পাখি বাড়াতে আমাদেরকে পাখি বাড়ানোর পদ্ধতি অনুসারে কাজ করতে হবে

পাখি বাড়াতে হলে আমাদেরকে পাখি বাড়ানোর পদ্ধতি অনুসারে কর্মপদ্ধতি ঠিক করে সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে পাখির পরিমাণ ও বিচরণের ক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে হবে। পাখি বা পাখির গান যেখানে নেই সে জায়গা অবরুদ্ধ, দূষিত। সেখানকার প্রকৃতি ও নিসর্গে প্রাণ নেই। কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ হলো পাখি, যা প্রকৃতিপ্রেমিসহ সব মানুষের মনকে সবসময় দোলা দেয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৫৬ প্রজাতির পাখি দেখা যায়, যদিও মনে করা হয় বাংলাদেশে ২০০ বছর আগে ৮০০ প্রজাতির বেশি পাখি পাওয়া যেত। বাংলাদেশ থেকে গত ২০০ বছরে হারিয়ে গেছে প্রায় ১৫০ প্রজাতির পাখি আর রাজধানী ঢাকা শহর থেকে গত দুই দশকে শতকরা ৫০ ভাগ প্রজাতির পাখিই হারিয়ে গেছে। আমরা যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তবে আগামি দশ বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে আরো ৪০০ প্রজাতির পাখি।

পাখি হারিয়ে যাবার মূল কারণগুলো হলো জলাশয় ভরাট, অবাধে গাছপালা কাটা, নিম্নভূমিগুলো দখল করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা। এসব ভূমিদস্যুর কারণেই আজকে জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। অথচ একটি এলাকার উদ্ভিদকুল, প্রাণিকুল, জলাশয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বনভূমি ও পুরনো গাছপালা রক্ষা করা:

পাখি বেঁচে থাকার জন্য দরকার ঘন গাছপালাযুক্ত এলাকা। দেশের সর্বত্রই গাছপালা কমে যাওয়ায় এখন অনেক প্রজাতির পাখিই চোখে পড়ে না। এমনিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পাখির বিভিন্ন প্রজাতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন ভবনের নামে কাটা হয় পুরনো গাছগুলো। অথচ এসব গাছের সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের সম্পর্কের কথা ভুলে গেছেন সংশ্লিষ্টরা। পুরনো বা মৃত গাছের গ র্তে নানা পাখি ও অন্যান্য প্রাণি বাসা বাঁধে বা আত্মরক্ষা করে। পুরনো গাছ না থাকার কারণে অনেক প্রজাতির পাখিসহ বিড়াল পরিবারের প্রাণিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সূত্রমতে, হার্ভে নামে এক ব্রিটিশ নাগরিক গুলশান এলাকায় প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি দেখার কথা বর্ণনা করেন, যা বর্তমান সময়ে কল্পনাও করা যায় না। এর একটাই কারণ প্রাচীন বৃক্ষ নিধন।

আরো পড়ুন:  পাতি হুদহুদ বিশ্বে বিপদমুক্ত এবং বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি

পাখির ব্যাবসা বন্ধ করা:

কিছু অসাধু পাখি ব্যবসায়ী দেশি পাখির বিভিন্ন প্রজাতিকে ধ্বংস করছে। সমস্ত দেশি এবং বন্য ও বিপন্ন পাখি ব্যবসা বন্ধ করা জরুরি।

পাখি শিকার বন্ধ করা:

বাংলাদেশে পাখি শিকার করা হয় নানাভাবে। সব রকমের পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, আমরা মানুষ তৈরি করতে পারি, কিন্তু পাখি তৈরি করতে পারি না।

জলাভূমি ছাড়তে হবে:

জীববৈচিত্র্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে জলাশয় রক্ষা ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নেই। ইতিমধ্যে যেসব জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে আর যেগুলো আছে সেগুলো সংরক্ষণ খুবই জরুরি। ড. আলী রেজা খান জানান “সবার আগে দরকার বন্য প্রাণী এবং তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র বন্য প্রাণী পরিদপ্তর গঠন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে পরিবেশ, বন্য প্রাণী ও বন মন্ত্রণালয় করা যেতে পারে। বাংলাদেশের বন পরিদপ্তর যে প্রক্রিয়ায় বন ব্যবস্থাপনা করে, তা বাণিজ্যিক বন-ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ছাড়া ভারত-বাংলা বৈরী পানিব্যবস্থা পরিযায়ী পাখির চারণভূমির সংকটের সঙ্গে জড়িত।

কাজেই বন্য প্রাণীর জন্য ছাড়তে হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ জলাভূমি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, সরকার ঘোষিত বন্য প্রাণী ও পাখির অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যান, ইকো-পার্ক, রামসার, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ইত্যাদি।”

