গের্তসেন স্মরণে

গের্তসেনের[১] জন্মের পর থেকে এক শ’ বছর কাটল। সমগ্র উদারপন্থী রাশিয়া তাঁর উদ্দেশে শ্রদ্ধানিবেদন করছে – তবে, সেটা করতে গিয়ে তারা সমাজতন্ত্রের গুরুত্বসম্পন্ন প্রশ্নগুলোকে বেশ ভেবে-চিন্তে এড়িয়ে যাচ্ছে, যা বিপ্লবী গের্তসেনকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছিল উদারপন্থী থেকে সেটাকে তারা গোপন করছে আয়াস খাটিয়ে সযত্নে। দক্ষিণপন্থী পত্রপত্রিকাগুলিও গের্তসেন শতবার্ষিকী উদযাপন করছে, তাতে তারা জোর দিয়ে এই মিথ্যাটা বলতে চাইছে যে, শেষ-জীবনে গের্তসেন বিপ্লব পরিত্যাগ করেছিলেন। ওদিকে বিদেশে উদারপন্থী আর নারোদনিকদের বক্তিমাগুলোয় বাঁধা বুলি কপচানি উপচে পড়ে।  

শ্রমিক শ্রেণির পার্টির গের্তসেন শতবার্ষিকী উদযাপন করা উচিত – কূপমণ্ডকের মতো মহিমাকীর্তনের জন্যে নয়, নিজ করণীয় কাজগুলোকে স্পষ্ট করে তোলার উদ্দেশ্যে, রুশ বিপ্লবের পথ বাঁধিয়ে দিতে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন এই যে-লেখক, ইতিহাসে তাঁর পাওয়া যথার্থ স্থান নিরূপণের জন্যে।

গত শতকের প্রথমার্ধের অভিজাত আর জমিদারদের মধ্যেকার বিপ্লবী পুরুষ-পর্যায়ের মানুষ গের্তসেন। অভিজাত-সম্প্রদায় রাশিয়াকে দিয়েছিল বিরোনদের[২] আর আরাকচেয়েভদের[৩], আর দিয়েছিল অসংখ্য ‘মাতাল অফিসার, পোষা গণ্ডা, জুয়াড়ী, মেলার সন্তান, কুকুরের পালের মনিব, হুল্লোড়বাজ, বেশ্যার দালাল’, আর সৌজন্যপূর্ণ মানিলোভদেরও (৪)। ‘কিন্তু, গের্তসেন লিখেছেন, ‘তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিলেন ১৪ই ডিসেম্বরের মানুষগুলি (৫), দৃঢ়বদ্ধ বীর যোদ্ধাদল, রোমুলাস আর রেমুসের (৬) মতো বাঘের দুধ খেয়ে মানুষ… তাঁরা যথার্থই ছিলেন এক-একজন মহাবীর, আপাদমস্তক খাঁটি ইস্পাত পিটিয়ে গড়া, সংগ্রামে সহযোদ্ধা তাঁরা সুচিন্তিতভাবে এগিয়ে গিয়েছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুমুখে। নবীন পুরুষ-পর্যায়কে নতুন জীবনে জাগিয়ে তোলার জন্যে, জুলুম আর হীনানুগত্যের পরিবেশে জাত সন্তানদের শোধন করার জন্যে (৭)।’

গের্তসেন ছিলেন ঐসব সন্তানের একজন। ডিসেম্বরীদের অভ্যুত্থান তাঁকে জাগরিত এবং ‘শোধিত’ করেছিল। উনিশ শতকের পঞ্চম দশকের সামন্তবাদী রাশিয়ায় তিনি এত উঁচুতে উঠেছিলেন, যাতে তাঁর স্থান হয়েছিল মহত্তম সমসাময়িক চিন্তাবীরদের সমপর্যায়ে। হেগেলের (৮) দ্বন্দ্বতত্ত্ব তিনি অঙ্গীভূত করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সেটা ছিলো ‘বিপ্লবের বীজগণিত’। হেগেলকে ছাড়িয়ে, ফয়েরবাখকে(৯) অনুসরণ করে তিনি পৌঁছেছিলেন বস্তুবাদে। তাঁর ‘প্রকৃতি অধ্যয়ন বিষয়ে পত্রগুচ্ছের’ মধ্যে ১৮৪৪ সালে লেখা প্রথম পত্রে — ‘প্রয়োগবাদ [এম্পিরিসিজম] এবং ভাববাদ’এ – আমাদের সামনে যে-চিন্তাবীর এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি এখনও ভিড়-করা আধুনিক প্রয়োগবাদী প্রকৃতি-বিজ্ঞানীদের চেয়ে এবং এখনকার দিনের ভাববাদী আর আধা-ভাববাদী দার্শনিক জনতার চেয়ে স্পষ্টতই শ্রেষ্ঠ। গের্তসেন এসেছিলেন একেবারে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অবধি, আর থেমে গিয়েছিলেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সামনে।

