ভূমি থেকে কৃষিজীবী জনগণের উচ্ছেদ

“১৮শ শতক অবশ্য জাতীয় ঐশ্বর্য ও জনগণের দারিদ্র্যের মধ্যে অভিন্নতাটা ১৯শ শতকের মতো দেখতে পায় নি।’— কার্ল মার্কস

১৮শ শতক অবশ্য জাতীয় ঐশ্বর্য ও জনগণের দারিদ্র্যের মধ্যে অভিন্নতাটা ১৯শ শতকের মতো অতো পরিপূর্ণভাবে তখনো দেখতে পায় নি। সেইজন্যই তখনকার অর্থনৈতিক সাহিত্যে ‘সর্বজনীন ভূমির ঘেরাও-দখল’ নিয়ে অতি প্রচন্ড বিতর্ক দেখা যায়। আমার সামনে যে পুঞ্জীভূত মালমসলা আছে, তা থেকে আমি কয়েকটি উদ্ধতি দেব, তাতে সে সময়কার অবস্থার ওপর জোরালো আলোকপাত হবে। ক্রুদ্ধ এক ব্যক্তি লিখছেন: ‘হার্টফোর্ডশায়ারের কতকগুলি প্যারিশে গড়ে ৫o—১৫o একরের ২৪টি খামার বিগলিত হয়ে গেছে তিনটি খামারে।’[২৩] ‘নর্দাম্পটনশায়ার ও লিসেস্টারশায়ারে সর্বজনীন জমির ঘেরাও-দখল ঘটেছে অতি বিপুলাকারে এবং ঘেরাও-দখলের ফলে গঠিত অধিকাংশ নতুন মহাল পরিণত করা হয়েছে চারণভূমিতে, তার ফলে অনেক মহালে বছরে এখন ৫o একরও চাষ হয় না, যেখানে আগে চাষ হত ১,৫oo একর। প্রাক্তন বাসগৃহ, গোলা, আস্তাবল ইত্যাদির ধবংসাবশেষই’ হলো ভূতপূর্ব অধিবাসীদের একমাত্র চিহ্ন। ‘কোনো কোনো অদখল গ্রামের শতখানেক গৃহ ও পরিবার কমে এসেছে… আট কি দশে… মাত্র ১৫ কি ২০ বছর আগে যে সব প্যারিশ ঘেরাও-দখল করা হয় তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে অদখল অবস্থায় যত লোক সেখানে ভূম্যধিকারী ছিলো তাদের তুলনায় ভূম্যধিকারীর সংখ্যা এখন অত্যন্ত কম। আগে যা ছিল ২০ কি ৩০ জন খামারী ও সমান সংখ্যক ক্ষদ্রতর মালিক ও প্রজাদের হাতে, এমন একটা বিশাল ঘেরাও-দখলী মহালকে ৪ কি ৫ জন ধনী মেষ-ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে একচেটিয়া করে নেওয়া মোটেই অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তাতে ক’রে অন্য যে সমস্ত পরিবারকে তারা নিয়োগ ও প্রতিপালন করত তাদের সঙ্গে এই সমস্ত লোক একত্রে সপরিবারে তাদের জীবিকা থেকে উৎখাত হচ্ছে।’[২৪] শুধু পতিত জমি নয়, যৌথভাবে চাষ করা জমি অথবা গোষ্ঠীর নিকট নির্দিষ্ট খাজনা দিয়ে ভোগ করা জমিও আশেপাশের ভূস্বামীরা ঘেরাও-দখলের অজুহাতে গ্রাস করত। ‘আমি এখানে ইতিমধ্যেই উন্নত করে তোলা অবাধ মাঠ ও ভূমির ঘেরাও-দখলের কথা বলছি। ঘেরাও-দখলের সমর্থক লেখকেরাও স্বীকার করেন যে এই সমস্ত হ্রাস-প্রাপ্ত গ্রামগুলি খামারগুলির একচেটিয়া বাড়িয়ে দেয়, খাদ্যের দর বৃদ্ধি করে, জনসংখ্যার হ্রাস ঘটায়. এমন কি অনাবাদী জমির ঘেরাও-দখলেও (যা এখন চালানো হচ্ছে) গরিবদের উপজীবিকার একাংশ হরণ করে তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা করে এবং ইতিমধ্যেই অতি বৃহৎ হয়ে ওঠা খামারগুলিকেই কেবল বাড়িয়ে তোলে।’[২৫] ডঃ প্রাইস বলছেন, ‘এ জমি অল্প কয়েকজন বড়ো বড়ো খামারীর হাতে পড়লে ফল নিশ্চয় এই হবে যে ছোটো খামারীরা (আগে তাদের তিনি এই আখ্যা দিয়েছেন “অসংখ্য ছোটো ছোটো ভূম্যধিকারী ও ইজারাদার, যারা নিজেদের ও পরিবারবর্গকে পোষণ করে অধিকৃত ভূমিটার উৎপন্ন থেকে, সর্বজনীন জমিতে পালিত ভেড়া দিয়ে, হাঁস মুরগী শুয়োর ইত্যাদি পেলে, সতরাং জীবনধারণের উপায় কেনার প্রয়োজন যাদের সামান্যই হয়’) ‘এমন একদল লোকে পরিণত হবে, যারা জীবিকার্জন করবে অন্যের জন্য খেটে, এবং নিজেদের প্রয়োজনীয় সবকিছুর জন্য যারা বাজারে যেতে বাধ্য হবে… সম্ভবত পরিশ্রম বেশি হবে, কেননা তার জন্য বাধ্যবাধকতা থাকবে বেশি… শহর ও কারখানা-শিল্প বাড়বে, কেননা আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের জন্য অনেক বেশি লোক সেদিকে তাড়িত হবে। ঢালাওভাবে ফার্ম হস্তগত করার স্বাভাবিক ক্রিয়াটা হবে এই পথেই। এবং এইভাবেই তা-বহু, বছর ধরে এ রাজ্যে কাজ করে যাচ্ছে।’[২৬] ঘেরাও-দখলগুলির ফলাফলের খতিয়ান তিনি টেনেছেন এইভাবে: ‘মোটের ওপর নিম্ন স্তরের লোকেদের অবস্থা সব দিক দিয়েই খারাপের দিকে বদলেছে। ছোটো ভূম্যধিকারী থেকে তারা পরিণত হয়েছে দিন-মজুর ও ভাড়াটোতে; সেই সঙ্গে এই অবস্থায় থেকেও তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়ে উঠেছে আরো কঠিন।’[২৭] বস্তুত কৃষিশ্রমিকদের ওপর সর্বজনীন জমির জবরদখল ও তার সহগ কৃষি বিপ্লবের এত তীব্র প্রভাব পড়ে যে, এমন কি ইডেনের মতেই, ১৭৬৫ থেকে ১৭৮o সালের মধ্যে তাদের মজুরি ন্যূনতমের নিচে নামতে শুরু করে এবং সরকারী দরিদ্র আইনের সাহায্য দিয়ে তা পুরণ করতে হয়। তাদের মজুরি, ইডেন বলেন, ‘জীবনধারণের নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি সংগ্রহের বেশি ছিলো না’।

