সীমান্ত হত্যা হচ্ছে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে প্রতিদিন মানুষ হত্যা। এই দুই দেশের সীমান্ত পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর সীমান্ত। এই সীমান্তে ১৯৭১ পরবর্তীকালে দেড় হাজারের অধিক বাংলাদেশী হত্যা করেছে ভারতের সীমানারক্ষী বাহিনী। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশীদের গত চার দশকে পাল্লা দিয়ে সাধারণ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে চলছে। গত সড়ে চার দশকের অধিক সময়কালে এই সংখ্যার সাথে বাড়ছে আহত, ধর্ষণ ও নির্যাতনের নৈমিত্তিক ঘটনা।
৭ জানুয়ারি ২০১৭ ফেলানি হত্যার ছয় বছর পালিত হয় বাংলাদেশে। ২০১১ সালে তাকে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফ হত্যা করে। সাত বছর পেরিয়ে গেলেও ফেলানিকে আমরা ভুলিনি। গত সাত বছরের প্রচারণায় দিল্লির নির্যাতনের প্রতীক হয়ে উঠেছে ফেলানি। আমাদের বিবেককে বারবার নাড়া দিয়ে যায় ফেলানি। সেই ফেলানি হত্যার বিচার শুরু হয়েছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সেই মামলার একটি মামলা থেকে[১] এবং সব আসামিকে দুটি মামলা থেকেই বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।[২] এইভাবেই হাজার বাংলাদেশি হত্যার প্রতীককে বিচারের নামে প্রহসনে রূপান্তর করেছে ভারতীয় বিস্তারবাদ।
দিল্লিতে পুঁজিবাদ, বিস্তারবাদ যতদিন আছে ততদিন সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষ মারা যাবেই। ফেলানি হত্যার বিচার কেবল দিল্লির পুঁজিবাদ, সম্প্রসারণবাদ, সামন্তবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেস-বিজেপির কবর রচনার মাধ্যমেই হতে পারে।
প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার সীমানা আছে; এবং এই সীমানা হচ্ছে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমান্ত৷ বাংলাদেশের সঙ্গে পূর্বদেশসমূহের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে৷ শুধু পশ্চিমবঙ্গের সাঙ্গেই ২,২১৭ কিলোমিটার সীমান্ত আছে বাংলাদেশের৷
দশক অনুযায়ী ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ভারত ১০৩ জন বাংলাদেশী হত্যা করে। ১৯৮২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ভারত হত্যা করে ১৭৯ জন বাংলাদেশী এবং ৪ জন বিজিবিকে হত্যা করে ভারত কর্তৃপক্ষ। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ২৬৪ জন বাংলাদেশী এবং ১০ জন বিজিবিকে হত্যা করে ভারত। ২০০২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৬৬৬ জন বাংলাদেশী এবং ২জন বিজিবিকে হত্যা করা হয়। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৭৮ জন বাংলাদেশী হত্যা করে অর্থাৎ এই ৪৫ বছরে মোট হত্যা ১৩৯১ জন।[৩]
অন্য একটি লেখায় দেখা যাচ্ছে ১৯৭১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ ৯৩০০ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে।[৪] বিপরীত দিকে গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড বিজিবি ৩৬ জন ভারতীয় নাগরিক এবং ১৬ জন বিএসএফকে হত্যা করেছে এবং এসব বিএসএফ ১৯৯৯ সালে মারা যায়।[৫]
দশক অনুযায়ী সীমান্তে মোট বাংলাদেশী হত্যা
অন্য বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া হত্যাকাণ্ডের মোট দশকওয়ারি এবং বছরওয়ারি হিসাব নিম্নে দেয়া হলো। হত্যার এই মহামিছিল থামতে পারে কেবল ভারত নামের খুনে রাষ্ট্রটির কাঠামো পরিবর্তনে।