১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পরাজয়ের পরে গের্তসেনের আধ্যাত্মিক ভরাডুবি ঘটেছিল এই ‘থামার’ই দরুন। গের্তসেন রাশিয়া থেকে চলে গিয়েছিলেন, এই বিপ্লব তিনি লক্ষ্য করেছিলেন কাছের পাল্লা থেকে। ঐ সময়ে তিনি ছিলেন গণতন্ত্রী, বিপ্লবী, সমাজতন্ত্রী। তবে, ১৮৪৮-এর কালপর্যায়ের যে-অসংখ্য রূপ আর ধরনের বুর্জোয়া আর পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের উপর মারণ-আঘাত পড়েছিল ঐ বছর জুন মাসের দিনগুলিতে, তারই একটা ছিল তাঁর ‘সমাজতন্ত্র’। প্রকৃতপক্ষে, সেটা আদৌ সমাজতন্ত্রই নয়, সেটা কতকগুলো ভাবালু কথা, হিতৈষী সুখস্বপ্ন, যা ছিল তখনকার দিনে বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের, এবং যে-প্রলেতারিয়েত তখনও ঐসব গণতন্ত্রীর প্রভাব কাটিয়ে ওঠে নি তাদেরও, বৈপ্লবিক প্রকৃতির অভিব্যক্তি।

১৮৪৮ সালের পরে গের্তসেনের আধ্যাত্মিক ভরাডুবি, তাঁর প্রগাঢ় সন্দেহবাদ আর দুঃখবাদ হলো সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে বুর্জোয়া বিভ্রান্তিগুলোর ভরাডুবি। পৃথিবীর ইতিহাসের যে-যুগে বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের বৈপ্লবিক প্রকৃতি ইতিমধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছিল (ইউরোপে), আর তখনও সুপরিণত হয়ে ওঠে নি সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারিয়েতের বৈপ্লবিক প্রকৃতি, তারই একটা উৎপাদ এবং প্রতিবিম্ব হলো গের্তসেনের আধ্যাত্মিক নাটক। উদারপন্থী বাগাড়ম্বরে রুশী নাইটেরা এখন গের্তসেনের সন্দেহবাদ সম্বন্ধে ঝকমকে বুলিগুলো দিয়ে নিজেদের প্রতিবৈপ্লবিক প্রকৃতিটাকে ঢাকা দিচ্ছে – তারা ঐ জিনিসটা বোঝে নি, বুঝতে পারতও না। এইসব নাইট ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের প্রতি বেইমানি করেছিল, এরা বিপ্লবী এই মহান নামটার কথা ভাবতেও ভুলে গেছে, এদের কাছে সন্দেহবাদ হলো গণতন্ত্র থেকে উদারপন্থায় একরকমের উত্তরণ, এটা হলো সেই মোসাহেবি, সেই হীন জঘন্য পাশব উদারপন্থা, যা শ্রমিকদের গুলি করে মেরেছে ১৮৪৮ সালে, পুনঃস্থাপন করেছে কত চূর্ণবিচূর্ণ সিংহাসন, আর বাহবা দিয়েছে ৩য় নেপোলিয়নকে[১০], সেটার শ্রেণি-চরিত্র বুঝতে অপারগ গের্তসেন যে-উদারপন্থাকে দিয়েছেন অভিশাপ।

গের্তসেনের পক্ষে সন্দেহবাদ হলো ‘শ্রেণি-উর্ধ্বস্থ’ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিভ্রান্তি থেকে প্রলেতারিয়েতের ভয়ানক নির্মম অপরাজেয় শ্রেণিসংগ্রামে উত্তরণ। তার প্রমাণ হলো, গের্তসেনের মৃত্যুর এক বছর আগে, ১৮৬৯ সালে তাঁর লেখা ‘এক পুরনো সাথীর সমীপে পত্রগুচ্ছ’ – পত্রগুলি লেখা বাকুনিনের কাছে। এইসব পত্রে গের্তসেন নৈরাজ্যবাদী বাকুনিনের[১১] সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। নিজ শ্রেণির জয় সম্বন্ধে দৃঢ়বিশ্বাসী প্রলেতারিয়ানের বিশ্ববীক্ষা এবং নিজ উদ্ধারলাভ সম্বন্ধে হতাশ-হয়ে-পড়া পেটিবুর্জোয়ার বিশ্ববীক্ষার মধ্যেকার বিস্তীর্ণ ব্যবধান হিসেবে নয়, গের্তসেন তখনও এই বিচ্ছেদটাকে দেখেছেন নিছক কর্মকৌশল নিয়ে মতদ্বৈধ হিসেবে, তা ঠিক। ‘সমানভাবে মেহনতী আর মনিব, খামারী আর শহরবাসীর উদ্দেশে নীতি-উপদেশ’ সমাজতন্ত্রের প্রচার করা চাই, এই মর্মে পুরনো বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক কথাগুলিকে গের্তসেন এইসব পত্রেও পুনরাবৃত্ত করেছেন, তা ঠিক বটে। তা সত্ত্বেও, বাকুনিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ভিতর দিয়ে গের্তসেন দৃষ্টিপাত করেছেন উদারপন্থার দিকে নয়, আন্তর্জাতিকের দিকে, মার্কসের পরিচালিত আন্তর্জাতিকের দিকে, যে আন্তর্জাতিক প্রলেতারিয়েতের ‘বাহিনীগুলির সমাবেশ ঘটাতে’ শুরু করেছিল, ‘যারা কাজ না-করে ভোগ করে তাদের দুনিয়াটাকে পরিত্যাগ করছে’ যে-‘শ্রমিকের দুনিয়া’ সেটাকে এক করতে শুরু করেছিল যে আন্তর্জাতিক (১২)!

