ল. ন. তলস্তয়

লেভ তলস্তয় মারা গেছেন। শিল্পী হিসেবে তাঁর বিশ্বজনীন তাৎপর্যে এবং চিন্তাবীর আর প্রচারক হিসেবে তাঁর সর্বজনীন খ্যাতিতে – এর প্রত্যেকটার নিজস্ব কায়দায় — প্রতিফলিত হয়েছে রুশ বিপ্লবের বিশ্বজনীন তাৎপর্য।

মহাশিল্পী হিসেবে তলস্তয় দেখা দেবার সময়ে তখনও দেশে ভূমিদাসপ্রথার আধিপত্য ছিল। অর্ধ-শতকের বেশি কালের সাহিত্যিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে সৃষ্টি-করা একগুচ্ছ মহান রচনায় তিনি চিত্রিত করেছেন প্রধানত পুরনো প্রাকবিপ্লব রাশিয়াকে, যে-রাশিয়া ১৮৬১ সালের [১] পরেও রয়ে গিয়েছিল আধা-ভূমিদাসপ্রথার অবস্থায় – জমিদার আর কৃষকের গ্রাম-রাশিয়া। রাশিয়ার ইতিহাসের এই কালপর্যায়টা চিত্রিত করার মধ্যে তলস্তয় এতসব বিরাট সমস্যা তুলে ধরতে পেরেছেন, আর সক্ষম হয়েছেন শিল্পক্ষমতার এমন শিখরে উঠতে যে, তাঁর রচনাবলির স্থান হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির মধ্যে। ভূমিদাসমালিকদের পদানত একটি দেশে বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুতির যুগটা তলস্তয়ের দেদীপ্যমান আলোকসম্পাতের কল্যাণে হয়ে উঠল সমগ্র মানবজাতির শিল্পকলাগত বিকাশের ক্ষেত্রে একটা অগ্রপদক্ষেপ।

শিল্পী তলস্তয়কে জানে মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা অংশ – এমনকি রাশিয়ায়ও। তাঁর মহান রচনাবলিকে যথার্থই সবাকার সম্পত্তি করতে হলে, সমাজের যে-ব্যবস্থা লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি মানুষের জন্যে অজ্ঞতা, তমসা, উঞ্ছবৃত্তি আর গরিবি অবধারিত করে রেখেছে সেটার বিরুদ্ধে অবশ্যই সংগ্রাম চালানো চাই, সমাধা করা চাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।

যে-শিল্পোত্তীর্ণ রচনাবলির মর্ম জনগণ উপলব্ধি করবে, তারা তা পড়বে, যখন তারা জমিদার আর পুঁজিপতিদের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে নিজেদের জন্যে সৃষ্টি করবে জীবনের মনুষ্যোচিত পরিবেশ, এমন রচনাবলি তলস্তয় সৃষ্টি করেছেন শুধু তাই নয়; বর্তমান ব্যবস্থায় অত্যাচারিত বিপুল জনগণের নানা মেজাজও তিনি বিশেষ জোরের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন, তাদের অবস্থা চিত্রিত করতে এবং তাদের প্রতিবাদ আর ক্রোধের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি প্রকাশ করতে পেরেছেন। তলস্তয় মুখ্যত ১৮৬১–১৯০৪ সালের যুগের মানুষ, তদনুসারে, শিল্পী হিসেবে এবং চিন্তাবীর আর প্রচারক হিসেবেও তিনি নিজ রচনাবলিতে সমগ্র প্রথম রুশ বিপ্লবের বিশেষ-নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক উপাদানগুলিকে, বিপ্লবের শক্তিটা আর দুর্বলতাটাকে রূপদান করেছেন বিস্ময়কর বলিষ্ঠ রেখায়।