সাল | মোট হত্যা |
১৯৭২-১৯৮১ | ১০৩ জন |
১৯৮২-১৯৯১ | ১৮৩ জন |
১৯৯২- ২০০১ | ২৭৪ জন |
২০০২-২০১১ | ৬৬৮ জন |
২০১২-২০১৬ | ১৭৮ জন |
সাড়ে চার দশকে | ১৪১৬ জন |
বছর অনুযায়ী সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা
সাল | মোট হত্যা | সাল | মোট হত্যা |
১৯৯৬ | ১৩ | ২০০৮ | ৬২ |
১৯৯৭ | ১১ | ২০০৯ | ৯৬ |
১৯৯৮ | ২৩ | ২০১০ | ৭৪ |
১৯৯৯ | ৩৩ | ২০১১ | ৩৪ |
২০০০ | ৩৯ | ২০১২ | ৪২ |
২০০১ | ৯৪ | ২০১৩ | ১৯ |
২০০২ | ১০৫ | ২০১৪ | ৩৮ |
২০০৩ | ৪৩ | ২০১৫ | ৪৬ |
২০০৪ | ৭৬ | ২০১৬ | ৪৫ |
২০০৫ | ১০৪ | ২০১৭ | ২২ |
২০০৬ | ১৪৬ | ২০১৮ | ১১ |
২০০৭ | ১২০ | ২০১৯ | ৪৩ |
সর্বমোট | ৮০৭ | সর্বমোট | ১৩৩৯ জন |
অর্থাৎ প্রতি বছর যে হারে সাধারণ মানুষ হত্যা হয়েছে তা পৃথিবীর আর কোনো সীমান্তে ঘটেনি। গত ২৪ বছরে সর্বমোট হত্যা ঘটেছে ১৩৩৯ জন।
অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে ভারত দুটি প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করেছে। এই দুই দেশের মধ্যে যদিও কাগজে কলমে বন্ধুত্ব রয়েছে, তবে ইজরায়েল ফিলিস্তিনিদের সাথে যেমন সম্পর্ক সেরকমই ইস্রায়েলের মতোই ভারত বাংলাদেশীদের সাথে শত্রু হিসাবে আচরণ করে। বিশ্বে মাত্র তিনটি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো, ইস্রায়েল-ফিলিস্তিন এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অবস্থিত কাঁটাতার অমানবিকতার করুণ চিহ্ন বহন করে চলেছে।
তথ্যসূত্র:
১. অনলাইন ডেস্ক, দৈনিক ইত্তেফাক আর্কাইভ, ঢাকা, প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৩, সংগ্রহের তারিখ ৭ জানুয়ারি ২০১৮, প্রকাশক ইত্তেফাক গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স লিঃ, লিংক http://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDlfMDZfMTNfMF8wXzNfNjkyNTk=
২. কলকাতা ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি, বাংলা বিডিনিউজ, ঢাকা, প্রকাশকাল ৩ জুলাই, ২০১৫, খবর, বাংলাদেশ, ফেলানি হত্যা: বিএসএফের বিচারে অমিয় এবারও ‘খালাস’, খবরের লিংক https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article991670.bdnews
৩. Independent Online Desk, 22 February, 2017, the independent, Dhaka, 1,391 Bangladeshis killed by Indians along border in 45yrs, news link: http://www.theindependentbd.com/post/82165
৪. সেলিম খান, প্রকাশকাল ৮ জানুয়ারি, ২০১৮, সীমান্ত হত্যা ভারতীয় প্রভাবপ্রপঞ্চ, খোলা কাগজ, ঢাকা, প্রবন্ধের লিংক http://www.kholakagojbd.com/2018/01/08/36392.php
৫. Independent Online Desk, Ibid
৬. Jamal Uddin, December 27, 2017, http://www.dhakatribune.com, Why border killing has not stopped, Editorial link: http://www.dhakatribune.com/bangladesh/2017/12/27/border-killing-not-stopped/
৭. Moazzem Hossain Lalmonirhat, December 30, 2017, http://www.dhakatribune.com, BSF kills Bangladeshi along Lalmonirhat border, abducts another,News link: http://www.dhakatribune.com/bangladesh/nation/2017/12/30/bsf-kills-bangladeshi-along-lalmonirhat-border/
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।
চমৎকার লেখা।