——–

১৮৪৮ সালের গোটা আন্দোলনের এবং সমস্ত রূপের প্রাক-মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক প্রকৃতি বুঝতে অপারগ গের্তসেন রুশ বিপ্লবের বুর্জোয়া প্রকৃতি বুঝতে পেরেছিলেন আরও কম। গের্তসেন হলেন ‘রুশী’ সমাজতন্ত্রের, নারোদবাদের প্রতিষ্ঠাতা। ভূমি সমেত কৃষকদের মুক্তি, সাধারণের জোতজমা, আর ‘ভূমিতে অধিকার’-সংক্রান্ত কৃষকের ভাব-ধারণা – এই ছিলো তাঁর দৃষ্টিতে সমাজতন্ত্র। এই বিষয়ে নিজের বড় আদরের ধ্যানধারণাগুলিকে তিনি তুলে ধরেছেন অগণিত বার।

আসলে, গের্তসেনের এই মতবাদে এবং, বাস্তবিকপক্ষে, এখনকার দিনের সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারিদের (১৩) স্তিমিত নারোদবাদ সমেত সমগ্র রুশী নারোদবাদে সমাজতন্ত্র নেই এক-কণাও। পশ্চিমে বিভিন্ন রূপের ‘১৮৪৮ সালের সমাজতন্ত্রেরমতো এটাও সেই একই রকমের ভাবালু কথা, হিতৈষী সুখস্বপ্ন, যাতে প্রকাশ পেয়েছে রাশিয়ায় বুর্জোয়া কৃষক গণতন্ত্রের বিপ্লববাদিতা। ১৮৬১ সালে কৃষকেরা যত বেশি জমি পেত, আর তার বাবদ তাদের পয়সা দিতে হত যত কম, ভূমিদাসমালিক জমিদারদের ক্ষমতা ক্ষুন্ন হত ততই বেশি, আর ততই বেশি দ্রুত, অবাধে এবং ব্যাপকভাবে রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটত। ‘ভূমিতে অধিকার’ এবং ‘জমির সমবণ্টন’-সংক্রান্ত ভাব-ধারণা কৃষকদের সমানতার জন্যে বড় সাধের বৈপ্লবিক আকাঙ্ক্ষার নির্দিষ্ট রূপ ছাড়া কিছু নয়, আর এ হলো সেই কৃষক, যারা লড়ছে জমিদারদের ক্ষমতা একেবারেই উৎখাত করার জন্যে, জমিদারিপ্রথার ষোলআনা লোপের জন্যে।

আরো পড়ুন:  আমাদের সংবাদপত্রগুলির চরিত্র

১৯০৫ সালের বিপ্লব দিয়ে এটা পুরোপুরি প্রমাণিত হয়েছিল : একদিকে, সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করে প্রলেতারিয়েত একেবারে স্বতন্ত্রভাবেই এসে দাঁড়িয়েছিল বৈপ্লবিক সংগ্রামের শীর্ষে; আর অন্যদিকে, বিপ্লবী কৃষকেরা [‘ত্রুদোভিক’রা আর ‘কৃষক সমিতি’ (১৪)], যারা ঠিক ছোট-ছোট মালিক হিসেবেই, ছোট-ছোট ব্যাপারী-কারবারি হিসেবেই লড়েছিল ‘ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা লোপ করা’ অবধি সমস্ত রকমের জমিদারিপ্রথা লোপের জন্যে।

ভূমিতে অধিকারের ‘সমাজতান্ত্রিক প্রকৃতি’, ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক আজ যথার্থ গুরুত্বসম্পন্ন এবং গুরুতর ঐতিহাসিক প্রশ্নটাকে ঝাপসা আর আড়াল করতেই সাহায্য করে শুধু – সেটা হলো, রুশ বুর্জোয়া বিপ্লবে উদারপন্থী বুর্জোয়াদের এবং বিপ্লবী কৃষককুলের স্বার্থের মধ্যেকার পার্থক্য-সংক্রান্ত প্রশ্ন; অর্থাৎ কিনা, ঐ বিপ্লবে স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে যে উদারপন্থী আর গণতান্ত্রিক ধারা, ‘আপসপন্থী’ (রাজতান্ত্রিক) আর প্রজাতান্ত্রিক ধারা, সেই সংক্রান্ত প্রশ্ন। আমরা যদি কথার বদলে বিষয়টার মর্মবস্তুর দিকে মনোযোগ দিই, আমরা যদি বিভিন্ন ‘তত্ত্ব’ আর মতবাদের ভিত্তি হিসেবে শ্রেণিসংগ্রাম নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করি — তার উলটোভাবে নয়, তাহলে দেখা যায়, গের্তসেনের ‘কলোকল’(১৫) উত্থাপন করেছিল ঠিক ঐ প্রশ্নটাই।

গের্তসেন স্বাধীন রুশ পত্র-পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিদেশে – এটা তাঁর মস্ত অবদান। ডিসেম্বরীদের ঐতিহ্যের বাহক হয়েছিল ‘পল্যানার্য়া জভেজদা’ (১৬)। সতেজে কৃষকের মুক্তির সপক্ষে দাঁড়িয়েছিল ‘কলোকল’ (১৮৫৭-১৮৬৭)। ভেঙে গিয়েছিল দাসসুলভ নিরবতা।