আমাদের বিপ্লবের একটা মুখ্য বৈশিষ্ট্যসূচক উপাদান এই যে, পৃথিবীর সর্বত্র পুঁজিবাদের খুবই অগ্রসর বিকাশ এবং রাশিয়ায় পুঁজিবাদের অপেক্ষাকৃত অগ্রসর বিকাশের যুগে এটা ছিল একটা কৃষক বুর্জোয়া বিপ্লব। এটা ছিল বুর্জোয়া বিপ্লব, কেননা বুর্জোয়াদের আধিপত্য উচ্ছেদ করা নয়, জারের স্বৈরতন্ত্রকে, জারের রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা এবং জমিদারিপ্রথা লোপ করাই ছিল এর সাক্ষাৎ লক্ষ্য। বিশেষত কৃষককুল আগে-উল্লিখিত লক্ষ্যটা সম্বন্ধে অবহিত ছিল না, – এই লক্ষ্যটা এবং সংগ্রামের অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি আর অপেক্ষাকৃত বেশি সাক্ষাৎ লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য সম্বন্ধে অবহিত ছিল না। এটা ছিল কৃষক বুর্জোয়া বিপ্লব, কেননা বিষয়গত পরিবেশ যা ছিল সেটা সামনে তুলে ধরেছিল কৃষককুলের জীবনের বুনিয়াদী অবস্থা পরিবর্তনের সমস্যা, ভূমি-মালিকানার পুরনো মধ্যযুগীয় ব্যবস্থাটাকে ভেঙে ফেলার সমস্যা, পুঁজিবাদের জন্যে ‘জমিন সাফ করার’ সমস্যা ; কম-বেশি স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে কৃষকসাধারণ দেখা দিয়েছিল নৈর্বক্তিক পরিবেশের দরুন।

তলস্তয় এবং চেখভ (বামে)

ঠিক কৃষক গণ-আন্দোলনেরই শক্তি আর দুর্বলতা, ক্ষমতা আর সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে তলস্তয়ের রচনাবলিতে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং পুলিসের সঙ্গে গাঁটছড়াবাঁধা সরকারী যাজকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে তাঁর ক্রুদ্ধ, আবেগচঞ্চল এবং প্রায়ই নির্মম-তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে ফুটে উঠেছে আদিম ধরনের কৃষক গণতান্ত্রিক জনগণের অনুভূতি, – তাদের মধ্যে শতাব্দীর-পর-শতাব্দীর ভূমিদাসত্ব, সরকারী জুলুম আর রাহাজানি এবং গির্জার ভণ্ডামি, ছলনা আর প্রতারণা জমিয়ে তুলেছিল পর্বতপ্রমাণ ক্রোধ আর ঘণা। ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার বিরুদ্ধে তাঁর অনমনীয় বিরোধিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে সেই ঐতিহাসিক কালপর্যায়ের কৃষক জনগণের মানসতা, যাতে ভূমিসম্পত্তি আর রাষ্ট্রীয় ‘আবণ্টন’ উভয় রূপের পুরনো মধ্যযুগীয় জমিদারিপ্রথা দেশের পরবর্তী বিকাশের পথে হয়ে উঠেছিল একটা অতি অসহ্য অন্তরায়, আর যখন এই পুরনো ভূমিমালিকানার অতি সরাসরি আর নির্মম ধ্বংস ছিল অনিবার্য, অবধারিত। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অবিরাম অভিযোগ – অতি প্রগাঢ় আবেগ এবং সুতীব্র সক্রোধ-ঘৃণায় ভরপুর সেই অভিযোগের মধ্যে ফুটে উঠেছে প্যাট্রিয়ার্কাল কৃষকের অনভূত সমগ্র পরম বিতৃষ্ণা, যা সে অনুভব করেছে নতুন অদৃশ্য অবোধ্য শত্রর আগমনে, যা শহরের কোনো জায়গা থেকে, কিংবা বিদেশের কোনো জায়গা থেকে এসে ধ্বংস করছে গ্রামজীবনের সমস্ত ‘খুঁটিগুলোকে’, সঙ্গে নিয়ে আসছে অভূতপর্বে অধঃপতন, গরিবি, ভুখা, বর্বরতা, বেশ্যাবৃত্তি, সিফিলিস – ‘আদিম সঞ্চয়নের যুগের’ অনুষঙ্গী যাবতীয় বিপর্যয়-দুর্দশা, যা শতগণ প্রকোপিত হলো মিঃ কুপনের [২] গড়ে-তোলা সর্বাধুনিক লুণ্ঠনপ্রণালীগুলো  রাশিয়ার মাটিতে পরিবাপনের দরুন।

