জৈন (ইংরেজি: Jainism) মতবাদের দুটি দিক। একটি ধর্মীয়, অপরটি তত্ত্বগত। ধর্ম হিসাবে জৈন ধর্মের উদ্ভব ও প্রসার ঘটে বৌদ্ধধর্মের উদ্ভবের সমসাময়িক কালে। বৌদ্ধ ধর্মের ন্যায় জৈন ধর্মেও প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটে। মহাবীরকে জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। মহাবীর বা জীন অর্থাৎ বিজয়ী, — জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতার উপর এরূপ আখ্যা তাঁর অনুসারীদের প্রদত্ত। মহাবীরের জীবনোপাখ্যান এরূপ যে তিনি ত্রিশ বছর বয়সে পিতামাতার আকস্মিক বিয়োগে দুঃখাভিভূত হয়ে দিগম্বর বেশে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। এরপর বার বৎসর যাবত অকল্পনীয় শারীরিক কৃচ্ছ্রতা এবং মানসিক সংযমের মাধ্যমে তিনি তাঁর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন।
দর্শন হিসাবে ভারতীয় দর্শনের বহুতত্ত্ববাদী তত্ত্বের প্রকাশ দেখা যায় জৈন মতবাদে। জৈন দর্শনে সৃষ্টির মূল হচ্ছে তত্ত্ব বা সার। তত্ত্ব প্রধানত দুই প্রকার: জীব(আত্মা) এবং অ-জীব(আত্মার বহির্ভূত জগৎ)। আত্মা বা জীবের মূল হচ্ছে চেতনা। অ-জীবের প্রকারভেদই বস্তু। বস্তুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সম্পর্ক, গন্ধ, শব্দ, রঙ ও স্বাদ। বস্তু অণুতে বিভাজ্য, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, পরিবর্তনশীল এবং আদি ও অন্তশূণ্য। কিন্তু তা হলেও বস্তু বিধাতার সৃষ্টি। কর্ম হচ্ছে দেহের সঙ্গে আত্মার সম্পর্কের মাধ্যম। পরম বা সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মা বলে কিছু নেই। পৃথিবীতে যত প্রাণী তত আত্মা। প্রত্যেক আত্মারই সর্বত্রগামী হওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু দেহের বন্ধনে আবদ্ধ বলে আত্মা দেহের বাইরে যেতে পারে না।
মানুষকে সাধনা করতে হবে, দেহের বন্ধন থেকে আত্মাকে মুক্ত করার জন্য। জৈনমতে আত্মার মুক্তির পথ হচ্ছে ‘ত্রিরত্ন’ কে অনুসরণ করা। ত্রিরত্ন হচ্ছে জ্ঞান, ধর্ম ও বিশ্বাস। কিন্তু দেহের বন্ধন হতে আত্মার মুক্তি মানে পরম আত্মার মধ্যে জীবাত্মার লয় বা মিলন নয়। কারণ পরম আত্মা বলে কিছু নেই। আত্মার মুক্তির অর্থ বৌদ্ধ দর্শনের নির্বাণও নয়। দেহের বন্ধন হতে মুক্ত জীবাত্মা মানুষের অকল্পনীয় কোনো লোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
নীতিধর্ম বা সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে জৈন ধর্ম হচ্ছে চরম অহিংসা এবং কৃচ্ছ্রতাবাদী। ত্রিরত্নের অন্যতম রত্ন ‘ধর্মের’ অনুশাসন হচ্ছে: কোনো প্রাণীকে হত্যা করবে না; মিথ্যে কথা বলবে না; চৌর্যবৃত্তি গ্রহণ করবে না; ইন্দ্রিয়গত কোনো ভোগে লিপ্ত হবে না; এবং জ্ঞানের প্রশ্নে ইন্দ্রিয়কে অভ্রান্ত বলে মানবে না।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৪৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।