কিন্তু, গের্তসেন জমিদার, অভিজাত সামাজিক পরিবেশ থেকে আসা মানুষ। ১৮৪৭ সালে তিনি রাশিয়া থেকে চলে গিয়েছিলেন; বিপ্লবী জনগণকে তিনি দেখেন নি, তাদের উপর তাঁর আস্থা থাকতে পারত না। তারই থেকে এসেছিল ‘উপরতলার মানুষের প্রতি তাঁর উদারপন্থী আবেদন। তারই থেকে এসেছিল ঘাতক ২য় আলেক্সান্দরকে (১৭) উদ্দেশ করে ‘কলোকলে’ লেখা, তাঁর অসংখ্য মিষ্টিকথার চিঠি, যা আজ পড়তে গেলে বিতৃষ্ণা না-জেগে পারে না। বিপ্লবী রাজনোচিনেৎস’দের (১৮) নতুন পুরুষ-পর্যায়ের প্রতিনিধি চের্নিশেভস্কি (১৯), দব্রলিউবভ (২০) এবং সের্নোসলোভিয়েভিচ (২১) গের্তসেনকে গণতন্ত্র থেকে উদারপন্থায় এইসব বিচ্যুতির জন্যে তিরস্কার করে হাজার বার ঠিক কাজই করেছিলেন। তবে, গের্তসেনের প্রতি সুবিচার করে একথা বলতে হবে, গণতন্ত্র আর উদারপন্থার মধ্যে তিনি বিস্তর এদিক-ওদিক করলেও, তা সত্ত্বেও, তাঁর মধ্যে প্রধান হয়ে উঠেছে গণতন্ত্রীই।

উদারপন্থী হীনানুগত্যের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ব্যাখ্যাতাদের একজন, কাভেলিন (২২) একসময়ে ‘কলোকলের’ উদারপন্থী ঝোঁকের জন্যেই পত্রিকাটি সম্বন্ধে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন – তিনি যখন সংবিধানের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে বৈপ্লবিক আলোড়নের উপর আক্রমণ চালিয়েছিলেন, দাঁড়িয়েছিলেন ‘হিংসা’ আর তার জন্যে আহবানের বিরুদ্ধে এবং সহনশীলতার প্রচার শুরু করেছিলেন, গের্তসেন তখন সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন এই উদারপন্থী ঋষিব্যক্তির সঙ্গে। ‘উদারপন্থার ভান-ধরা সরকারকে বেসরকারীভাবে পথনির্দেশের জন্যে’ লেখা কাভেলিনের এই ‘অকিঞ্চিৎকর, কিম্ভুতকিমাকার, হানিকর পুস্তিকাখানার’ উপর গের্তসেন আক্রমণ চালিয়েছিলেন; কাভেলিনের যে-‘ভাবালু, রাজনীতিক উক্তিগুলো’ দেখায় ‘রুশ জনগণকে গরু-ভেড়ার মতো, আর সরকারকে জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক হিসেবে’, সেগুলোকে তিনি ধিক্কার দিয়েছিলেন। ‘কলোকলে’ প্রকাশিত ‘এপিটাফ’-শীর্ষক প্রবন্ধে কষাঘাত করা হয়েছিল সেইসব ‘প্রফেসরদের, যাঁরা নিজেদের উন্নাসিক তুচ্ছ ভাব-ধারণা দিয়ে বুনছেন পচা মাকড়সার জাল, – একদা দিলখোলা, কিন্তু সুস্থ নওজোয়ান তাঁদের অসুস্থ চিন্তনের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারে না সেটা লক্ষ্য ক’রে পরে তিক্তবিরক্ত প্রাক্তন প্রফেসরেরা’, তাদের উপর (২৩)। প্রতিকৃতিখানা নিজেরই বলে কাভেলিন চিনতে পেরেছিলেন সঙ্গে সঙ্গেই।

চের্নিশেভস্কি গ্রেপ্তার হলে এই ইতর উদারপন্থী কাভেলিন লিখেছিলেন: ‘এইসব গ্রেপ্তারে আমি তো ভয়ানক কিছু দেখি নে… বৈপ্লবিক পার্টি মনে করে, সরকার উচ্ছেদের জন্যে সমস্ত উপায়ই ন্যায্য, আর নিজস্ব উপায়াদি দিয়ে সরকার আত্মরক্ষা করে।’ যেন এই কাদেতের মুখের মতো জবাব দেবার জন্যেই গের্তসেন চের্নিশেভস্কির মামলা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন: ‘আর এই রয়েছে সব জঘন্য আগাছা-গোছের দুর্বলচিত্ত লোক, যারা বলে, রাহাজান আর পাজি-বদমাশদের যে-দঙ্গল আমাদের উপর শাসন চালাচ্ছে, সেটার উপর দোষারোপ করা চলবে না’ (২৪)।

উদারপন্থী তুর্গেনেভ[২৫] যখন নিজ রাজভক্তির কথা নিশ্চিতভাবে জানিয়ে ২য় আলেক্সান্দরের কাছে ব্যক্তিগত চিঠি লিখেছিলেন এবং পোলীয় অভ্যুত্থান দমনের সময়ে আহত সৈনিকদের জন্যে দুটো স্বর্ণমুদ্রা চাঁদা দিয়েছিলেন, তখন ‘কলোকল’ লিখেছিল সেই ‘পলিতকেশ (পুংলিঙ্গের) অনুতাপী বারাঙ্গনা’ (২৬) সম্বন্ধে ‘যে জারের কাছে লিখে জানিয়েছিল যে, সে ঘুম জানে না, কেননা সে যে কী অনুতাপে অভিভূত হয়ে পড়েছে সে-সম্বন্ধে জার অবগত নন এই চিন্তা তাকে নিদারণ যন্ত্রণা দিচ্ছিল’ (২৭)। সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে চিনতে পেরেছিলেন তুর্গেনেভ।