আরো পড়ুন:  সোভিয়েত সরকারের সাফল্য ও বিঘ্ন

কিন্তু, এই প্রচণ্ড প্রতিবাদকারী, এই প্রবল অভিযোক্তা, এই মহাসমালোচক তারই সঙ্গে সঙ্গে নিজ রচনাবলিতে স্পষ্ট দেখিয়েছেন রাশিয়াকে বিপন্ন করছিল যে-সংকট তার কারণগুলো এবং তার থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায়াদি বুঝতে অপারগতা, যেটা ছিল ইউরোপীয় শিক্ষাদীক্ষা-পাওয়া লেখকের নয় – প্যাট্রিয়ার্কাল, অতি-সরল কৃষকেরই বিশেষক। সামন্তবাদী পুলিসী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম পরিণত হলো রাজনীতি বর্জনে, তার থেকে এল ‘অমঙ্গলের বিরদ্ধে না-প্রতিরোধের’ মতবাদ, ১৯০৫-১৯০৭ সালে জনগণের বৈপ্লবিক সংগ্রাম থেকে একেবারে দূরে-অবস্থান। সরকারী যাজকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে লড়াই যুক্ত হলো নতুন শোধিত ধর্ম প্রচারের সঙ্গে, অর্থাৎ, উৎপীড়িত জনগণের জন্যে নতুন মার্জিত সক্ষম ধরনের বিষের সঙ্গে। ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধিতা থেকে আসল শত্রুর বিরুদ্ধে – জমিদারিপ্রথা আর তার ক্ষমতার রাজনীতিক হাতিয়ার, অর্থাৎ রাজতন্ত্রের বিরদ্ধে – সংগ্রাম কেন্দ্রীভূত হলো না, তার থেকে এল স্বপ্নালু, এলোমেলো আর অক্ষম বিলাপ। পুঁজিবাদ এবং জনগণের উপর তার চাপানো দুর্দশা বিপর্যয়গুলোর স্বরূপ খুলে ধরাটা যুক্ত হলো আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী প্রলেতারিয়েতের পরিচালিত পৃথিবীজোড়া মুক্তিসংগ্রামের প্রতি একেবারে উদাসীন মনোভাবের সঙ্গে।

তলস্তয়ের অভিমতের অসঙ্গতিগুলো তাঁর ব্যক্তিগত অভিমতের সহজাত অসঙ্গতিই শুধু নয়, সেটা হলো সংস্কার-পরবর্তী কিন্তু বিপ্লবপূর্ব রুশী সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি আর বিভিন্ন বর্গের মানসতা নির্ধারিত করেছিল যেসব অতি জটিল, অসঙ্গতিপূর্ণ পরিবেশ, সামাজিক প্রভাব আর ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সেগুলোর প্রতিবিম্ব।

এই কারণেই, এইসব অসঙ্গতির প্রথম প্রকটনের মধ্যে, বিপ্লবের সময়ে যে-শ্রেণি নিজ রাজনীতিক ভূমিকা আর সংগ্রাম দিয়ে প্রমাণ করেছে যে, জাতিসমূহের স্বাধীনতা এবং জনগণের শোষণমুক্তির জন্যে সংগ্রামে সেটার নেতৃত্ব পূর্বনির্দিষ্ট, যে-শ্রেণি প্রমাণ করেছে গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি আত্মনিবেদিত নিষ্ঠা এবং বুর্জোয়া (কৃষক সমেত) গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা আর অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সামর্থ্য, কেবল তারই দৃষ্টিকোণ থেকে তলস্তয়ের নির্ভুল মূল্যায়ন করা যায়; এমন মূল্যায়ন সম্ভব কেবল সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক প্রলেতারিয়েতের দৃষ্টিকোণ থেকেই।

