শাহ জাহান ও মহব্বত খাঁর পরিচালিত ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতা লোভ
আহমদনগর জয় করার পুরস্কারস্বরূপ জাহাঙ্গীর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র খুররমকে শাহ জাহান (অর্থাৎ দুনিয়ার শাসনকর্তা) উপাধি দিলেন ও তাঁকে নিযুক্ত করলেন সমৃদ্ধ গুজরাট রাজ্যের শাসনকর্তা। ওই সময়ে জাহাঙ্গীর তাঁর প্রধানা মহিষী নুর জাহানের একেবারে হাতের মুঠোয় চলে গিয়েছিলেন এবং এই প্রমত্ত আফিমখোর সম্রাট তাঁর রাজ্যের শাসনভার ক্রমশ ছেড়ে দিচ্ছিলেন নুর জাহানের হাতে। নুর জাহান ছিলেন জাহাঙ্গীরের অপর এক পুত্র শাহরিয়ারের পৃষ্ঠোপোষক এবং এর ফলে শাহ জাহানের পক্ষে সিংহাসন লাভ করার পথে বিঘ্ন দেখা দিয়েছিল।
সিংহাসন হারানোর বিপদ উপস্থিত হওয়ায় শাহ জাহান গুজরাট থেকে সংগৃহীত রাজন্য ব্যয় করতে লাগলেন প্রকাণ্ড এক সেনাবাহিনী গড়ে তোলার কাজে এবং ১৬২২ খ্রীস্টাব্দে তিনি পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। কিন্তু সম্রাটের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হলেন ও গোলকোণ্ডায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। সেখান থেকে তিনি গোপনে চলে এলেন বাংলায়। এখানে তিনি বহু সেনাধাক্ষের সমর্থন লাভ করলেন। বাংলা থেকে দিল্লী যাত্রার পথে এলাহাবাদের কাছে তিনি ফের একবার পরাস্ত হলেন সম্রাটের সেনাবাহিনীর হাতে। আহমদনগরে আরেকবার সেনাবাহিনী গড়ে তুলে মোগল-বাহিনীকে বুরহানপুর থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টাতেও ব্যর্থ হলেন শাহ জাহান। অবশেষে তিনি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। জাহাঙ্গীর তাঁকে ক্ষমা করলেন বটে, তবে তাঁর হাত থেকে গুজরাটের শাসনভার ফিরিয়ে নিয়ে পরিবর্তে তাঁকে দিলেন দাক্ষিণাত্যে ছোট্ট একটি ‘জায়গির’।
যে মোগল-সেনাবাহিনী শাহ জাহানের বাহিনীকে যুদ্ধে বারবার পরাস্ত করেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন সেনাধ্যক্ষ মহব্বত খাঁ। মহব্বতের প্রধান সমর্থক ছিলেন রাজপুত সৈন্যরা। নুর জাহানের ঘনিষ্ঠ চক্র মহব্বত খাঁ’র ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেখে ভয় পেয়ে গেলেন এবং তাঁর কুৎসা-রটনায় সর্বপ্রকার ছলাকলার আশ্রয় নিতে কসুর করলেন না। মহব্বতকে দরবারে ডেকে পাঠানো হলো, সেখানে সমাদর দেখানো হলো না তাঁকে। অতঃপর মহব্বত তাঁর সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে ‘পাতশাহের’ শিবির ঘেরাও করে সম্রাটকে বন্দী করলেন। কিছুদিনের জন্যে মহব্বতই হলেন কার্যত দেশের শাসক।
মহব্বতের রাজপুত সেনাবাহিনীকে হঠাৎ প্রবল হয়ে উঠতে ও প্রাধান্য পেতে দেখে এদিকে মোগল-সেনাধ্যক্ষরা উঠলেন খেপে। শেষ পর্যন্ত মোগল ও রাজপুত সৈন্যদলের মধ্যে ছোটখাটো নানা সংঘর্ষ পরিণত হলো বড়রকমের এক যুদ্ধে এবং সেই যুদ্ধে মহব্বতের প্রধান সমর্থক দু’হাজার রাজপুত নিহত হলেন। ফলে মহব্বত বাধ্য হলেন শাহ জাহানের দরবারে আশ্রয় নিতে।
১৬২৭ খ্রীস্টাব্দে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হলো ও সিংহাসনে বসলেন শাহ জাহান। সিংহাসনের অন্যান্য দাবিদারদের বিদ্রোহ করার সম্ভাবনা নির্মূল করার উদ্দেশ্যে শাহ জাহান হকুম দিলেন তাঁর সকল নিকটতম আত্মীয়কে অবিলম্বে হত্যা করার।
শাহ জাহানের রাজত্বকাল
শাহ জাহানের দরবার আগেকার সকল সম্রাটের রাজসভাকে ঐশ্বর্যে ও জাঁকজমকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রধান-প্রধান শহরে নির্মাণ করা হয়েছিল তখন শ্বেতপাথরে-তৈরি ও অর্ধ-মূল্যবান মণিমাণিক্যে খচিত (আগ্রার বিখ্যাত তাজমহল সহ) চোখ-ধাঁধানো নানা দালান-কোঠা। এর ফলে রাজকোষ থেকে অর্থব্যয় হচ্ছিল প্রচুর। সেনাবাহিনীতে ইতিমধ্যে সৈনিকের সংখ্যা যদিও বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবু অতীতের মতো মোগল-সেনাবাহিনীর যুদ্ধের পারদর্শিতা আর ততটা ছিল না। এই সময়ে যুদ্ধাভিযান পরিচালনার কাজে দেখা যাচ্ছিল যে মোগল বাহিনীতে সৈন্যের সংখ্যার চেয়ে বহুগুণে বেশি সংখ্যায় আছে শিবিরের সহযাত্রী অন্যান্য লোক ও ভূতবর্গ। যুদ্ধক্ষেত্রেও তখন প্রচলিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল অশ্বারোহী বা পদাতিক বাহিনীর ওপর ততটা নির্ভর না-করে রণহস্তীগুলিকে শত্রু সেনাদলের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়া। এর ফলে অবস্থা দাঁড়িয়েছিল এই যে মোগল-বাহিনী তখনও পর্যন্ত কোনো-কোনো ক্ষেত্রে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে জয়লাভ করলেও, হাতির চলাচলের অসাধ্য পাহাড়ি আফগান ভূখণ্ডে শাহ জাহান কিন্তু নিশ্চিত সাফল্য অর্জনের মতো অবস্থায় ছিলেন না।