গের্তসেন পোল্যান্ডের সপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বলে রুশী উদারপন্থীদের গোটা দঙ্গলটা হুড়মুড় করে তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে গেলে এবং গোটা ‘শিক্ষিত সমাজ’ ‘কলোকলের’ দিকে পিছন ফেরালে গের্তসেন ঘাবড়ে যান নি। তিনি পোল্যান্ডের স্বাধীনতার সপক্ষতা করেই চলেছিলেন, আর ২য় আলেক্সান্দরের নোকর, দমনকারী, নৃশংস খুনে আর জল্লাদদের উপর কষাঘাত চালিয়ে গিয়েছিলেন। রুশী গণতন্ত্রের সম্মান রক্ষা করেছিলেন গের্তসেন। তুর্গেনেভের কাছে তিনি লিখেছিলেন, ‘রুশী নামের সম্মান আমরা বাঁচিয়েছি, আর সেটা করার জন্যে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হকুম-বরদারদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছি’ (২৮)।

এক জমিদার একজন ভূমিদাস কৃষকের বাগদত্তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে ঐ কৃষক জমিদারটাকে খুন করেছিল, সেই সংবাদ সম্বন্ধে মন্তব্য প্রসঙ্গে গের্তসেন ‘কলোকলে’ বলেছিলেন, ‘শাবাশ’! ‘মুক্তির’ ‘শান্তিপূর্ণ’ অগ্রগতির তদারকির জন্যে ফৌজী অফিসারদের নিয়োগ করা হবে বলে খবর বেরলে গের্তসেন লিখেছিলেন: ‘প্রথম যে-কর্নেল তার ইউনিট নিয়ে কৃষকদের দমন না করে তাদের সঙ্গে যোগ দেবে, সে রমানভ বংশের সিংহাসনে আরোহণ করবে। ওয়ারস’য় কর্নেল রেইটের্ন জল্লাদদের সাহায্যকারী হতে না-চেয়ে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করলে (১৮৬০) গের্তসেন লিখেছিলেন: ‘গুলিই যদি চালাতে হয়, তাহলে যেসব জেনারেল নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালাবার হকুম দেয়, তাদেরই গুলি করা উচিত।’ বেজদনা’য় পঞ্চাশ জন কৃষককে পাইকারীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, আর তাদের নেতা আন্তন পেত্রোভকে দণ্ডের নামে বধ করা হয়েছিল (১২ এপ্রিল, ১৮৬১), তখন গের্তসেন ‘কলোকলে’ লিখেছিলেন:

‘রাশিয়া ভূমির মেহনতী আর নিপীড়িত মানুষ – হায়, আমার কথাগুলো যদি শুধু, পৌছতে পারত তোমার কাছে!.. তোমার উপর সেন্ট পিটার্সবুর্গের সিনদ আর জার্মান জারের চাপানো আধ্যাত্মিক ধর্মযাজকদের ঘৃণার চোখে দেখতে কী খাসাই না আমি শেখাতে পারতাম তোমাকে… তুমি জমিদারকে ঘৃণা করো, ঘৃণা করো আমলাদের, তুমি তাদের ভয় করো — সেটা করাই ঠিক; কিন্তু জার আর বিশপকে তুমি এখনও বিশ্বাস করো… বিশ্বাস করো না তাদের। জার তাদের সঙ্গে, তারা তার লোক। এখন তাকেই দেখছ তুমি… তুমি, বেজদনা’য় খুন করা নওজোয়ানের বাপ, আর তুমি, পেনজায় খুন-করা এক বাপের ছেলে… তোমার ধর্মযাজকেরা তোমারই মতো অজ্ঞ, আর গরিব তোমারই মতো… এমনই ছিলেন আর-এক অ্যান্টনি (বিশপ অ্যান্টনি নয় – বেজদনার আন্তন), যিনি তোমার জন্যে দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করেছেন কাজানে… তোমার শহিদদের মৃতদেহ আটচল্লিশটা অবাককাণ্ড ঘটাবে না, তাঁদের উদ্দেশে প্রার্থনা করলে দাঁতের যন্ত্রণাও সারবে না; কিন্তু তাঁদের স্মৃতি হয়ত ঘটাতে পারে একটা অবাককাণ্ড — তোমার মুক্তি’ (৩১)।

এর থেকে দেখা যায় কী ইতরভাবে, কী জঘন্যভাবে গের্তসেনের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে হকুম-বরদার ‘বৈধ’ পত্র-পত্রিকাজগতের মধ্যে সুরক্ষিত আমাদের উদারপন্থীরা, যারা বাড়িয়ে ধরে গের্তসেনের দুর্বলতাগুলোকে, আর তাঁর উৎকর্ষগুলি সম্বন্ধে বলে না কিছুই। গের্তসেন উনিশ শতকের পঞ্চম দশকে খাস রাশিয়ায় বিপ্লবী জনগণকে দেখতে পান নি, এটা তাঁর দোষ নয়, এটা তাঁর দুর্ভাগ্য। বিপ্লবী জনগণকে তিনি যখন দেখতে পেয়েছিলেন সপ্তম দশকে, তখন তিনি নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়েছিলেন বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের পক্ষে, উদারপন্থার বিরুদ্ধে। উদারপন্থী বুর্জোয়া আর জমিদারদের জারের মধ্যে আপসরফার জন্যে নয়, তিনি লড়েছিলেন জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের বিজয়ের জন্যে। তিনি উচু করে তুলে ধরেছিলেন বিপ্লবের পতাকা।

আরো পড়ুন:  গোর্কির বহিষ্কার সম্বন্ধে বুর্জোয়া পত্র-পত্রিকার গালগল্প

——-

গের্তসেনের স্মৃতি উদযাপনের সময়ে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি রুশ বিপ্লবে সক্রিয় তিনটে পুরুষ-পর্যায়কে, তিনটে শ্রেণিকে। প্রথমে – অভিজাতেরা আর জমিদারেরা, ডিসেম্বরীরা আর গের্তসেন। এইসব বিপ্লবীদের নিয়ে ছিলো একটা সংকীর্ণ গ্রুপমাত্র। তাঁরা ছিলেন জনগণ থেকে বহু দুরে। কিন্তু, তাঁদের প্রচেষ্টা বৃথা যায় নি। ডিসেম্বরীরা জাগিয়ে তুলেছিলেন গের্তসেনকে। গের্তসেন শুরু করেছিলেন বৈপ্লবিক আলোড়নের কাজ।