সরকারী সংবাদপত্রগুলোয় তলস্তয় সম্বন্ধে মূল্যায়নটা একবার দেখুন। তারা কুম্ভীরাশ্রবর্ষণ করছে, ‘এই মহান লেখকের’ প্রতি শ্রদ্ধার কথা বলছে, আর তারই সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়াচ্ছে ‘পবিত্র’ সিনদে’র [৩] সপক্ষে। আর ধার্মিক ফাদারেরা এখনই একটা জঘন্য বদমাশি করেছে; জনসাধারণকে ভাঁওতা দেবার জন্যে এবং তলস্তয় ‘অনুতপ্ত হয়েছিলেন’ বলতে পারার মতলবে তারা সেই মুমূর্ষু মানুষটির কাছে পাদরি পাঠিয়েছিল। পবিত্র সিনদ তলস্তয়কে ধর্মসমাজচ্যুত করেছিল। সেটা আরও ভালই হলো। পাদরির আলখাল্লা-পরা আমলাদের সঙ্গে, খ্রিস্টের আরক্ষীদের সঙ্গে, অশুভ ইনকুইজিটরদের সঙ্গে, যারা ইহুদীবিরোধী দাঙ্গা এবং জারতন্ত্রী কৃষ্ণ-শতক দঙ্গলের অন্যান্য কীতি সমর্থন করেছে তাদের সঙ্গে জনগণের হিসাবনিকাশের সময় এলে এই কীর্তির কথা তাঁর মনে পড়ে যাবে।

আরো পড়ুন:  নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও সমালোচক

উদারপন্থী সংবাদপত্রগুলোয় তলস্তয় সম্বন্ধে মূল্যায়নটা একবার দেখন। তারা গণ্ডিবদ্ধ থেকেছে ফাঁপা, সরকারী-উদারপন্থী, বস্তাপচা বুলিগুলোতে – ‘সুসভ্য বিশ্বজনের কণ্ঠস্বর’, ‘বিশ্বের সর্বসম্মত সাড়া’, ‘সত্যের, শুভের ভাব-ভাবনা’, ইত্যাদি – যার জন্যে তলস্তয় বুর্জোয়া বিজ্ঞানকে অত ভর্তসনা করে গেছেন, ভর্তসনা করে গেছেন ন্যায্যতই। রাষ্ট্র, যাজকমণ্ডলী, ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা, পুঁজিবাদ সম্বন্ধে তলস্তয়ের অভিমত প্রসঙ্গে তারা মনখুলে স্পষ্ট করে বলতে পারে না — তার কারণ এই নয় যে, সেন্সরশিপ তা বলতে দেয় না; তার উলটো, সেন্সরশিপ তো অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বের হতে সাহায্যই করছে! — কারণটা হলো এই যে, তলস্তয়ের সমালোচনার প্রত্যেকটা উপস্থাপনা বুর্জোয়া উদারপন্থার গালে একটা চপেটাঘাত; কারণটা হলো এই যে, আমাদের কালের সবচেয়ে যন্ত্রণাকর আর সবচেয়ে গোলমেলে সমস্যাগুলোকে তলস্তয় ঠিক যেভাবে উত্থাপন করেছেন নির্ভীকভাবে, খোলাখুলি আর নিষ্করুণভাবে সেটা আমাদের উদারপন্থী (এবং উদারপন্থী-নারোদনিক[৪]) প্রাবন্ধিকদের মামুলি বুলি, গতানুগতিক উচ্ছ্বাস এবং এড়িয়ে যাবার চাতুরি-ভরা ‘সুসভ্য’ মিথ্যাভাষণের উপর একটা ধমকানি। উদারপন্থীরা সর্বতোভাবে তলস্তয়ের পক্ষে, তারা সর্বতোভাবেই সিনদের বিরুদ্ধে — আর তারই সঙ্গে সঙ্গে তারা পক্ষে… ভেখিপন্থীদের [৫], যাদের সঙ্গে ভিন্নমত হওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাদের সঙ্গে একই পার্টিতে মিলজুল করে থাকা ‘আবশ্যক’, তাদের সঙ্গে একত্রে সাহিত্য আর রাজনীতির ক্ষেত্রে কাজ করা আবশ্যক। ভেখিপন্থীদের কিন্তু চুম্বনাভিবাদন জানায় ভলিনিয়ার বিশপ অ্যান্টনি।[৬]

