল এখনো অযত্নে পড়ে আছে/ যে কলিরা ফুটে নি পারবে কি তাকে এই অকালে ফোঁটাতে।” কিন্তু দিগন্ত কবিতায় তার আভাসকে ঝেড়ে ফেলে সভ্যতাকে আগুনের ফুলকি রূপে দেখছেন; যেখানে মৌমাছির মতো শ্রমজীবীরা নতুন কিছু নির্মাণের আঙ্গিকে দলবদ্ধ হয়।
সমাজে বড় ধরনের গ্লানির স্তুপে যখন একটি ব্লিডিংয়ের গঠনশৈলীর দূর্নীতি নিয়ে ক্ষণিকের মূহুর্তে ঝড়ে যায় হাজারো প্রাণ আর বিচারের দাবিতে গুণতে হয় প্রহরের পর প্রহর তখন কবির ব্যথিত হৃদয়ে ভাব প্রকাশিত হয় ‘নীরবতা’ কবিতায়।
‘তৃপ্ত আশার খোঁজে’, ‘নোনা শ্রমিক’, ‘শ্রমপাড়া জেগে ওঠো’, ‘পেয়ালা’, ‘কাক ও ঝড়’, ‘গাঁথুনি’, ‘বিভাজন’, ‘তামাটে মুখ’ কবিতাগুলোতে কৃষক-শ্রমিকের জীবন চিত্রের রেখা অঙ্কিত। তাদের নিত্য দিনের খেটে খাওয়া জীবনের আশা-আকাঙ্খা, সুখ-দু:খের কথা প্রকৃতির সাথে যেভাবে মিশে আছে কবি তা তুলি দিয়ে অঙ্কন করেছেন। তাদের হৃদয়ের স্বপ্নগাথা কথাগুলোও ফুটে ওঠেছে এক ভিন্ন আঙ্গিকে। শ্রমিকেরা ভিন্নভাবে শোষিত হচ্ছে; বুর্জোয়াদের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের স্বপ্ন; তাদের তামাটে মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে; তবুও বাঁচার আশায় কাকের মতো জীবন নিয়ে তারা লড়ায়ের ঝড় তুলছেন আর গাইছেন- “প্রতিদিন নিরবে বৃষ্টি ঝরে এ-মাটির বুকে/………………./ রাতের আকাশে আবছা প্রভা ছড়িয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে/ ভূমি বুকে নবজন্মের বীজ বপন করে।”
‘ক্ষত’ কবিতায় নিজের কষ্টকে ভুলে গিয়ে কবি দৃঢ় মনোবলে পিষ্ট করতে চেয়েছেন এভাবে— “সভ্যতার সভ্য দালানের দেয়ালে লেপটে আঁকা যে ক্ষত,/ সে ছবি কষ্ট হয়ে কাঁটার মতো কাতরে উঠেছে মহাকালের বুকে,/ আমি কষ্টকে গভীর থেকে শুষে নিতে চাই আলতো হাতে।”
আর ‘অনুভূতি’ কবিতায় যেন এক নতুন কিছু নির্মাণের হৃদয়ানুভকে জাগিয়ে তুলছেন কবি, বলছেন— “সাদা স্বপ্ন দেখে যারা নিশানা নিয়েছে হাতে,/ প্রকাশ করতে হবে, যতটুকু বাসা বাঁধে বুকে।”
‘যুগল প্রতিজ্ঞা’য় যেন এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে কবি প্রতীক্ষা করছেন তাঁর ‘অপেক্ষা’ কবিতায় কিশোর, তরুণ ও নব সৃষ্টিশীলদের পানে অসীম প্রত্যয়ে। এ দু’টি কবিতায় তিনি বলছেন, “সে রাত ছিলো মতামতের, ঐক্যের,/ সে রাত ছিলো শক্তি নেবার- শক্তি দেবার,/ শ্রমিকের স্বপ্নের সাথে নিজের স্বপ্নকে মেলাবার।” অপেক্ষা নিয়ে বলছেন— “সশব্দ পদচারনা দিয়ে আমি থেকে আমরা অপেক্ষামান-/অসীম ভালবাসা, শক্তি, প্রেমের প্রতিশ্রুতিতে।”
মহাকালের বুকে বীর তারকাদের বীরের গুণকীর্তন করতেও কবি ভোলেননি। তাঁর ‘বুকের না নেভা তাপ’; ‘তুমি এক নক্ষত্র’; ‘তোমার স্মৃতি জেগে ওঠে শক্তি’; কবিতাগুলোতে প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন-সংগ্রামের ইতিহাস থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে পৃথিবীর বুকে মহামানব হয়ে ওঠা মানুষের সংগ্রামের জীবনাদর্শন আমাদের হৃদয় পটে নাড়া দেয়।