চের্নিশেভস্কি থেকে ‘নারোদনায়া ভলিয়ার’ বীর-নায়কেরা অবধি বিপ্লবী রাজনোচিনেৎস’রা এই কাজটার ধারক হয়ে একে সম্প্রসারিত,  আরও শক্তিশালী এবং পোড়-খাইয়ে মজবুত করে তুলেছিলেন। সংগ্রামীদের পরিধি হয়েছিলো আরও বিস্তৃত, ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল তাঁদের জনসংযোগ। ‘ঘনায়মান ঝঞ্ঝার নবীন কর্ণধার’ বলেই তাঁদের অভিহিত করেছিলেন গের্তসেন। কিন্তু, তখনও এ নয় সেই আসল ঝঞ্চা।

ঐ ঝঞ্ঝা হলো জনগণের নিজেদেরই আন্দোলন। জনগণের শীর্ষে এসে দাঁড়িয়েছিলো এবং বহু, লক্ষ-লক্ষ কৃষককে সেই প্রথম প্রকাশ্য বৈপ্লবিক সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল একমাত্র পুরোদস্তুর বিপ্লবী শ্রেণি – প্রলেতারিয়েত। এই ঝঞ্ঝার প্রথম দাপট ঘটেছিল ১৯০৫ সালে। আর তার পরেরটা গড়ে-বেড়ে উঠছে আমাদের চোখের সামনেই।

গের্তসেনের স্মৃতি উদযাপন করতে এসে প্রলেতারিয়েত বৈপ্লবিক তত্ত্বের মহাগুরুত্ব যথোপযুক্তভাবে উপলব্ধি করতে শিখছে তাঁর দৃষ্টান্ত থেকে; – প্রলেতারিয়েত এটা শিখছে যে, বীজবোনা থেকে ফসলতোলা অবধি সময়ের মধ্যে দশক-দশক ব্যবধান থাকলেও, বিপ্লবের প্রতি নিঃস্বার্থ নিষ্ঠা এবং জনগণের মধ্যে বৈপ্লবিক প্রচার বৃথা যায় না; –রুশ বিপ্লবে এবং আন্তর্জাতিক বিপ্লবে বিভিন্ন শ্রেণির ভূমিকা নিরূপণ করতে শিখছে প্রলেতারিয়েত। এইসব শিক্ষায় সমৃদ্ধ প্রলেতারিয়েত লড়াই দিয়ে পথ করে এগিয়ে স্বাধীন মৈত্রী স্থাপন করবে সমস্ত দেশের সমাজতন্ত্রী শ্রমিকদের সঙ্গে, তারা চূর্ণবিচূর্ণ করবে ঘৃণ্য দানব জারের রাজতন্ত্রকে, যার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথমে গের্তসেন জনগণের উদ্দেশে তাঁর প্রতিবন্ধহীন রুশী বাণী প্রচার করে তুলে ধরেছিলেন সংগ্রামের মহান পতাকা।

২৬ নং ‘সোৎসিয়াল-দেমোক্রাৎ’, ৮ মে (২৫ এপ্রিল), ১৯১২[৩২]

টিকা:

১. গের্তসেন, আলেক্সান্দর ইভানভিচ (১৮১২-১৮৭০) – রুশ বিপ্লবী-গণতন্ত্রী, বস্তুবাদী দার্শনিক, প্রাবন্ধিক ও লেখক।
২. বিরোন, আর্নস্ট ইওহান (১৬৯০-১৭৭২) – রুশ সম্রাজ্ঞী আন্না ইওয়ানোভনা’র একজন প্রিয়পাত্র। বস্তুত ইনিই ছিলেন রাষ্ট্রের শাসক, দেশে চালু রাখেন সীমাহীন সন্ত্রাসের কর্মনীতি।
৩. আরাকচেয়েভ, আলেক্সেই আন্দ্রেয়েভিচ (১৭৬৯ – ১৮৩৪) – সম্রাট ১ম পাভেল ও সম্রাট ১ম আলেক্সান্দরের আমলে সুবিধাভোগী, প্রিয়পাত্র। ইনি দেশে চালু করেন পুলিশের প্রতিক্রিয়াশীল স্বেচ্ছাচারী শাসন।
৪.মানিলােভ – রুশ লেখক ন. ভ. গােগলের ‘মৃত আত্মা’ গ্রন্থের এক চরিত্র। তাতে ফুটিয়ে তােলা হয় মধুর কল্পনায় দিন-যাপনকারী রাশিয়ার কূপমণ্ডক জমিদার সম্প্রদায়ের শূন্য অন্তর্জগত।
৫. ১৪ই ডিসেম্বরের মানুষগুলি (ডিসেম্বরী’রা) – ১৮২৫ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরতন্ত্র ও ভূমিদাসপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অবতীর্ণ রুশ অভিজাত শ্রেণীর বিপ্লবীরা।
(৬) রোমুলাস আর রেমুস – উপকথায় আছে যে, এরা নাকি নেকড়ের দুধ খেয়ে বাঁচে ও রাখালের বউয়ের হাতে মানুষ হয়। উপকথা অনুসারে রােমুলাস রােম নগরীর গৌরবান্বিত প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম রােমক সম্রাট।
(৭) ভ. ই. লেনিন আ, ই, গের্তসেনের ‘শেষ ও শুরু’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধতি দিয়েছেন।(৮) হেগেল, গেওর্গ ফ্রিদরিখ ভিলহেল্ম (১৭৭০ – ১৮৩১) – শ্রেষ্ঠতম জার্মান ভাববাদী দার্শনিক, ভাববাদী বুনিয়াদের উপর দ্বান্দ্বিক বিকাশের তত্ত্ব গড়ে তোলেন। (৯) ফয়েরবাখ, ল্যুডভিগ (১৮০৪ – ১৮৭২) – প্রাক-মার্কসীয় যুগের শ্রেষ্ঠতম জার্মান বস্তুবাদী দার্শনিক।(১০) নেপোলিয়ন ৩য় (লুই বোনাপার্ট) – (১৮০৮-১৮৭০) – ফ্রান্সের ১৮৫২ থেকে ১৮৭০ সময়কালের সম্রাট।[১১] বাকুনিন, ম. আ. (১৮১৪ – ১৮৭৬) নারোদবাদ ও নৈরাজ্যবাদের একজন মতপ্রবক্তা; যে কোনো প্রকারের রাষ্ট্র গঠনের বিরোধী এই লোকটি প্রলেতারীয় একনায়কত্বও অস্বীকার করেন। প্রলেতারিয়েতের বিশ্ব ঐতিহাসিক ভূমিকার তাৎপর্য তিনি বোঝেননি, শ্রমিক শ্রেণির স্বাধীন রাজনৈতিক পার্টি গঠনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিরোধীতায় লিপ্ত হন।
(১২) আ. ই. গের্তসেন – ‘এক পুরনো সাথীর সমীপে’ (চতুর্থ ও দ্বিতীয় পত্র)।
(১৩) সােশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারি (এস-আর’রা) – রাশিয়ায় একটি পেটিবুর্জোয়া পার্টি; বিভিন্ন নারােদনিক গ্রুপ ও চক্রের সম্মিলনে এ পাটি গড়ে ওঠে ১৯০১ সালের শেষে ও ১৯০২ সালের গােড়ায়। প্রলেতারিয়েত ও ক্ষুদে মালিকদের মধ্যে শ্রেণি-পার্থক্য দেখতে পেত না সােশ্যালিস্ট রেভলিউশনারিরা, কৃষক সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে শ্রেণিগত স্তরভেদ ও বিরােধ ধামাচাপা দিত, বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতের নেতৃভূমিকা অস্বীকার করত। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের পর সােশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারিরা মেনশেভিক ও কাদেত সহযােগে হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়া-জমিদার অস্থায়ী সরকারের প্রধান স্তম্ভ, আর পার্টির নেতারা (কেরেনস্কি, চেনোভ প্রভৃতি) এ সরকারে প্রবেশ করেন। সােশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারিদের পার্টি জমিদারী ভূমিসম্পত্তি বিলােপের জন্যে কৃষকদের দাবি সমর্থন করতে অস্বীকার করে, জমিতে জমিদারদের মালিকানা বজায়ের পক্ষে কথা বলে।
বৈদেশিক সামরিক হস্তক্ষেপ ও গৃহযুদ্ধের সময় সােশ্যালিস্ট রেভলিউশনারিরা প্রতিবিপ্লবী অন্তর্ঘাতী ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যায়। গৃহযুদ্ধ সমাপ্তির পর এরা দেশের অভ্যন্তরে এবং শ্বেতরক্ষী দেশান্তরীদের মধ্যে থেকে শত্রুতামূলক কাজকর্মে লিপ্ত থাকে।
(১৪) সারা-রাশিয়া কৃষক সমিতি – বিপ্লবী-গণতান্ত্রিক সংগঠন, গঠিত হয় ১৯০৫ সালে। কৃষক সমিতি দাবি করে রাজনীতিক স্বাধীনতা, অবিলম্বে বিধানসভার আহ্বান, জমিতে ব্যক্তিমালিকানার বিলােপ, মঠ, জার-প্রদত্ত, জার-বংশীয় ও রাষ্ট্রীয় ভূমির বাজেয়াপ্তি ও তা কৃষকদের মধ্যে বণ্টন। এসব দাবি বাস্তবায়নে কৃষক সমিতির অটলতা ও নিশ্চয়তার অভাব দেখা যায়। কৃষক সমিতির উপর পুলিসের হামলা বাড়তে থাকে ও ১৯০৭ সালের শুরুতে তা ভেঙ্গে যায়।