উদারপন্থীরা এই কথাটা সামনে তুলে ধরে যে, তলস্তয় হলেন ‘মহাবিবেক’। ‘নোভয়ে ভ্রেমিয়ায়’ [৭] এবং এই রকমের সমস্ত সংবাদপত্রেও হাজার শব্দান্তরে পুনরাবৃত্ত এই একই কথাটা শূন্যগর্ভ নয় কি? গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের যেসব মূর্ত-নির্দিষ্ট সমস্যা তলস্তয় উত্থাপন করেছেন, এটা সেগুলোকে এড়িয়ে যাবার চাতুরি নয় কি? তলস্তয়ের বোধশক্তি নয় কুসংস্কার প্রকাশ পায় যাতে, তাঁর যে-অংশ ভবিষ্যতের নয় – অতীতের, সমস্ত রকমের শ্রেণিগত আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাঁর প্রচণ্ড প্রতিবাদ নয় – তাঁর রাজনীতিবর্জন আর নৈতিক আত্মশুদ্ধির প্রচার, সেগুলোকেই এতে সামনে তুলে ধরা হয় নি কি?

তলস্তয় মারা গেছেন, আর মহাশিল্পীর দর্শনে প্রকাশ পেয়েছে এবং তাঁর রচনাবলিতে চিত্রিত হয়েছে যে-বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার দুর্বলতা আর অক্ষমতা সেটা তার সঙ্গে হয়ে পড়েছে অতীতের বস্তু। কিন্তু, যে-উত্তরাধিকার তিনি রেখে গেছেন তার মধ্যে রয়েছে এমন বস্তু যা অতীতের জিনিস হয়ে পড়ে নি, যা ভবিষ্যতের। রাশিয়ার প্রলেতারিয়েত এই উত্তরাধিকার গ্রহণ করে সেটা নিয়ে কাজ করছে। রাষ্ট্র, যাজকমণ্ডলী, ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সম্বন্ধে তলস্তয়ের সমালোচনাটাকে রাশিয়ার প্রলেতারিয়েত মেহনতী আর শোষিত জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করে জানাবে, — জনগণ নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ করে রাখবে আত্মশুদ্ধিতে আর স্বর্গীয় জীবনের জন্যে আকুল আকাঙ্ক্ষার মধ্যে, এই উদ্দেশ্যে নয়, এই ব্যাখ্যা তারা দেবে যাতে জনগণ জারের রাজতন্ত্র আর জমিদারিপ্রথার উপর নতুন আঘাত হানতে উঠে দাঁড়ায়, যে-রাজতন্ত্র আর জমিদারিপ্রথা ১৯০৫ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সামান্যমাত্র, যাকে বিনষ্ট করাই চাই। রাশিয়ার প্রলেতারিয়েত পুঁজিবাদ সম্বন্ধে তলস্তয়ের সমালোচনাটাকে জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করে জানাবে, — পুঁজি আর টাকার ক্ষমতার বিরুদ্ধে অভিশাপবর্ষণে জনগণ নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ রাখবে, এই উদ্দেশ্যে নয়, এই ব্যাখ্যা তারা দেবে যাতে জনগণ তাদের জীবন আর সংগ্রামের প্রতিপদে পুঁজিবাদের টেকনিকাল আর সামাজিক সাধনসাফল্যগুলিকে কাজে লাগাতে শেখে, যাতে জনগণ শিখতে পারে কী করে এক হয়ে মিলেমিশে সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তুলতে হয় বহু, লক্ষ-লক্ষ সমাজতন্ত্রী যোদ্ধাদের, যে-যোদ্ধারা পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করবে, গড়বে নতুন সমাজ, যেখানে গরিবি নয় মানুষের কপালে ভবিতব্য, যেখানে থাকবে না মানষের উপর মানুষের শোষণ।

আরো পড়ুন:  ল. ন. তলস্তয় এবং সমসাময়িক শ্রমিক আন্দোলন

১৮ নং ‘সোৎসিয়াল-দেমোক্রাৎ,

১৬ (২৯) নভেম্বর, ১৯১০[৮]

