(দীপাঞ্জন রায়চৌধুরীকে)
সবাই সমান
যেখানে গেলে সবাই সমান হয়
‘সব লাল হো যায়েগা’ ব’লে
এক লাফে
সটান সেই জায়গায়
কাঁধ ধরাধরি ক’রে
পৌছুনো
এবং পৌঁছে দেওয়া গেল।
রাবণের চুল্লির সামনে লাইনবন্দী হয়ে
ধর্না দিচ্ছে
লালগাড়ি-পাশ-হওয়া
ছুরিবিদ্ধ গুলিবিদ্ধ
অপাপবিদ্ধের দল।
নিশির ডাকে নিশান হাতে
যারা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছিল
তারা এখন
সাড়ে তিন হাত জমির দখল ছেড়ে
আগুনের মুখে ছাই হওয়ার অপেক্ষায়
চোখ বন্ধ ব’লে
ওরা দেখতে পাচ্ছে না
মেঝে থেকে দেয়াল, দেয়াল থেকে ছাদ
শোয়ানো আর দাড়-করানো অক্ষরে
অঙ্গার দিয়ে লেখা অঙ্গীকার —
ভুলব-না ভুলব-না ভুলব-না !
একটা ক’রে যায়
লাইন একটু করে এগোয় ।।
বলির বাজনা
রাত্রে রেডিওতে যখন খবর বলে
কানে আঙুল দিয়ে থাকি
সকালে কাগজ এলে
ছুতেও ভয় করে
লাইনবন্দী চেনা মুখগুলো
একের পর এক
একের পর এক ভেসে ওঠে
আমার পুরনো সব বন্ধুর ছেলেরা
ছিল আমার সব নতুন বন্ধু
সিগারেট আমিই এগিয়ে দিতাম
যাতে তারা ছলছুতোয়
আমাকে একা ফেলে উঠে যেতে না পারে
ছেলে-ধরার দল
নাকের কাছে ফুল শুকিয়ে
ফুলে নিয়ে চলে গেছে
তাদের বলি দেবে ব’লে
এখন যারা কবিতা শোনাতে আসে
তাদের কবিতা আমি শুনতে চাই না
যারটা শুনতে চাই
কলম ছুড়ে ফেলে দিয়ে
এখন সে শবসাধনায় উধাও
লালবাড়ির ভেতর থেকে আসছে
হায়নাদের হাড়ভাঙার শব্দ
ঘুমের মধ্যে আমি চমকে চমকে উঠছি
কালো গাড়িগুলো থেকে
ঘষে ঘষে তোলা হচ্ছে চাপ চাপ রক্ত
হরিণবাড়িতে পাগলাঘণ্টি
বেজে চলেছে বেজে চলেছে বেজে চলেছে
একদল বাইরে থেকে ওসকাচ্ছে,
একদল ভেতর থেকে ভাঙছে।
বলির বাজনায় আর জয়জোকারে
রক্তমাখা খাড়াগুলো
উঠছে আর পড়ছে
উঠছে আর পড়ছে।।
মধ্যিখানে চর
এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন
এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন
ভাঙছে আর ভাঙছে
বলেছিল কবর দিতে
যারা খুঁড়ছিল
সেই কবরেই পেছন থেকে তাদের ঠেলে দেওয়া হল
বলেছিল দেশ বরবাদ
পরে দুনিয়াটাকেই ছেটে ফেলে দিল
ধরা পড়বার ভয়ে
সারা রাস্তা ‘চোর চোর’ করে ছোটার পর
সিন্দুকের লাখবেলাখে
গোয়েন্দা-সিরিজে ফাঁস হয়ে যায়
হাতসাফাইয়ের কলকাঠি
গড়বার দল নয়
একটা ভাঙবার চক্র
নামাবলী গায়ে দিয়ে ভক্তদের ভোলাচ্ছে
মধ্যিখানে চর
তার আড়ালে বসে রয়েছে
কোন্ সে সওদাগর ?
বন্ধুরা কোথায়
কাঁধের গামছাগুলো হাতে নিয়ে
একটা দল
গুম হয়ে ব’সে ।
পথ
এখন এক অন্ধগলিতে এসে ঠেকে গেছে
শহীদের স্মৃতি রাখতে শহীদ হওয়া,
খুনের বদলে খুন –
এই বৃত্তটাকে কিছুতেই ছাড়ানো যাচ্ছে না।
যারা মৃত্যুর সওদাগর
পাখি পড়ার মতো করে তারা বোঝাচ্ছে
হয় মারো নয় মরো,
এগোবার পথ তারাই প্রশস্ত করেছিল,
এখন ফেরবার পথে
তারাই কাঁটা দিচ্ছে।
আমার সেই বন্ধুরা কোথায়
আমি জানি না
পাছে কোনো অকল্যাণ হয়
তাই কাউকে জিগ্যেস করি না
দেখে ফেললে না চেনার ভান করি।
যারা শত্রুকে একঘরে না ক’রে
বন্ধুকে শক্র করছে,
যারা সংগ্রামে সাথীদের
আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়ে
মৃত্যুর গুণগান গাইছে –
সেই শয়তান চক্রটাকে এবার
যেখানে পাও খুঁজে বার কর
ফাঁক ভরাট করো
ভাঙাকে জোড় দাও।
তাহলেই সোনার কৌটোয় কালো প্রাণভোমরাগুলো
বুক ফেটে দাপিয়ে মরে যাবে।
কাঁধের গামছা কোমরে বেঁধে
শ্মশান থেকে উঠে এসো
ভালবাসায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে
জীবনটাকে ধরো।
যৌবনের ফেরাই দিয়ে
হারিয়ে-যাওয়া নতুন বন্ধুরা আমার,
সমানে জিতে নাও সৃষ্টির পিঠ।
যাবার আগে যেন দেখে যাই
মেঘভাঙা রামধনু
ঢেলে সাজা পৃথিবীর বুকে
যেন শুনতে পাই
ভোরবেলার আজান ॥
সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ – ৮ জুলাই ২০০৩) ছিলেন বিশ শতকের উল্লেখযোগ্য বাঙালি বামপন্থী কবি ও গদ্যকার। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও ছড়া, প্রতিবেদন, ভ্রমণসাহিত্য, অর্থনীতিমূলক রচনা, অনুবাদ, কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা, উপন্যাস, জীবনী, শিশু ও কিশোর সাহিত্য ইত্যাদি রচনাতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ এবং বহু দেশি-বিদেশি কবিতা বাংলায় অনুবাদও করেছেন। “প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য় এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা” বা “ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত” প্রভৃতি তাঁর অমর পঙক্তি বাংলায় আজ প্রবাদতুল্য।