(১৫) ‘কলােকল’ (‘ঘণ্টা’) — রাজনীতিক পত্রিকা; তার স্লোগান ছিল – ‘জীবিতদের ডাকছি।’ (Vivos Voco!’), প্রকাশ করেন আ, ই, গের্তসেন ও ন, প, ওগারিওভ। ১৮৫৭ থেকে ১৮৬৫ সালের মে পর্যন্ত পত্রিকাটি বেরােয় লণ্ডনে এবং ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৭ সালের অগস্ট পর্যন্ত বেরােয় জেনেভায় মাসে একবার কিংবা দু’বার করে। ১৮৬৮ সালে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ফরাসী ভাষায়; একই সঙ্গে রুশ ভাষায় পরিশিষ্ট ছাপা হয়। স্বৈরতন্ত্রের অত্যাচার, রাজকর্মচারীদের দ্বারা তহবিল চুরি, জমিদার কর্তৃক কৃষকের নির্মম শােষণের নিন্দা ক’রে ‘কলােকল’ জনগণকে বৈপ্লবিক আহ্বান জানায় এবং জার সরকার ও শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাহায্য করে।
(১৬) ‘পল্যার্নায়া জভেজদা’ (ধ্রুবতারা’) – সাহিত্যিক ও রাজনীতিক প্রবন্ধ সংকলন; প্রথম তিনখানা সংকলন প্রকাশ করেন আ. ই. গের্তসেন, পরেরগুলাে – আ. ই. গের্তসেন ও ন, প, ওগারিওভ লণ্ডনে ১৮৫৫ – ১৮৬২ সালে। শেষ বইটি বেরােয় জেনেভায় ১৮৬৮ সালে। মােট আটখানা বই বেরােয়।
(১৭) আলেক্সান্দর, ২য় রমানভ (১৮১৮ – ১৮৮১) ১৮৫৫ থেকে ১৮৮১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন রুশ সম্রাট।
(১৮) রাজনােচিনেৎস’রা – রুশ সমাজের যে-শিক্ষিত ব্যক্তিরা অভিজাতকুলােদ্ভব নয়। এরা আসেন নিম্ন মধ্যবিত্ত, যাজক, বেনিয়া ও কৃষকদের মধ্য থেকে।
[১৯] চের্নিশেভস্কি, নিকোলাই গাভ্রিলভিচ (১৮২৮ – ১৮৮৯) – রুশ বিপ্লবী-গণতন্ত্রী ও কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী, পণ্ডিত, লেখক, সাহিত্য সমালোচক, রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাসির অন্যতম বিখ্যাত অগ্রদূত।
[২০] দব্রলিউবভ, নিকোলাই আলেক্সান্দ্রভিচ (১৮৩৬ – ১৮৬১) রুশ বিপ্লবী-গণতন্ত্রী, খ্যাতনামা সাহিত্য সমালোচক ও বস্তুবাদী দার্শনিক।
[২১] সের্নো-সলোভিয়েভিচ, আলেক্সান্দর আলেক্সান্দ্রোভিচ (১৮৩৮-১৮৬৯) উনিশ শতকের সপ্তম দশকের বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক-আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট কর্মী। ১৮৬২ সালে বিদেশে চলে যান। তাঁর লেখা পারিবারিক ব্যাপার-স্যাপার প্রবন্ধে তিনি গের্তসেনের উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র নিন্দা করেন।
[২২] [কাভেলিন, ক. দ. (১৮১৮ – ১৮৮৫) – ইতিহাসবিদ ও আইনজীবী, মস্কো এবং পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অভিজাত-বুর্জোয়া উদারনীতিপন্থার প্রতিনিধি ছিলেন।
(২৩) প্রবন্ধটি লেখেন ন, প, ওগারিও।
(২৪) ভ. ই. লেনিন আ. ই. গেৎসেনের ‘ন, গ. চের্নিশেভস্কি প্রবন্ধ থেকে উদ্ধত করছেন।
[২৫] তুর্গেনেভ, ইভান সের্গেয়েভিচ (১৮১৮-১৮৮৩) – রুশ লেখক। রুশ সাহিত্যিক ভাষার উন্নতির জন্যে তিনি অনেক কিছুই করেছেন। ভূমিদাসপ্রথার বিরুদ্ধে তুর্গেনেভের প্রতিবাদ ছিলো সোচ্চার, তবে তাঁর দাবি ছিলো নরম উদারনীতিক চরিত্রের।
(২৬) অনুতাপী বারাঙ্গনা – মেরি মাগদালেনা (মাগদালা শহর থেকে) – খ্রিস্টীয় সুসমাচার গ্রন্থের উপাখ্যান অনুসারে এক পাতকিনী, যিশু খ্রিস্ট তাকে আরােগ্য করেন। এর পর সে তার ব্যভিচারের জন্যে অনুশােচনা করে ও যিশুর অন্যতম বিশ্বস্ত শিষ্যা হয়।
(২৭) ভ. ই. লেনিন আ, ই, গেৎসেনের পরনিন্দা, ভুসা, ঝুলকালি, ইত্যাদি নামক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধতিটি দিয়েছেন।
(২৮) ই. স. তুর্গেনেভের কাছে আ, ই, গেৎসেনের ১৮৬৪ সালের ১০ এপ্রিলের চিঠি থেকে। [২৯] রেইটের্ন (মৃত্যু ১৮৬১) – জার সৈন্যবাহিনীর কর্নেল। ওয়ারস’র এক মিছিলে গুলি ছোঁড়ার আদেশ অমান্য করে আত্মহত্যা করেন।[৩০] পেত্রোভ, আ. (সিদরভ, আ. প.) (১৮২৪-১৮৬১) – বেজদনা গ্রামের ভূমিদাস কৃষক, ১৮৬১ সালের ‘কৃষক সংস্কারের’ বিরুদ্ধে বেজদনা গ্রামের কৃষকদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
(৩১) ভ. ই. লেনিন আ, ই, গের্তসেনের ‘সেকেলে বিশপ, মান্ধাতার আমলের সরকার ও প্রতারিত জনগণ’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতিটি দিয়েছেন।
৩২. লেখক অনুপ সাদি সম্পাদিত ভি. আই. লেনিনের প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য প্রসঙ্গে, টাঙ্গন ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ৪৯-৫৮ থেকে এই লেখাটি রোদ্দুরে ডট কমে সংকলন করা হয়েছে।

আরো পড়ুন:  পাটি সংগঠন ও পার্টি সাহিত্য

Leave a Comment

error: Content is protected !!