ইবনে সিনা ছিলেন দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী এবং কবি

মধ্য এশিয়ার বুখারার আবু আলী ইবনে সিনা (ইংরেজি: Ibn Sina বা Abu Ali Sina বা Pur Sina বা Avicenna; ৯৮০ – জুন ১০৩৭ খ্রি.) ইউরোপে দার্শনিক আভিসেনা নামে পরিচিত। দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী এবং কবি ইবনে সিনার জীবন ছিল বিপুল জ্ঞানরাশিতে সমৃদ্ধ ও ঘটনায় বিচিত্র। অতি অল্প বয়সে তাঁর বুদ্ধির আশ্চর্য দীপ্তি প্রকাশ পায়। দশ বছর বয়সে তিনি হাফেজে কোরআন এবং ষোল বৎসরে চিকিৎসার একটি নতুন পদ্ধতির আবিষ্কারক হিসেবে সকলের বিস্ময় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সতেরো বছর বয়সে বুখারার আমীর তাঁকে দরবারের চিকিৎসক নিযুক্ত করেন। কিন্তু এই আমীরের পতনের পর ইবনে সিনার জীবনেও অনিশ্চয়তা নেমে আসে। এরপর থেকে দেশে-বিদেশে ঘুরে ঘুরে তাঁকে জীবন কাটাতে হয়। এক সময় ইবনে সিনা কারাগারেও নিক্ষিপ্ত হন। কারাগার হতে পলায়ন করে তিনি ইস্পাহান যান।

আরব সভ্যতায় প্রাচীন গ্রীসের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনকে সংযোজিত করে আরব সভ্যতার মাধ্যমে ইউরোপে সেই অমর জ্ঞান সম্ভারকে পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে ইবনে সিনার অবদান অতুলনীয়। ইবনে সিনা ইউক্লিডের জ্যামিতিকে আরবী ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেন এবং এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার নতুনতর বিকাশ সাধন করেন।

ইবনে সিনার দর্শনে ভাববাদী ও বস্তুবাদী উভয় ধারারই আমরা পরিচয় পাওয়া যায়। ইবনে সিনা গতি, শূণ্যতা, তাপ, আলো, স্থানিক আকর্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে গবেষণা করেন। সে যুগে প্রচলিত আল-কেমি বা কিমিয়া বিদ্যার ধাতু রূপান্তরবাদকে তিনি অস্বীকার করেন।

ইবনে সিনার অবদানের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর রচিত তাঁর বিশ্বকোষ ‘কানুন’। চিকিৎসার তত্ত্ব, অমিশ্র বা সহজতর ঔষধাদি, রোগের সাধারণ প্রকার, রোগের নিরাময় ব্যবস্থা এবং মিশ্র ঔষধ প্রভৃতি বিষয়ের উপর পাঁচ খন্ডে রচিত সুবিপুল ‘কানুন’ এ ইবনে সিনা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব এরূপভাবে পেশ করেন যে, তাঁর এই গ্রন্থ চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরু বলে পরিচিত গ্যালেনের গ্রন্থসমূহকে অতিক্রম করে যায় এবং পাঁচ শতাধিক বছর ধরে চিকিৎসা-বিজ্ঞানে অপ্রতিদ্বন্ধী জ্ঞানগ্রন্থ বলে প্রতিষ্ঠিত থাকে।

আরো পড়ুন:  মার্টিন হাইডেগার ছিলেন জার্মান অস্তিত্ববাদী দার্শনিক

মূলত চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইবনে সিনার কানুন এরূপ অভ্রান্ত বলে গৃহীত হতে থাকে যে, এর বাইরে অপর কোনো তত্ত্ব বা তথ্য থাকতে পারে বলে মানুষ বিশ্বাস করতে চাইত না। এর ফলে পরবর্তীকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধিকতর বিকাশের ক্ষেত্রে ইবনে সিনার ‘কানুন’ প্রতিবন্ধকতার দুর্গ হয়ে দাঁড়ায়।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২০৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!