নতুন বনভূমি সৃজন করা:

জেলায় জেলায় তৈরি করতে হবে নতুন বনভূমি, যদিও মানুষ বনভূমি সৃষ্টি করতেপারে না, তদুপরি, দেশিয় গাছপালার স্বল্প জায়গার বনভুমি সৃষ্টি করা সম্ভব।আমরা চাইলে প্রতি জেলায় প্রাথমিকভাবে ১০০ হেক্টর জমি বনভূমির জন্য বরাদ্দদেয়া খুব কঠিন কিছু নয়। আমরা আশাকরি অনতিবিলম্বে প্রতি জেলায় জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য পৃথক বনভূমি সৃজন করা হবে।

বন্য প্রাণি পরিদপ্তর গঠন:

বন্যপ্রাণি রক্ষার জন্য একটি আলাদা বন্যপ্রাণি পরিদপ্তর গঠন করতে হবে। “বন্য প্রাণী পরিদপ্তরের প্রথম কাজ হবে, যতদূর সম্ভব বেদখল হয়ে যাওয়া সব সরকারি জলাভূমি উদ্ধার করে তা শুধু মৎস্যসম্পদ এবং পাখি সংরক্ষণের কাজেব্যবহার করা। যার মধ্যে অবশ্যই থাকবে স্থানীয় তৃণমূল জনগণের শ্রমভিত্তিক অংশীদারি। জলাভূমির অভয়াশ্রম বা অভয়ারণ্যে সুষ্ঠু পরিবেশ এবং জনগণের যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে এ পরিদপ্তর। এরপর তারা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করবে। এতে বিভিন্ন সমিতি-সংগঠনের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।”

আরো পড়ুন:  বাংলা নীলকণ্ঠ বিশ্বে বিপদমুক্ত এবং বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি

দেশি গাছপালা লাগানো:

আমাদের এ দেশে স্থানীয় যেসব প্রজাতির পাখি আছে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি; যা কেবল দেশি গাছ, লতা-গুল্ম, দেশি উদ্ভিদ প্রজাতি ও জলাধার সংরক্ষণ করেই সম্ভব। এ ছাড়া নগরীর সড়ক-বিভাজনীতে দেশি গাছ লাগানোর ব্যাপারটিও খাটো করে দেখার নয়। আলংকারিক উদ্ভিদ শুধু চাকচিক্য বৃদ্ধিই করে, জীববৈচিত্র রক্ষা করে না পাখিবান্ধব গাছপালা লাগাতে হলে পাখির জীবন প্রণালী জানা দরকার। কোন গাছে কোন পাখি থাকে তা গবেষকদের কাছ থেকে জানতে হবে এবং সেসব গাছ রোপন করতে হবে। বিদেশি আগ্রাসি ক্ষতিকর প্রজাতির গাছ রোপণ বন্ধ করতে হবে।

গাছে কলস টাঙানো:

কিছু পাখি গাছেরগর্তে বা কোটরে বাসা করে এবং ছানা তোলে। গাছে শত শত বছরে কোটর তৈরি হয়।পুরনো গাছ না থাকায় গাছে কোটর বা গর্ত নেই। এই অবস্থায় পাখি রক্ষার্থে গাছেগাছে কলস টাঙিয়ে দেয়া হচ্ছে। সারা দেশেই গাছে কলস টাঙানো জনপ্রিয় করতে হবে।

পাখিবান্ধব বাড়িঘর নির্মাণ:

ঘর নির্মাণের সময় এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে যেসব পাখি ঘরের বিভিন্নস্থানে বাসা করে তারা বাসা করার জায়গা পায়; যেমন ঘরের ঘুলঘুলি, ঘরের ছাঁদ ওবারান্দায় কিছু জায়গা পাখির বাসা তৈরির জন্য ফাঁকা রাখা।রাত্রে যেন আলোর উজ্জ্বলতা ঘরের বাইরে না যায় সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে।রাতের শহরের আলোর উজ্জ্বলতা পরিযায়ী পাখির গতিপথে বাধার সৃষ্টি করে।

চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনা উন্নত করা:

যেসব পাখি চিড়িয়াখানায় রয়েছে সেগুলোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে তারা বন্দি অবস্থায়ও ছানা তুলতে উৎসাহিত হয়।

তথ্যসূত্র:

১. ড. আলী রেজা খান, “ছাড়তে হবে জলাভূমি” দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১০, ইউআরএল: http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=Tax&pub_no=69&cat_id=3&menu_id=22&news_type_id=1&index=1&archiev=yes&arch_date=06-02-2010

Leave a Comment

error: Content is protected !!