আরো পড়ুন:  প্রলেতারিয়েত অষ্টাদশ শতক পরবর্তীকালের শ্রমশক্তি বিক্রিকারী শ্রমিক শ্রেণি

এবার এক মুহূর্তের জন্য একজন ঘেরাও-দখলের সমর্থক ও ডঃ প্রাইসের প্রতিপক্ষের কথা শোনা যাক: ‘অদখল জমিতে শ্রম অপচয় করতে যেহেতু লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে না তাই নিশ্চয় জনহ্রাস ঘটে থাকবে, এটাও কোনো যুক্তি নয়… ছোটো খামারীদের যদি অন্যের জন্য খাটতে বাধ্য এমন একদল লোকে পরিবর্তিত করার ফলে বেশি শ্রম উৎপন্ন হয়, তাহলে সেটা এমন একটা সুবিধা যা জাতির’ (যার মধ্যে অবশ্যই ‘পরিবর্তিত’ লোকেরা পড়ে না) ‘পক্ষে বাঞ্চনীয়… তাদের যৌথ শ্রম একটি খামারে নিযুক্ত হলে উৎপাদন যেহেতু বেশি হয়, তাই কারখানা-শিল্পের জন্য উদ্বৃত্ত পাওয়া যাবে, এবং এই উপায়ে জাতির পক্ষে যা স্বর্ণখনি স্বরূপ সেই কারখানা শিল্প উৎপাদিত শস্যের সমানুপাতে বাড়তে থাকবে।’[২৮]

পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির বনিয়াদ স্থাপনের জন্য প্রয়োজন হওয়া মাত্র ‘সম্পত্তির পবিত্র অধিকারের’ নির্লজ্জ লঙ্ঘন ও লোকের প্রতি রূঢ়তম বলাৎকারের ঘটনার ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা কী নির্বিকার মানসিক প্রশান্তি পোষণ করতেন তা দেখিয়েছেন লোকহিতৈষী’ ও তদুপরি টোরি স্যার এফ. এম. ইডেন। ১৫শ শতকের শেষ তৃতীয়াংশ থেকে ১৮শ শতকের শেষ পর্যন্ত জনগণের জবরদস্তি উচ্ছেদের সঙ্গে যে চৌর্য, বলাৎকার ও জনগণের ক্লেশের একটা পুরো পালা চলেছিলো, সেটা তাঁকে মাত্র এই আরামদায়ক সিদ্ধান্তে প্রণোদিত করেছে: ‘আবাদ জমি ও চারণভূমির মধ্যে যথাযোগ্য অন্যপাত স্থাপন করতে হত। গোটা ১৪শ শতক ও ১৫শ শতকের বেশির ভাগটায় ২-৩, এমন কি ৪ একর আবাদ জমির বিপরীতে ছিল ১ একর চারণভূমি। ১৬শ শতকের মাঝামাঝি অনুপাতটা বদলে যায় ২ একর চারণভূমির বিপরীতে ২ একর আবাদ জমি, পরে ২ একর চারণভূমির বিপরীতে ১ একর আবাদ জমি, এবং শেষ পর্যন্ত ৩ একর চারণভূমির বিপরীতে ১ একর আবাদ জমির ন্যায্য অনুপাতটা প্রতিষ্ঠিত হয়।’

১৯শ শতকে কৃষিশ্রমিক ও সর্বজনীন জমির মধ্যেকার সম্পর্কের স্মৃতিটুকুও অবশ্য মুছে গেছে। আরো সাম্প্রতিক কালের কথা না বললেও, ১৮০১ থেকে ১৮৩১ সালের মধ্যে যে ৩৫,১১, ৭৭০ একর সর্বজনীন জমি কৃষিজীবী জনগণের কাছ থেকে চুরি করা হয় ও পার্লামেন্টী কৌশলে ভূস্বামীগণ কর্তৃক ভূস্বামীদের নিকট উপহার প্রদত্ত হয়, তার জন্য কি তারা একটা পয়সাও ক্ষতিপারণ পেয়েছে?

আরো পড়ুন:  ভারতে অভ্যুত্থান

তথ্যসূত্র ও টিকা

২৩. Thomas Wright, ‘A Short Address to the Public on the Monopoly of Large Farms’, 1779, pp. 2, 3.

২৪. Rev. Addington, ‘Inquiry into the Reasons for and against Enclosing Open Fields’, London, 1772, pp. 37-43, passim.

২৫. Dr. R. Price, ‘Observations on Reversionary Payments’, 6th ed. By W. Morgan. London, 1803. Vol. II., p. 155. ফর্স্টার, অ্যাডিংটন, কেন্ট, প্রাইস ও জেমস অ্যান্ডারসনকে পাঠ করে তুলনা করা উচিত চাটুকার ম্যাককুলখের ‘The Literature of Political Economy’ গ্রন্থে (London, 1845) শোচনীয় বকবকানির সঙ্গে।