টিকা:

১. ১৮৬১ সালে রাশিয়ায় ভূমিদাসপ্রথার বিলোপ ঘটে।

২. ‘মিঃ কুপন’ – ১৯শ শতকের নবম ও দশম দশকের সাহিত্যে এই নামে পুঁজি ও পুঁজিপতিদের বোঝানো হতো। ‘মিঃ কুপন’ কথাটি সাহিত্যে প্রথম ব্যবহার করেন রুশ লেখক গ্লেব উসপেনস্কি তাঁর ‘মারাত্মক পাপ’ নামক প্রবন্ধে।

৩. ‘পবিত্র সিনদ’ – রাশিয়ায় সনাতনী গির্জার সর্বোচ্চ যাজকীয় বিচারসভা।

৪. নারোদনিক ১৯শ শতকের অষ্টম ও নবম দশকে রাশিয়ায় আবির্ভূত নারোদবাদ নামক একটি ভাবাদর্শগত রাজনীতিক মতবাদের অনুগামী। নারোদনিকরা বিপ্লবী আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃভূমিকা অস্বীকার করত; তাদের ভ্রান্ত মতে বিপ্লব ঘটাতে পারে ক্ষুদে মালিক, কৃষক; সমাজতন্ত্র বিকাশের ভিত্তি বলে তারা ধরত গ্রামগোষ্ঠীকে, যা আসলে ছিলো রুশ গ্রামে সামন্তবাদের জের, ইত্যাদি। নারোদনিক সমাজতন্ত্র ছিল ইউটোপীয়, কেননা সমাজের বাস্তব বিকাশের ওপর তার ভিত্তি ছিলো না, শুধু ফাঁকা বুলি, অলীক কল্পনা, শুভেচ্ছাই ছিল তার সার।

নবম-দশম দশকে নারোদনিকরা জারতন্ত্রের সঙ্গে আপসের পন্থা অবলম্বন করে, কুলাকদের স্বার্থ প্রকাশ করে, মার্কসবাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সংগ্রাম চালায়।

৫. ভেখিপন্থী – বিশিষ্ট কাদেত প্রাবন্ধিক, প্রতিবিপ্লবী উদারনীতিক বুর্জোয়ার প্রতিনিধি; ১৯০৯ সালের বসন্তে এরা মস্কোয় ‘ভেখি’ নামে একখানা প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশ করে। ‘রুশ বুদ্ধিজীবীদের’ সম্বন্ধে রচিত এই প্রবন্ধগুলিতে ‘ভেখিপন্থীরা’ রাশিয়ার মুক্তি-আন্দোলনের বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে, ১৯০৫ সালের বৈপ্লবিক আন্দোলনকে ধিক্কার দেয়। সংকলনটিতে বুদ্ধিজীবীদের স্বৈরতন্ত্রের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে আহবান জানানো হয়।

৬. অ্যান্টনি অব ভলিনিয়া (খ্রাপভিৎস্কি আ. প.) (১৮৬৩-১৯৩৬) – রুশ সনাতন গির্জার চরম দক্ষিণপন্থী ধারার প্রধান, জারতন্ত্রের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির অন্যতম প্রবক্তা। ১৯০২ সাল থেকে বিশপ, পরে আর্চবিশপ।— সম্পাদকের টিকা

৭. নোভয়ে ভ্রেমিয়া (‘নব কাল’) – সংবাদপত্র, পিটার্সবার্গ থেকে প্রকাশিত হয় ১৮৬৮ থেকে ১৯১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। প্রথমে নরমপন্থী উদারনীতিক, ১৮৭৬ সাল থেকে প্রতিক্রিয়াশীল অভিজাত ও বৃহৎ আমলাতান্ত্রিক চক্রের মুখপত্র।

৮. লেখক অনুপ সাদি সম্পাদিত ভি. আই. লেনিনের প্রবন্ধগ্রন্থ সাহিত্য প্রসঙ্গে, টাঙ্গন ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৮ থেকে এই লেখাটি রোদ্দুরে ডট কমে সংকলন করা হয়েছে।।

Leave a Comment

error: Content is protected !!