কবি বইটির ভূমিকায় সমাজ পরিবর্তনের ধারাকে বদলানোর কথা বলতে গিয়ে বিদ্রোহ বা বিপ্লবের কথাকেই জোর দিয়েছে এবং কবিতার অবদানকে সামান্য আকারে প্রকাশ করছেন। কিন্তু তার রচিত-‘কবিতার জন্ম’; ‘কবিতা জানাতে চায়’,‘উর্বর’; ‘কবিতা’; প্রভৃতি কবিতা দিয়ে কবি বিপ্লবের পাশাপাশি কবিতার মাধ্যমে সমাজ পালটানোর কথাকে তীব্রভাবে উপলব্ধি করার অনুভূতিকে জাগরিত করেছেন। কবিতা যে তার কথা অকপটে বলতে পারে, অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে ন্যায়ের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা জোর গলায় তুলতে পারে। শ্রমজীবীদের মেহনতের ফসলের কথা নব শক্তিতে রূপ নিতে পারে; এসব কবিতা তার রূপ জীব্যকে জানিয়ে দিয়ে বইটির মর্যদাকে আরও প্রাণবন্ত ও যুগোপযোগী করে তোলেছে।
বইটিতে পঙক্তির প্রাচুর্য কবিতার গাঁথুনিকে সুন্দর ও সাথর্ক করেছে। রূপকতা দিয়ে প্রকৃতির সাথে জীবন-সংগ্রামের যে হাল-চিত্র তার, ভাব-ভঙ্গি সেটা অমায়িক। কিছু কবিতায় উপমার সাথে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের ধ্বনিতে আঁকা ছন্দ, ভাব-ভাষা যে সমবেতই ঘটিয়েছেন তা বেশ গতিশীল; কবিতা সেখানে নিজেই নিজস্ব স্বত্তা সৃষ্টি করেছে সমাজকে পাল্টানোর প্রতি অনুরক্ত হওয়ার অনুভূতি।
দু’টি কবিতার কথা বলে লেখার ইতি টানব, কবি ‘প্রশ্ন’ কবিতায় খোলা পৃথিবীর অফুরন্ত সম্ভাবনা দেখে প্রশ্ন রেখেছেন আগামীর পথ নির্মাতাদের কাছে এভাবে— “শীতল ছোঁয়া নিতে দরজা খুলে দাও/ দেখ কেউ ছুটে চলছে;-/ তেমার উষ্ণ ভবন নির্মাণে,/ তা দেখে তোমার কী অনুভুতি?
শোষকরা মানুষকে যখন বেঁধে ফেলছে শোষণ আর গ্লানির এক বৃত্তে। তখন বাঁচার তাগিদে দিন-ভর হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়। স্বপ্নগুলোকে গলা টিপে হত্যা করে শাসক রাজ্যের কূট-কৌশল; তখন কবি সে ঘোর কাটিয়ে ওঠতে ‘স্বপ্নওয়ালা’ কবিতায় আহ্বান করছেন হৃদচিত্তে; বারবার ডাকছেন হৃদয় দিয়ে, নব নির্মাতাদের তার স্বপ্ন পৃথিবী গড়তে; যেখানে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠবে এক যৌথ খামার। কবি যৌথ খামারের স্বপ্নওয়ালাদের মিনতি করছেন-“স্বপ্নওয়ালা একবার এসো আমাদের শহরে;/ভুলে গিয়েছি আমরা স্বপ্ন দেখতে;/ আমাদের সোনালি চোখগুলো আজ পড়ে আছে/অন্ধকার গলি পথের ডাস্টবিনের পাশে।/ তোমার স্বপ্ন কাঠির এক ঝটকায়/আমরা আবার দেখতে চাই রাঙা ভোর।”
সর্বপুরি আধুনিক কবিতার আঙ্গিকে রচিত দোলন প্রভা’র ‘স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে’ কবিতার বইটি এক শৈল্পিক ভাবনা ও মানুষের হৃদয়ানুভূতির সতস্ফূর্ত বহি:প্রকাশ।