অভ্যন্তরীণ নীতি
সিংহাসনে আরোহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শাহ জাহানকে যুদ্ধে নামতে হল বিদ্রোহী সামন্ত-ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে। এক বুন্দেলা-রাজা নিজেকে স্বাধীন নৃপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন, পরে তাঁকে নতিস্বীকার করতে হলো শাহ জাহানের কাছে। অতঃপর জাহাঙ্গীরের এক প্রিয়পাত্র খাঁ জাহানও বিদ্রোহ করলেন সম্রাটের বিরুদ্ধে এবং গিয়ে যোগ দিলেন আহমদনগর-রাজ্যের সঙ্গে। কিন্তু মোগল-বাহিনী আহমদনগরের সেনাবাহিনীকে পর্দস্ত করল এবং খাঁ জাহান পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন বুন্দেলখণ্ডে। সেখানে বুন্দেলা-রাজা ‘পাতশাহে’র অনুগ্রহলাভের আশায় খাঁ জাহানকে হত্যা করলেন।
দাক্ষিণাত্যের নানা যুদ্ধ এবং শূন্য রাজকোষ পূরণের জন্যে বর্ধিত হারে ভূমি-রাজস্ব আদায় করার ফলে গুজরাট, দাক্ষিণাত্য এবং গোলকোল্ডার অংশবিশেষে সংঘাতিক এক দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। যুদ্ধবিধস্ত দাক্ষিণাত্যে সবচেয়ে বেশি করে এই দুর্ভিক্ষের শিকার হলেন গ্রামের জনসাধারণ আর গুজরাটে এর বলি হলেন শহরগুলির মানুষ। ইতিবত্তসমূহের বিবরণ অনুযায়ী এই দুর্ভিক্ষের ফলে গুজরাটে অসংখ্য কারু শিল্পী সহ মারা যান প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ। এই অঞ্চলে এত বেশি সংখ্যায় কারুশিল্পী মারা যাওয়ায় ও তার ফলে কারিগরি শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ রীতিমতো হ্রাস পাওয়ায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অতঃপর করমণ্ডলের সমুদ্রোপকূলে কয়েকটি বাণিজ্য-কুঠি নির্মাণ করতে মনস্থ করেন। তাঁরা ওই উপকূলে জমি-জায়গা কেনেন এবং সেখানেই পরে গড়ে ওঠে মাদ্রাজ বন্দর।
অতঃপর একমাত্র জাহাজনির্মাণ-শিল্পই টিকে থাকে ও তা ক্রমশ বিকশিত হয়ে ওঠে গুজরাটে। অনেক বেশি সংখ্যায় জাহাজ নির্মিত হতে থাকে সেখানে। কেবলমাত্র স্থানীয় ব্যবসায়ীরাই নন, ব্রিটিশ কোম্পানিও গুজরাটে-তৈরি জাহাজ কিনতে শুরু করে। তবে সবকিছু মিলিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্র হিসেবে ক্রমশ কমে যেতে লাগল গুজরাটের গুরত্ব। তখন গুজরাটের স্থান নিল বাংলা। বাংলায় সক্ষম তাঁতবস্ত্রের উৎপাদন জাঁকিয়ে উঠল (বিশেষ করে ঢাকায় ও পাটনায়) আর জাঁকিয়ে উঠল তামাকের চাষ ও শোরার উৎপাদন।
সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজরা বাংলায় তাঁদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে তুললেন। বর্ধিষ্ণু শহর হুগলি এই সময়ে কার্যত ছিল তাদের অধীন। পর্তুগিজরা তামাকের ওপর কর ধার্য করলেন, ভারতীয়দের জবরদস্তি ক্রিস্টিয়ান ধর্মে দীক্ষিত করতে লাগলেন এবং সমুদ্রোপকূলবর্তী গ্রামগুলিতে হানা দিয়ে গ্রামের বাসিন্দাদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশে চালান দিতে লাগলেন ক্রীতদাস হিসেবে। এমন কি জাহাঙ্গীরের আমলেও পতুগিজদের বিরুদ্ধে এক সৈন্যদল প্রেরিত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৬৩২ খ্রীস্টাব্দে শাহ জাহানের রাজত্বকালে মোগল-সেনাবাহিনী দীর্ঘ সময় ধরে অবরোধ চালিয়ে যাবার পর ঝটিকা-আক্রমণে হুগলি দখল করে এবং চার হাজার বন্দী পর্তুগিজকে চালান করে দেয় আগ্রায়। এই বন্দীদের মধ্যে যাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি হন তাঁদের পরে মুক্তি দেয়া হয় আর বাদবাকি বন্দীদের হত্যা করা হয়।
তথ্যসূত্র:
১. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৩৪০-৩৪৩।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।