পুনর্ভবা নদী (ইংরেজি: Punarbhaba River) বাংলাদেশ ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এই নদীটি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটির বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১০২ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পাউবো কর্তৃক এই নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৭২।[১]
পুনর্ভবা নদী প্রবাহ
পুনর্ভবা নদী ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পূর্ব দিকে জগন্নাথপুরের জলাভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। বীরগঞ্জে উপজেলায় নর্তা ও কাহারোল উপজেলায় কাঞ্চন নদ এর উপর পতিত হয়েছে। পুনর্ভবা এরপর বিরল উপজেলার ফারাক্কাবাদের কাছে ঢেপা নদীতে পতিত হয়েছে। পুনর্ভবা নদীতে পড়া ঢেপা নদী ছোট ঢেপা নামে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পূর্ব দিকে আউলিয়াপুর জলাভূমি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই নদী পাথরঘাটা উপনদীসহ বীরগঞ্জের নিজপাড়ার কাছে আত্রাই নদীর শাখা মূল ঢেপা নদীতে পতিত হয়েছে। ঢেপা নদী এরপর বিরল উপজেলায় পুনর্ভবা নদীর সাথে মিলিত হয়ে পুনর্ভবা নামে দক্ষিণ পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। পুনর্ভবা নদী দিনাজপুর শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আশকরপুরের কাছে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেছে।
পুনর্ভবা নদী ভারতে প্রবেশের কিছু পরেই বিরল উপজেলা থেকে আসা বিজরা নদী ও পরে নাল নদ সীমান্ত অতিক্রম করে এর ডানতীরে এসে পড়েছে। দিনাজপুর সদর উপজেলার কমলপুর থেকে উৎপন্ন কাশিয়ানী নদী এর বামতীরে এসে পড়েছে।
পুনর্ভবা নদী ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার পাথরির কাছে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত ছুঁয়েছে। এই নদী এরপর সীমান্ত পথ ধরে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলায় বাংলাদেশে ঢুকেছে। এই পথে পুনর্ভবা নদীর বামতীরে মদইল, জবাই, গোয়ালা ও হাজারদিঘী নদী এবং ডানতীরে ভারত থেকে হাড়িয়া নদী এসে পড়েছে। পুনর্ভবা নদীর এই পথে বিখ্যাত জবই বিল অবস্থিত। পুনর্ভবা নদী সীমান্ত ত্যাগ করার পর চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলায় ১০ কিলোমিটার জলাভূমি এলাকা দিয়ে রোহনপুর রেলপথের ভাটিতে মহানন্দা লোয়ার নদীতে গিয়ে পড়েছে।[২]
মৌসুমি প্রকৃতির এই নদীতে বর্ষাকালে প্রবল ধারায় পানি প্রবাহিত হয়। এই সময় দুইকুল উপচে তীরবর্তী এলাকায় পানি প্রবাহিত হয় এবং নদীতে সীমিত পরিসরে নৌকা চলাচল করে থাকে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। এ সময় নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় রীতিমতো ধান চাষ করা হয়।
অন্যান্য তথ্য:
পুনর্ভবা নদীটি জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত নয়। এই নদীর অববাহিকার প্রকল্পসমূহ হচ্ছে ভাপকি সেচ প্রকল্প, গাভেশ্বরী প্রকল্প, শিবপুর সেচ প্রকল্প, দাঙ্গারহাট সেচ প্রকল্প, বাদলপাড়া সেচ প্রকল্প এবং পুনর্ভবা প্রকল্প। এই নদীর তীরে দিনাজপুর পৌরসভা, রোহনপুর পৌরসভা, এবং বড় দরগারহাট অবস্থিত। এই নদীর উভয় তীরে বীরগঞ্জে সিংড়া জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। নদীর ডান তীরে ৪১.৩৬ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ আছে। এই নদীর তিনটি উপনদী রয়েছে, সেগুলো হলো টাঙ্গন নদী, কুলিক নদী এবং নাগর নদী।[২]
নদীর অতীত ইতিহাস:
অতীতে পুনর্ভবা নদীর প্রধান উৎস ছিলো ব্রাহ্মণপুর বরেন্দ্রভূমি। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে হিমালয়ের বন্যায় প্রচণ্ড ভূমিধ্বসে সানুর নিকট এ নদীর পার্বত্য উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই নদী ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার অবনমিত নিম্নভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে পদ্মার একটি উপনদীতে পরিণত হয়েছিলো।