২৬. Dr. R. Price, উক্ত গ্রন্থ পৃষ্ঠা ১৪৭

২৭. Dr. R. Price, উক্ত গ্রন্থ, পঃ ১৫৯। প্রাচীন রোমের কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ‘অবণ্টিত জমির অধিকাংশই ধনীরা দখল করে নিয়েছিলো। সে কালের এই পরিস্থিতিতে তারা ভরসা রেখেছিলো যে জমিগুলি আর তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে না, সতরাং নিজেদের জমির সন্নিকটস্থ গরিবদের কিছু কিছু জমি তারা কিনে নিয়েছিলো তাদের সম্মতি নিয়ে, আর কিছু জমি দখল করেছিলো জোর করে, ফলে বিচ্ছিন্ন সব জমির বদলে তারা তখন চাষ চালাচ্ছিল সম্প্রসারিত সব আবাদে। তারপর কৃষি ও পশুপালনে তারা নিয়োগ করল ক্রীতদাসদের, কেননা সামরিক কর্মে ডাক পড়লে মুক্ত প্রজারা কাজ ছেড়ে চলে যেতে পারত। ক্রীতদাস থাকায় তাদের প্রভূত লাভ হত, কেননা সামরিক সেবার দায় থেকে ক্রীতদাসরা মুক্ত থাকায় অবাধে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি ও বহু সন্তান হতে পারত। এইভাবে শক্তিমানেরা সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করে ও ক্রীতদাসে দেশ ছেয়ে যায়। অন্যদিকে ইতালীয়দের সংখ্যা অবিরাম কমছিলো, দারিদ্র্য, কর ও সামরিক সেবায় ধবংস পাচ্ছিল তারা। এমন কি শান্তির সময়েও পুরোপুরি কর্মহীনতাই ছিল তাদের নির্বন্ধ, কেননা ধনীদের অধিকারে ছিল জমি এবং তা চাষ করার জন্য তারা মুক্ত প্রজার বদলে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করত।’ (Appian, ‘Römische Bürgerkriege’, I, 7) এ অনুচ্ছেদটা লিসিনিয়াস’এর বিধানের আগেকার কাল নিয়ে। [লিসিনিয়াস’এর বিধান — প্রাচীন রোমে খ্রিঃ পূঃ ৩৬৭ সালে গৃহীত আইন। সর্বজনীন জমিকে ব্যক্তিগত ভোগে তুলে দেবার অধিকার তাতে কিছুটা সঙ্কোচিত করা হয় এবং আংশিক ঋণ নাকাচের ব্যবস্থা হয়। আইনটির লক্ষ্য ছিলো বহৎ ভূমিমালিকানার বৃদ্ধি ও অভিজাতদের বিশেষাধিকার খর্ব করা। প্লেবিয়ানদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কিছুটা সংহতিও তাতে প্রতিফলিত হয়। রোমক ঐতিহ্য অনসারে, লোকপ্ৰবক্তা লিসিনিয়াস ও সেক্সটিয়াস এই আইনের সংরচক বলে কথিত। — সম্পাদক] রোমক প্লেবিয়ানদের ধবংস যা অতি বিপুল পরিমাণে ত্বরান্বিত করেছিলো, সেই সমর-সেবাকেই প্রধান উপায় হিশেবে নিয়ে শার্লেমান [[Charlemagne]] যেন দ্রুত-পাকানো খামার ঘরের মধ্যে মুক্ত জার্মান চাষীদের ভূমিদাস ও গোলামে রপোন্তর ঘটিয়েছিলেন।

আরো পড়ুন:  আদি সঞ্চয়ের রহস্য

২৮. [J. Arbuthnot] ‘An Inquiry into the Connection between the Present Price of Provisions etc.’, pp. 124, 129. বিপরীত প্রবণতা কিন্তু সমান মর্মার্থ: ‘শ্রমজীবীরা তাদের কুটির থেকে বিতাড়িত হয়ে কাজের জন্য শহরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু তাতে একটা বৃহত্তর উদ্বৃত্ত পাওয়া যাচ্ছে ও এইভাবে পুঁজি বেড়ে উঠছে।’ (R. B. Seeley) ‘The Perils of the Nation’, 2nd ed., London, 1843, p. 14.)

Leave a Comment

error: Content is protected !!