মায়ানমার বা মিয়ানমার বা মায়ানমার ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র (ইংরেজি: Republic of the Union of Myanmar, পূর্বনাম: বর্মা ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র) হচ্ছে ইন্দোচীন উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত জাতিদম্ভী পুঁজিবাদ অনুসারী শোষণমূলক রাষ্ট্র। দেশটির মূল ভূভাগ থাইল্যাণ্ড, লাওস, চীন, ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত। এদেশ নদীর উপত্যকাকীর্ণ পর্বত ও মালভূমির দেশ, উষ্ণমণ্ডলীয় অরণ্যের দেশ।
ব্রহ্মদেশীয় মানুষ এক সুপ্রাচীন সভ্যতার অধিকারী। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের কবলমুক্ত হয়ে সেই দেশ স্বাধীনতা ঘােষণা করে।
কিন্তু জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী ও জমিদাররা ক্ষমতাসীন হওয়ার ফলে সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালে একটি ভুয়া-বিপ্লবী পরিষদ দেশের শাসনভার গ্রহণ করে এবং তারা বার্মার উপযােগী একটি ভুয়া-সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি গ্রহণক্রমে দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
সেই সময়ের সংবিধান অনুযায়ী দেশের নামকরণ হয়েছিল বর্মা ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। দেশের রাজধানী ইয়াঙ্গুন, জনসংখ্যা ২০ লক্ষাধিক।
গৃহযুদ্ধের কবলে মায়ানমার
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে মিয়ানমারের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে ধারাবাহিক ভাবে গৃহযুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধগুলির বিভিন্ন বাহিনীগুলো জাতিগত ও উপ-জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রধানত সংগ্রাম করে। দেশটির জাতিগতভাবে বামার জাতি অধ্যুষিত কেন্দ্রীয় জেলার বিরোধের প্রাথমিক ভৌগলিক এলাকায় গৃহযুদ্ধ চলে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ চলমান এলাকাগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশি সাংবাদিক ও দর্শকদের বিশেষ ভ্রমণের অনুমতি প্রয়োজন।[২] দ্বন্দ্বটি বিশ্বের দীর্ঘতম চলমান গৃহযুদ্ধ হিসাবে সারা দুনিয়ার কাছে পরিচিত।
মায়ানমারের অর্থনীতি
নিজ নির্ধারিত পথে মায়ানমার বহু সুদূরপ্রসারী সংস্কার সাধন করেছে। সে সকল বিদেশী ব্যাঙ্ক, কোম্পানি, শিল্পসংস্থা, পরিবহণ ও যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত পুঁজিবাদী উৎপাদনের কোন কোন শাখা, বিদেশী ও পাইকারী ব্যবসা জাতীয়করণ করেছে। মােট জাতীয় উৎপাদের প্রায় ৩৫ শতাংশ আজ দেশের বিকাশমান রাষ্ট্রীয় খাতের অধীন। তৈল, রুপা, টিন, টাংস্টেন, সীসা, দস্তা, তামা নিষ্কাশন, মূল্যবান পাথর সংগ্রহ, সেগুন কাঠ এবং দারশিপ ও অন্যান্য প্রসেসিং শিল্প এখন রাষ্ট্রায়ত্ত।
মায়ানমার ১৯৮০-র দশকে ট্র্যাক্টর যােজন কারখানা, নাইট্রজেন সার ও খামার-যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা, বস্ত্রকল সহ অনেকগুলি শিল্প-প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছিল। এগুলি দিয়েই তার বিকাশমান জাতীয় শিল্পের মূল কাঠামাে গঠিত।
দেশের চার-পঞ্চমাংশ মানুষ কৃষিজীবী বিধায় অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ শাখার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ঐকান্তিক উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে। কৃষকরা এখন জমিদারদের দেয় রায়তী খাজনা ও মহাজনদের ঋণশােধ থেকে মুক্ত হয়েছে এবং সারক্রয় ও জলসেচ ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য সরকারী ঋণসুবিধার সুযােগ পাচ্ছে। সমবায়ী খাতও সংকুচিত হয়েছে। তারা অনাবাদী জমি উদ্ধার, জলসেচকৃত জমির এলাকা বৃদ্ধি, সার ও কৃষিযন্ত্রপাতির অধিকতর ফলপ্রসূ ব্যবহার ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। কৃষকদের সাহায্যের জন্য রাষ্ট্র মেশিন ও ট্র্যাক্টর স্টেশন এবং পরীক্ষামূলক আদর্শ কৃষি সমবায় গঠন করেছে।
মায়ানমার দেশের অধিকাংশ জমিই ধানখেত এবং বার্ষিক উৎপাদন গড়পড়তা ৮০ থেকে ৯০ লক্ষ টনের মতাে। অন্যান্য ফসলের মধ্যে তিল, চীনা বাদাম, তুলা, আখ ও ডাল উল্লেখ্য। এগুলির কোন কোনটি, বিশেষত চাল প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা হয়। চাষের পশু যেমন ষাঁড় ও মহিষ এবং গবাদি ও অন্যান্য পশু পালিত হয়ে থাকে।
অর্থনৈতিক পুনর্গঠন জনসংখ্যার সামাজিক কাঠামাে পরিবর্তনের নিয়ামকস্বরূপ। শােষক শ্রেণী তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত হচ্ছে এবং এরই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান শ্রমিক শ্রেণী অধিকতর গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন শুরু করেছে। শিল্পসংস্থায় শ্রমিক পরিষদ গঠিত হওয়ার ফলে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ উৎপাদন পরিচালনায় জড়িত হয়েছে। সরকার মায়ানমারের গ্রামাঞ্চলে জনগণের কৃষকসভা ও কৃষিসমবায় গঠন সহ দেশের কৃষিব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য চাষীদের আহবান করেছে।
মেহনতি মানুষের বৈষয়িক অবস্থা উন্নীত হচ্ছে। বর্মায় জীবিকার নিম্নতম মান নির্ধারিত হয়েছে, কর্মরতদের সবেতন ছুটি ও পেন্সনের ব্যবস্থা চালু হয়েছে, জনগণকে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য, সেবা ও শিক্ষা দান প্রবর্তিত হয়েছে। তদুপরি জাতীয় কর্মিদল গঠনের সমস্যা সমাধান করা হচ্ছে এবং সমস্ত লােকসংখ্যার স্বাক্ষরতার ও সাংস্কৃতিক মানােন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। অবশ্য সরকারের কার্যকলাপের ফলে নতুন পথে দেশের স্বচ্ছন্দ অগ্রগতিতে বিঘ্ন ঘটছে।
তথ্যসূত্র:
১. কনস্তানতিন স্পিদচেঙ্কো, অনুবাদ: দ্বিজেন শর্মা: বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, বাংলা অনুবাদ ১৯৮২, পৃ: ১২৬-১২৮।
২. “Restricted Areas in Burma”. Tourism Burma. 2013. https://web.archive.org/web/20130102230338/http://www.tourismburma.com/restricted-areas-in-burma/ Archived from the original on 2 January 2013. Retrieved 27 March 2013. Original link: http://www.tourismburma.com/restricted-areas-in-burma/
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।