দিনাজপুর শহর এ নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। বর্তমানে মৃত ঘাঘরা, গাবুরা, কাচাই প্রভৃতি নদী এক সময় পুনর্ভবারই উপনদী ছিল। নদীর গতিপথ উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। আত্রাই থেকে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে পুনর্ভবার উচ্চতর গতিপথ। দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হওয়ার পর পুনর্ভবা ঢেপা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, যা করতোয়া নদীর একটি শাখা নদী। দিনাজপুর শহরের ঠিক দক্ষিণে নদীটি পশ্চিম এবং পশ্চিম-কেন্দ্রীয় বরেন্দ্রভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর নদীবিস্তৃত ভূমির প্রশস্ততা ৩ থেকে ৮ কিলোমিটার।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
পুনর্ভবা নদীর অববাহিকা বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নদীর প্রবাহ পথে জবাই বিল ও বিস্তীর্ণ জলাভূমি থাকায় অতীতে এখানকার বিশাল এলাকা জুড়ে ধীবর বা জেলে সম্প্রদায় ছিল বলে জানা যায়। আবার এই জলাভূমির আশে পাশে বন্যার প্রভাবমুক্ত উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল থাকায় এখানে অতীতের রাজাদের রাজধানী ও দূর্গ গড়ে ওঠার সুযোগও সৃষ্টি করেছিল। বাংলার ইতিহাসে শক্তিশালী পাল রাজাদের উত্তরাধিকারী রাজারা দাক্ষিণাত্যের চালুক্যরাজ ও উড়িষ্যা রাজার আক্রমণে একসময় দুর্বল হয়ে পড়েন।
১০৭০ খ্রিস্টাব্দে ২য় মহীপাল রাজা হলে বরেন্দ্রের ধীবর রাজা দিব্যক বিদ্রোহ করেন ও মহীপালকে পরাজিত ও নিহত করে গৌড়ের রাজা হন। মহীপালের সাথে যুদ্ধে জয়ের স্মৃতি হিসেবে পত্নীতলার ধীবর দীঘিতে দিব্যক একটি গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ স্থাপন করেন। দিব্যকের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রুদ্রক ও তারপর তাঁর পুত্র ভীম সিংহাসনে বসেন।
পাল বংশে পরবর্তীতে রামপাল রাজা হলে (১০৭২-১১২৬) তিনি গৌড় ও বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারের কাজে হাত দেন। তিনি বাংলার ১৩ জন সামন্ত রাজার সাহায্য নিয়ে গৌড়ের সিংহাসন ফিরে পান। রামপালের আক্রমণে কৈবর্ত রাজা ভীম পরাস্ত ও সপরিবারে নিহত হন। রামপাল পুনর্ভবা নদীর তীরে রামাবতীতে তাঁর বিকল্প রাজধানী ও আত্রাই নদীর তীরে জগদ্দল নামের মহাবিহার নির্মাণ করেন। কবি সন্ধ্যাকর নন্দী ‘রামচরিতম’ গ্রন্থে রামাবতী নগরীর রূপ ও ঐশ্বর্যের প্রশংসা করেছেন। ধারনা করা হয়, সাপাহারের উচ্চ ভূমিতে এই নগরীর অবস্থান ছিল। এই অঞ্চলে মাটির বহুতল বাড়ী নির্মাণে যে স্থাপত্য শৈলী দেখা যায় তা অতীতের ধারাবাহিকতার রেশ বলে প্রতীয়মান হয়।
বর্তমান অবস্থা:
এই নদীটিতে সাপাহার অঞ্চলে আগস্ট থেকে এপ্রিল পর্যন্ত একেবারেই পানি থাকে না। ২০১৫ সালের নওগাঁবার্তার এক খবরে লেখা হয়েছে “হাঁটু জল দুরের কথা একজন মুমুর্ষ রোগীর জীবন বাঁচাতে যতটুকু পানির প্রয়োজন তা ও খুঁজে পাওয়া যায় না। বছরের অধিকাংশ সময় বুক ভরা বালি নিয়ে নদীটি তার স্মৃতি বহন করে আসছে”[৪]।
তথ্যসূত্র:
১. মানিক, মোহাম্মদ রাজ্জাক, বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি, কথাপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ঢাকা, পৃ: ১৩৫-১৩৬।
২. ম ইনামুল হক, বাংলাদেশের নদনদী, অনুশীলন ঢাকা, জুলাই ২০১৭, পৃষ্ঠা ৪২-৪৩।
৩. মাসুদ হাসান চৌধুরী, বাংলাপিডিয়া, নিবন্ধ পুনর্ভবা নদী, সংগ্রহের তারিখ ১৭ জানুয়ারি, ২০১৫.ইউআরএল: http://bn.banglapedia.org/index.php?title=পুনর্ভবা_নদী
৪. নওগাঁবার্তা, ২২ আগস্ট, ২০১৫, নওগাঁবার্তা পত্রিকা, সংগ্রহের তারিখ ১৭ জানুয়ারি ২০১৫. ইউআরএল: http://www.naogaonbarta.com/2015/সাপাহারের-পুনর্ভবা-নদী
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।